বরাবরের মতো বাঙালির দুয়ারে ফিরে আসলো ৭ই মার্চ। ঐদিনে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী দশ লক্ষেরও অধিক জনগণের সমাবেশে এক কালজয়ী ভাষণ প্রদান করেন। এভাষণ এখন মানবমুক্তি, রাজনীতি তথা জাতিসংঘের হেরিটেজ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। শুধু তাই নয়– বঙ্গবন্ধুর ঐ ১৮–১৯ মিনিটের ভাষণ অনবরত, অনর্গল, কাব্যিক ও ইন্দ্রজালের এক মহাকাব্যও। ঐ বছরের ৫ এপ্রিল বিখ্যাত ‘নিউজউইক’ সাময়িকী বঙ্গবন্ধুকে রাজনীতির কবি হিসেবে আখ্যায়িত করে। ঐ সংখ্যায় ‘নিউজউইক’ পত্রিকা উল্লেখ করে– “Sketches a similar emotive figure and an artistic altruism of Sheikh Mujib by terming him a Ôpoet of politics’. The magic of the speech is that it never becomes monotonous. Therefore, it is erroneous to regard it simply as a politicians speech ” বাঙালির অন্যতম কবি নির্মলেন্দু গুণ এ ভাষণকে বলেছেন ‘শত বছরের শত সংগ্রামের ও স্বাধীনতার এটি বাঙালির অমর কবিতা।
পৃথিবীর অধিকাংশ জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য বিংশ শতাব্দী স্মরণীয়। মাত্র দু’দশকের ব্যবধানে দুটি বিশ্বযুদ্ধ, বলশেভিক বিপ্লব, ভারত–পাকিস্তান সৃষ্টি, চীন বিপ্লব, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ। এই বছরেই জন্ম নিয়েছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতা দিয়ে অমর করে রেখেছেন– “দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা, রক্তগঙ্গা বহমান/ তবু নাই ভয়, হবে হবে জয়, শেখ মুজিবুর রহমান।”
আব্রাহাম লিঙ্কন ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার সিভিল ওয়ার’র সময় (প্রেসিডেন্ট, ১৮৬৩, ১৯ নভেম্বর পেনসিলভেনিয়ার গেটিসবার্গ) গৃহযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জনকারী সৈনিকদের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটি আমেরিকার ইতিহাসে গণতন্ত্রের জন্য এক স্মরণীয় ভাষণ হয়ে থাকবে। তাঁর অমর ভাষণে স্মরণীয় উক্তি– “ÒGovernment of the people, by the people, for the people, shall not perish for the earth”… it remains one of the best known speeches in American history আর ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাজ্যের উইনস্টন চার্চিল কালজয়ী এক ভাষণে বলেছিলেন– We shall fight on the beaches. (Given to a speech of the house of commons of the parliament of the united kingdom on 4th June 1940)
সম্প্রতি ইতিহাস লেখক Jackob F. Field পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলিকে স্থান দিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যেগুলো পৃথিবীর ইতিহাসকে উদ্বেলিত করে। We shall fight on the beaches: Speeches that Inspired History গ্রন্থটিতে বিশ শতকের সাড়া জাগানো জাতীয়তাবাদী ও জাতীয় ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণসহ মোট চল্লিশটি ভাষণ স্থান পেয়েছে। ভারতের জাতির পিতা মাহাত্মা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকার স্মরণীয় নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, ইতালির জাতীয়তাবাদ ও একত্রীকরণের নেতা জেনারেল গ্যারিবল্ডী প্রমুখ শ্রেষ্ঠ জাতীয় নেতাদের ভাষণের মূল্যায়ন রয়েছে গ্রন্থটিতে। আর বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের– “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” Jackob F. Field এর বর্ণনানুযায়ী– This time the struggle is our freedom, This time the struggle is for our Independence. এতে কোন প্রেক্ষাপটে, কোন জাতীয় প্রয়োজনে ও পরিস্থিতি বিবেচনায় পৃথিবীখ্যাত রাষ্ট্রনায়কদের অমূল্য ভাষণ প্রদত্ত হয়েছে তা মূল্যায়নের প্রচেষ্টা হয়েছে। আব্রাহাম লিঙ্কন, মাহাত্মা গান্ধী, উইনস্টন চার্চিল, মার্টিন কিং লুথার, চৌ এন লি, নেলসন ম্যান্ডেলার ভাষণের আবেদন ও প্রেক্ষাপট আর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ কিছুটা আলাদা। উপর্যুক্ত জাতীয় নেতারা গৃহযুদ্ধ, গণতন্ত্র–সুরক্ষা, যুদ্ধজয়, কালো মানুষের অধিকার অথবা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অবিচল আকুতি ব্যক্ত করেছেন তাঁদের প্রদত্ত ভাষণে। এর মধ্যে গান্ধীজীর “Quit India, ours is not drive for power, but purely a non-violent fight for Indians independence” বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন “যার যা কিছু আছে তা দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে”। তিনি প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন। অর্থাৎ ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণায় শসস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালির বিজয় অর্জনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। শতাব্দী কাল থেকে শোষণ–শাসন ও বঞ্চনার ইতিহাসের কথা বলে– পশ্চিম পাকিস্তানের জুলুম–শোষণ–হত্যা ও রক্তের ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সেদিন বাঙালির মৌলিক অধিকার, ন্যায্যতা–সমতা–বঞ্চনার ইতিহাসকে গুরুত্ব দিয়ে শুধু বাঙালির নয় বরং পৃথিবীর অধিকারবঞ্চিত মানুষকে আন্দোলন সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করার উদাহারণ সৃষ্টি করেছেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট পওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানি সামরিকজান্তা তাঁকে ক্ষমতা হস্তান্তরে নানান অজুহাত ও বাহানা সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে জাতির পিতার আহবানে শসস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাঙালি স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নেয় লাল–সবুজের বাংলাদেশ। শোষিত–নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের অনুকরণীয় হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ। বিবিসি জরিপে বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন। ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে সাড়া বিশ্ব সীমানায় পৌঁছে গেছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘের ইউনেস্কার “মেমরি অব ওর্য়াল্ড রেজিস্টার” হিসেবে সংরক্ষিত হয়েছে। মার্চ মাস বাংলাদেশের জন্ম ও ভাগ্যের সাথে একাকার হয়ে গেছে। মার্চ মাসেই বঙ্গবন্ধুর জন্ম (১৭ই মার্চ ১৯২০)। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ ও ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ বিজয় (১৬ ডিসেম্বর) কথা আসলে আসে ৫২, আসে ৬৬, আসে ৬৯ ও স্বাধীনতার পূর্বে ৭ মার্চ। মানবমুক্তির অমর ও অবিনাশী দলিল হিসেবে অবিস্মরণীয় হয়ে থাক বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণ।
লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাবন্ধিক ও গবেষক










