রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও আমাদের ফুলপরী

জসীম চৌধুরী সবুজ | সোমবার , ৬ মার্চ, ২০২৩ at ৭:৩৫ পূর্বাহ্ণ

দেশের সর্বত্র এখন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তের বেজায় উল্লম্ফন ঘটেছে। এই দুর্বৃত্তায়ন আমাদের নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের জার্সি গায়ে দিয়ে এসব সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তদল আজ দেশের প্রতিটি সেক্টরে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের

 

কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত প্রায়। অতিষ্ঠ সাধারণ শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ আমজনতা। সরকারি চাকুরেদের তিন বছর পর বদলির বিধান রয়েছে। দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকলে অনেকের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে, কায়েমি স্বার্থবাদীরা তার সুযোগ নিতে চেষ্টা করে। এই কারণেই বদলির বিধানযেন কায়েমি স্বার্থ কোথাও গেড়ে না বসে। প্রশাসনে বদলির বিধান থাকলেও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের সেই ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয় না। তাদের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম দরকার এবং

সেটি সবসময় ক্ষমতাসীন দলের। ওদের বদলি করতে হয় না, ওরা দল বদলায়। ওরা এজিপি অর্থাৎ অলওয়েজ গভর্নমেন্ট পার্টি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বদল হলেই ওরা রং বদলায়। যখন যেই দল ক্ষমতায় তখন সেই দলের জার্সি গায়ে দিয়ে ওরা দুর্বৃত্তপনা চালিয়ে যায়। ওদের কারণে প্রশাসন হয় বিব্রত, সরকারের হয় বদনাম।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তিন মেয়াদে টানা চৌদ্দ বছর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। এই সময়ে ৭১এর যুদ্ধাপরাধীর বিচার, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার, ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলার বিচারসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মাসেতুর মত চ্যালেঞ্জিং

প্রকল্প, ঢাকায় মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণসহ অনেক মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা কাজ চলমান রয়েছে। কিন্তু সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের নানামুখী অপকর্মে সরকারের সাফল্য ম্লান করে দিচ্ছে। সরকারিআধাসরকারি দপ্তরঅধিদপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র এই দুর্বৃত্তদল

টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজিসহ তাদের নানান অপকর্ম চালিয়ে যেতে সরকারি দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্বে আসীন হতে মরিয়া। তাদের দাপটে ত্যাগী ও নিবেদিত কর্মীসংগঠকরা কোণঠাসা। জামায়াতশিবির এবং যুদ্ধাপরাধীদের সন্তান বা নাতিপুতিরাও আজকাল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি সেজে মাঠে গলা ফাটাচ্ছে এবং

দুর্বৃত্তপনার মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা দলীয় সাইনবোর্ড ও পদপদবীকে ব্যবহার করে গিলে খাচ্ছে নদনদী, জেগে ওঠা চরবালুতট, সংরক্ষিত বনবাদাড়, কেটে সাবাড় করছে পাহাড়টিলা, জমির টপসয়েল কেটে নিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমিকে করে ফেলছে অনাবাদী।

রাজনৈতিক এসব দুর্বৃত্তের কবলে এখন অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইডেন কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র এই দুর্বৃত্তদের রাজত্ব। প্রশাসনকে এখানে অসহায় বলব না, সংবাদ মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যমতে বরং কোথাও কোথাও সহায়ক ভূমিকা রাখছেন। চট্টগ্রাম

বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক তিন মাসে ১৬ বার সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সংবাদ উদ্বেগজনক। ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এসব সংঘর্ষে জড়িয়েছে। নিজেদের হানাহানিতে রক্তাক্ত হয়েছে ক্যাম্পাস। এরা উপাচার্যের দপ্তর ভাঙচুর করেছে, একাধিক প্রভোস্ট কক্ষসহ ৭০টি কক্ষ ভাংচুর করেছে, শার্টল

ট্রেনের চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের হেনস্তা করেছে। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাজে ব্যাঘাত যেমন ঘটাচ্ছে তেমনি প্রতিষ্ঠানের সহায়সম্পত্তির ক্ষতিসাধনও করছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ১২ জন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু এসব রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের অপতৎপরতা তেমন একটা কমেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কোনো ছাত্রলীগ নেতার রুমে হাজিরা দিয়ে আনুগত্য প্রদর্শন, চাহিবা মাত্র মিছিলমিটিংয়ে অংশগ্রহণ না করার অপরাধে সাধারণ শিক্ষার্থীর উপর নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনার কাহিনি সংবাদপত্র পাঠকরা ভোলেন নি। শুধু ছাত্রলীগই নয়, শিক্ষকবুদ্ধিজীবীরাও আজ নিজের সম্মান হারাচ্ছেন

দলীয় কুশীলবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে। বুদ্ধিজীবীলেখকদের অধিকাংশই স্তুতিবাক্য রচনার মাধ্যমে প্রাপ্তির প্রত্যাশায় মরিয়া। পেশাজীবী প্রতিটি সংগঠনে আজ রাজনৈতিক বিভাজন অত্যন্ত প্রকাশ্য। পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনে চলে লাখ লাখ টাকার খেলা। চলে বিকিকিনি। সংগঠনের মূল পদে নির্বাচিত

হতে লাখ টাকাকোটি টাকা খরচের খবরও জানাজানিকানাকানি হয়। নির্বাচিত হয়ে এসব নেতৃত্বের অধিকাংশই রাজনৈতিক গুরু তথা গডফাদারের পিট চুলকানিতেই ব্যস্ত সময় কাটান। সংগঠন বা এর সাধারণ সদস্যদের কল্যাণে ভূমিকা রাখার চেয়ে এরা নিজেদের আখের গোছাতেই সদা ব্যস্ত। আবার নিজেকে

আঁতেল শ্রেণির মনে করেন এমন অনেকে প্রার্থীদের কাছ থেকে দেন দরবার করে নানান সুযোগ সুবিধা গ্রহণের কথাও শুনি। কখনো ক্যাশ, কখনো কাইন্ড। এরাই আবার বিভিন্ন জায়গায় নীতি নৈতিকতার(!) কথা বলে সুন্দর সুন্দর বক্তৃতা দেন। দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে এখন ব্যবসাবাণিজ্যের বেহাল অবস্থা।

দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে বিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত। চাল, ডাল, তেল, তরিতরকারি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। ব্রয়লার মুরগী এবং ডিমে যাদের পুষ্টির কিছুটা যোগান হত সেই ডিমমুরগী এখন নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এ লেখা যখন লিখছি

তখন সরকার নির্বাহী আদেশে খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম আরেক দফা বাড়িয়েছে। দুই মাসের ব্যবধানে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশ বাড়ল। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে সরবরাহ না দিলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে গিয়ে খরচের বিরাট বোঝা চাপছে নিরীহ গ্রাহকের ঘাড়ে। ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি নিয়েও নানান প্রশ্ন এখন আলোচিত হচ্ছে।

ঢাকায় ক্যাসিনো কান্ডের হোতা যুবলীগ নেতা ক্যাসিনো সাঈদ বিদেশ থেকে অবৈধ পথে দেশে ফিরে আবার সক্রিয় হয়েছেন। তাকে একটি ক্রীড়া ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক পদে পুনর্বহাল করা হয়েছে। টিআইবি এ ঘটনাকে নীতি নৈতিকতার লংঘন বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

সম্প্রতি দেশে তুমুল সমালোচিত ঘটনাটি ঘটে গেছে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের গণরুমে। ফিন্যান্স বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুনের উপর বর্বর নির্যাতনের কাহিনি সংবাদ মাধ্যমে জেনেছেন পাঠকরা। নবীন এই ছাত্রীর উপর অমানবিক নির্যাতন এবং বিবস্ত্র করে তার

ভিডিও ধারণে জড়িতরা সবাই ছাত্রলীগের নেতা। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটিসহ দুটি তদন্ত কমিটিই তাদের রিপোর্টে ছাত্রলীগের পাঁচ নেত্রীকে অভিযুক্ত করে রিপোর্ট জমা দেওয়ার পর হাইকোর্ট এই ঘটনার নির্দেশদাতা সানজিদা চৌধুরী অন্তরাসহ পাঁচজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের

নির্দেশ দিয়েছেন। পাশবিক, অমানবিক ও জঘন্য এই ঘটনায় জড়িত অন্য চারজন হচ্ছেন হালিমা আক্তার মুন্নী, ইশরাত জাহান মীম, তাবাসসুম ইসলাম ও মোয়াবিয়া জাহান। তদন্ত কমিটি ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত বলে উল্লেখ করেছে।

ফুলপরীকে গণরুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। মারধরঅত্যাচারের সময় ছাত্রীটি যখন আর্তনাদ করছিলেন তখন অট্টহাসি আর উল্লাসে মেতেছিল নির্যাতনকারীরা। চিৎকার করলে তার মুখে গামছা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে পিপাসায় কাতর হয়ে পানি চাইলে তাকে ডাইনিংয়ে নিয়ে গিয়ে ময়লা গ্লাস জিহ্‌বা দিয়ে চেটে পরিষ্কার করতে বাধ্য করা হয়। নবীন এই ছাত্রীর অপরাধ তিনি ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদার কাছে আনুগত্য প্রকাশ করতে যাননি।

 

ফুলপরী দুর্গম এক জনপদ থেকে উঠে আসা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এক সদস্য। তার বাবা রিকশা ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় নিবেদিত একজন মানুষ। সন্তানদের মানুষ করছেন নীতি নৈতিকতা ও আদর্শবান হিসেবে। ফুলপরী তাই ঘটনাটি চেপে যাননি। তিনি বিচার চেয়ে

সোচ্চার হয়েছেন। বাবার ভ্যানে চড়ে ৩০ কিলোমিটার এবং এরপর নৌকাগাড়িতে আরও দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হয়েছেন এবং অভিযুক্তদের চোখে চোখ রেখে পুরো ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ফুলপরী যে সাহস দেখিয়েছেন তা ঘুনে ধরা এই সমাজে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। ওর বাবা সত্য ও ন্যায়

প্রতিষ্ঠায় মেয়ের পাশে যেভাবে অবিচল দাঁড়িয়েছেন সেটিও আমাদের কাছে শিক্ষণীয়। ফুলপরী আমাদের মেয়ে, সাহসী মেয়ে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সরব স্ফুলিঙ্গ। অজস্র শুভ কামনা ফুলপরীর জন্যে।

লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীদের প্রযুক্তি দক্ষতা ও উদ্ভাবন ক্ষমতার সুযোগ বৃদ্ধি হোক
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের প্রয়োজন স্মার্ট বাংলাদেশ এবং স্মার্ট সিটিজেন