আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন

নিজের পরিচয়ে পরিচিত হওয়া

এমিলি মজুমদার | শনিবার , ৪ মার্চ, ২০২৩ at ৮:৫৭ পূর্বাহ্ণ

সব সময় টাকা টাকা করো না তো! টাকা নেই এখন, যাও, টাকা কি গাছে ধরে! আমার কি টাকার মেশিন আছে? টাকা না থাকলে কি চুরি করে আনবো? আমি কি তোমার এ টি এম কার্ড? রোজগার তো করোনা, নাহলে বুঝতে টাকার মর্ম!

ইত্যাদি ইত্যাদি স্বামীর মুখ থেকে বিচ্ছুরিত বাক্যগুলো নিত্য আমাদের গৃহবধূদের কানে গরম শীশা ঢালছে। এমনকি বাচ্চার স্কুলের বেতন, কোচিংয়ের বেতন, শিক্ষকের বেতন চাইলে বা মাসের বাজার খরচ শেষ হয়ে গেলে কিংবা বাড়িতে কিছু ফুরিয়ে গেলেও অনেক স্ত্রীকে স্বামীর মুখঝামটা খেতে হয় নিত্য, মনে হয়

সব কিছুর জন্য স্ত্রী’ই দায়ী। টাকা চাইলেই মাথা গরম। যে সমস্ত স্বামী প্রবর নিজের হাতে সংসার খরচের দায়িত্ব কুক্ষিগত করে রাখে, বাড়ির জিনিস ফুরিয়ে গেলে আনতে বললেই স্ত্রীর উপর চোটপাট, যেন স্ত্রীই জিনিসগুলো হাওয়া করেছে!

আমি একজন কর্মজীবী নারী বলেই হয়তো আমাকে এসব কথা কম শুনতে হয়। চাকরি করি বলে আমি যে আমার পরিবার পরিজনদের দেখভালে বা পরিবারের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যে অবহেলা করেছি এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। নিজে রোজগার করছি বলে পছন্দ অনুযায়ী খরচ করতে পারছি কোনো

জবাবদিহিতা ছাড়া, রোজগার করছি বলে সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আছে, সবচাইতে বড় কথা রোজগার করি বলেই সংসারে আমার মতামতের মূল্য একটু হলেও বেশি। পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্যে, দেশের অগ্রযাত্রায় আমার ভূমিকা রয়েছে। সর্বোপরি কারো মেয়ে, কারো স্ত্রী, কারো মায়ের বাইরেও আমার নিজের একটা

পরিচয় আছে ‘এমিলি’, যে পরিচিতি আমাকে আত্মতৃপ্ত করে। পাঁচ টাকা প্রয়োজন হলেও স্বামীর কাছে হাত পাততে হয় যে সক্ষম নারীদের, আমি তাদের দলে নই। অভিজ্ঞতার আলোকে এটা বলতে পারি কর্মজীবী নারীদের দায়িত্ববোধ, সহশীলতা, দক্ষতা, চিন্তাশক্তি, বিবেচনাবোধ ইত্যাদি অন্যান্য নারীদের চাইতে

বেশি বই কম নয়, মেধাও তুলনামূলক ধারালো হয় কর্মজীবী নারীদের কারণ তাদের মেধা অলস ভাবে পড়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাই বাইরে কাজ করার পরও ঘরে সমানভাবে তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে। মেধাবী হয়েও মেধাকে যদি কোনো কাজে না লাগায়, তাহলে তো সেই মেধায় জং ধরবেই!

আমাদের দেশে বেশিরভাগ মায়েদের পেশা ‘হাউজওয়াইফ’ হিসেবে উল্লেখ করতে হয়, যদিও এটা কোনো পেশা হতে পারে না বলে আমি মনে করি। অফিস টাইম নেই, বেতন নেই, ছুটিছাটা নেই, কাজের কোনো প্রশংসা নেই, তবে কেমন করে এটা পেশা হতে পারে? কথায় কথায় আমরা আবার বলেও থাকি, গৃহকর্ম হচ্ছে থ্যাংকলেস জব!

শুধু স্বামীর ইচ্ছাতেই নয়, মেয়েরাও স্বেচ্ছায় এই পেশাকে সানন্দে বরণ করে নিরানন্দে জীবন যাপন করার পথ সানন্দে বরণ করে নেয়। আমার জীবন আমি কিভাবে কাটাবো তার অধিকার অবশ্যই আমার আছে। নিরানন্দে বললাম বলে হয়তো অনেক হাউজওয়াইফের আবার ব্যথা লাগবে, তারা হয়তো বলবেন

‘আমরা যে নিরানন্দে আছি তা তুমি কিভাবে বল’? নিরানন্দে কথাটা একারণেই বলেছি, কারণ তারা নিজের উপার্জিত অর্থ হাতে আসলে তার যে আনন্দ, তা থেকে তারা বঞ্চিত। হতে পারে কোটিপতির স্ত্রী, কিন্তু নিজের উপার্জিত কিছুই নয়। হতে পারে স্বামীর রোজগারের সমস্ত অর্থ তার নিজ হাতে থাকে, নিজের

ইচ্ছামত খরচ করে, কিন্তু নিজের রোজগারের সামান্য অর্থ নিজের ইচ্ছায় খরচে যে আনন্দ তার স্বাদ থেকে তারা পুরোপুরি বঞ্চিত। আসলে আমাদের দেশের গৃহিণীদের এমনভাবে মানসিক দিক থেকে দুর্বল করে রাখা হয় যে, তাদের আত্মবিশ্বাস শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়ায়। তারা বুঝেই না যে ঘর থেকে বের হলে

তারা ঠিক কী কী কাজ করতে পারে। ঘর থেকে বের হলে তাদের চোখ খুলবে, দেখতে পাবে পৃথিবীটাকে অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজের দৃষ্টি দিয়ে। বাইরে কাজ করলে সে নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে যা জীবনে অনেক বড় অর্জন। তাছাড়া যদি উচ্চবিত্তদের বাদ দেই, এই যুগে একজনের রোজগারে পরিবারের

ভরণপোষণ, সন্তানদের লেখাপড়া চালানো সত্যিই দুষ্কর। দু’জনের রোজগার জীবনের চলার পথকে অনেকটা মমৃণ করে, জীবন হয় সুন্দর। মেয়েদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা বাইরে ঘরে সমানভাবে কাজ করে যাতে পারে, একসাথে একের অধিক বিষয়ে চিন্তা যেমন করতে পারে, একের অধিক কাজও করতে পারে। বাইরে কাজ করে ফিরে বেশ ভালোভাবেই সংসার সামলাতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবারের সাপোর্ট অস্বীকার করার উপায় নেই।

মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত নারীদের তুলনায় নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা অনেক বেশি। অথচ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পায়না নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েরা। আর উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও নিজের মেধাকে কোনো কাজে লাগাতে পারে না আমাদের দেশের বেশিরভাগ উচ্চ মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত

পরিবারের নারীরা। পরিবার এদের কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে কাজ করতে দিতে চায় না। এটাকেও আমি একধরনের অপরাধ বলবো। একজন ছেলে কিংবা মেয়ের শিক্ষার পেছনে মাবাবা, শিক্ষক শিক্ষিকার কতটা শ্রম দিতে হয়েছে, মাবাবার সাথে সাথে কিছুটা ব্যয়ভার রাষ্ট্রকেও বহন করতে হয়েছে। তাই লেখাপড়া শিখে ছেলেদের পাশাপাশি কাজ করে সে ঋণ শোধ করা আমাদের কর্তব্য।

আমার খুব অবাক লাগে, এখনো যখন দেখি ডাক্তারি পাস করা একটা মেয়ে স্বামীর ইচ্ছায় কখনো বা শ্বশুরবাড়ির ইচ্ছায় শুধুমাত্র সন্তান লালন, আর সংসার সামলে দিন কাটিয়ে দিচ্ছে। ভুরি ভুরি গ্র্যাজুয়েট মাস্টার্সও রয়েছে এই দলে। অসুস্থের সেবা, ঘর পাহারা, সন্তান লালন, বৌয়ের কামাই খাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি

অযুহাত দেখিয়ে আজও মেয়েদের চাকরি করা থেকে বিরত অথবা চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়! কিছু কট্টরপন্থী ধর্মীয় বিধিনিষেধের কারণ দেখিয়ে মেয়েদের বা বাড়ির বাইরে কাজ করতে দেয়া হয় না। শুধুমাত্র শিক্ষিত বর পাওয়ার আশায় অনেকে মেয়েকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে। মাবাবা যত শিক্ষিতই হোক না

কেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কারণে কিনা জানি না, ঘরে শিক্ষিত মাবাবা থাকার পরও প্লে নার্সারীর সন্তানকে গৃহশিক্ষক বা কোচিংয়ের সাহায্য নিতেই হয়! (এটা ফ্যাশনও হতে পারে না হলে এত ছোট বয়সে কি এমন হাতী ঘোড়া শেখাতে হয় যে, গৃহশিক্ষক বা কোচিংয়ের শরণাপন্ন হতে হয় বুঝি না) এমতাবস্থায়

মায়ের বেশিরভাগ সময় রান্না খাওয়ার জোগার আর বাচ্চাকে আনা নেয়ার কাজেই ব্যয় হয়। কাউকে কাউকে গাড়ি ভাড়ার কথা চিন্তা করে বাচ্চার সাথে সারাদিন কাটাতে হয়। গৃহকর্মে এতটাই ব্যস্ত থাকে যে বিশ্রামের অবকাশ নেই। অথচ আমরা যারা বাইরে কাজ করে তারা একটু প্ল্যান করে কাজ করে বলে

তারাও সবকাজ করতে পারে সাথে কিছুটা বিশ্রামও পায়। লেখাপড়া করে শুধুমাত্র গৃহকর্মে নিজের পুরো সময়টা দিয়ে নিজের মেধাকেই অপমান করা হয়। এই যে এখন কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলোতে রি ইউনিয়ন হয়, অনেক গৃহবধূ এগুলেতে অংশগ্রহণ করে না, সংকোচ বোধ করে। দেখেছি এদের মনে প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকা

সত্ত্বেও নিজের কোনো আলাদা পরিচিতি নেই বলে অংশগ্রহণ করতে লজ্জা পায়।

পরিবর্তন প্রয়োজন আমাদের মানসিকতার, সহযোগিতা প্রয়োজন আমাদের পরিবার পরিজনদের, আশেপাশে থাকা স্বজনদের। প্রতিটা শিক্ষিত নারী যেন উপার্জনক্ষম হতে পারে, নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে পারে, সময় অসময় সবসময় পরিবারের প্রতিটা প্রয়োজনে কন্ট্রিবিউট করতে পারে।

আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, আর এর অর্ধেক বা অর্ধেকের চাইতেও বেশি নারী। এই বিপুলসংখ্যক নারী যদি এগিয়ে না আসে, এদের হাতগুলোকে যদি কর্মীর হাতে পরিবর্তিত করা না যায় তাহলে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। আর কর্মজীবী নারীর সংখ্যা যদি বাড়ে তাহলে পরিবারের সাথে সাথে দেশও এগিয়ে যাবে অনেক দূর।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধকী উৎসবে কী বেদনায় বসন্ত ছুঁয়ে যায় সবার প্রাণে
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে