দূরের দুরবিনে

পজিটিভ দৃষ্টিকোণ, পজিটিভ বাংলাদেশ

অজয় দাশগুপ্ত | শুক্রবার , ৩ মার্চ, ২০২৩ at ৫:১২ পূর্বাহ্ণ

আমাদের তারুণ্য ও যৌবনে আমরা কলকাতা বেড়াতে গিয়ে অবাক হতাম। সে শহরের বড় বড় দালানকোঠা ছিল বিস্ময়। সে দেশের বাজারে তখন উপচে পড়তো আঙুর কলা আপেল সবজি। আমাদের ছিল তার বিপরীত চিত্র। মনে পড়ে কলকাতায় তখন আঙ্‌গুরের কেজি ছিল দশ টাকা। আর আমাদের দেশে ছিল একশ টাকা। সে একশ টাকা যোগাড় করা ছিল স্বপ্নের মতো। শুধু কি তাই? আমাদের দেশের বাজারে তখন এসব ফলমূল ছিল সোনার হরিণের মতো। আর আজ? নিন্দুকের চোখ বন্ধ। কিন্তু আমরা দেখি বাংলাদেশেই বরং বাজারে ফলমূল উপচে পড়ছে। সবুজ সবজির সমারোহ ওপার বাংলার মানুষদের ও চোখ ধাঁধিয়ে দেয় এখন। দাম বাজার আর প্রতিযোগিতায় কোথায় ও পিছিয়ে নাই বাংলাদেশ। কলকাতার তুলনায় অধিক সবুজ আর উন্নয়নে এগিয়ে আছি আমরা। এটা কে যারা মিথ্যা বা ভুল মনে করেন তাদের চোখে হয় ঠুলি নয়তো তারা কানা।

উন্নয়ন আর সমৃদ্ধি যে কোন দেশের মানুষের স্বপ্ন। আজকে সে স্বপ্ন আমাদের হাতের মুঠোয়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশ জয়রথে। নিন্দুক সমালোচকেরা যে যাই বলুক বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের তুলনামূলক আলোচনা করলেই আমরা পার্থক্য ধরতে পারব। অনেকে হয়তো জানেন পাকিস্তান এখন শেষ ধাপে ধুঁকছে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণে পাকিস্তান ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে আর বেশি সময় লাগবে না। সেখানকার মানুষরা একসময় বুক ফুলিয়ে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতো। এখন না কি তারা বলে, পাকিস্তান সে জিন্দা ভাগো। বেঁচে পালাও পাকিস্তান থেকে। এই করুণ পরিস্থিতি পাকিদের প্রাপ্য। কারণ সে দেশের অর্থনীতি নিয়ম মানে নি।

আমাদের ও অনেক দুর্বলতা আছে। সেগুলো আমরা জানি। কিন্তু আমাদের এও জানা উচিৎ বাংলাদেশ এখন সারা পৃথিবীতে সাড়া জাগানো অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে দ্রুতগতিতে অগ্রসরমান। ১৯৭২ সালের ৮০০ কোটি ডলারের ক্ষুদ্র জিডিপি এখন ৩৪৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি বেশ বড় অর্থনীতি। ১৯৭০৭১ অর্থবছরে সামষ্টিক আয়ে ছিল নেতিবাচক১২ শতাংশ সংকোচন। আর করোনার ছোবলের আগ পর্যন্ত বার্ষিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি শতকরা ৮ ভাগের উপরে বিরাজমান ছিল। মাথাপিছু আয়ে ১৯৭২ সালে ৮৫ মার্কিন ডলার এখন ২৫৫৪ মার্কিন ডলারে। সামষ্টিক আয়ের অনুপাত হিসাবে বহিঃবাণিজ্যে ১৯৭২ সালে শতকরা ২ ভাগের কম ছিল; এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৩৫ ভাগে। মোট সামষ্টিক আয়ে মাধ্যমিক খাতের অবদান ১৯৭২ সালে ছিল শতকরা ১৭ ভাগ তার মধ্যে শিল্পোৎপাদনের ছিল শতকরা ৮ ভাগ। করোনা পূর্ববর্তী সময়ে বার্ষিক সামষ্টিক আয়ে মাধ্যমিক খাতের অবদান ছিল শতকরা ৩৩ ভাগ (শিল্পোৎপাদনে শতকরা ১৮ ভাগ)

উন্নয়নের সূচক এখন কথা বলছে। অনেকেই মনে করে এসব সূচক না কি বানোয়াট। তারা ভোগবাদে বিশ্বাসী হবার পর ও এমন কথা বলে রাজনৈতিক কারণে। আসলে বাংলাদেশের চেহারায় যে পরিবর্তন তা অস্বীকার করার সাধ্য কারো নাই। বিগত এক দশকে সামাজিক ভাবে বাংলাদেশ এগিয়েছে। রাজনীতি সমপ্রদায়গত বিভেদ ধর্ম নিয়ে উস্কানী এসব বাদ দিলে দেশের মানুষের হাতে টাকা এসেছে। বিপুল না হলেও মধ্যবিত্ত হবার মতো জায়গায় পৌঁছে গেছে অনেক বড় এক জনগোষ্ঠী। কিন্তু লুটপাট টাকা পাচার ও অনিয়মের কারণে আরো অনেক পথ যাবার রাস্তাটা ক্রমেই সরু হয়ে উঠেছে বা উঠতে চাইছে ।

করোনা মহামারী পুরো পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। এই কঠিন সময়ে ও বাংলাদেশ হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে নি। আমাদের সমাজে লেখাপড়ার অভাব জ্ঞানের আকাল মারাত্মক। সহজ ছিল না মানুষকে টিকা দেয়ানো। সহজ ছিলো না ভ্যাকসিন দেয়ানো। তারপর ও সে কাজ সফল ভাবে হয়েছে। নিন্দুকেরা যাই বলুক বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু ও ঝুঁকি ঠেকাতে সরকারের উদ্যোগ ছিল প্রশংসনীয়। যে পজিটিভ বাংলাদেশের কথা আমরা বলছি তার অস্তিত্ব কিন্তু দৃশ্যমান উন্নয়নে বাঁধা নয়। এর বাইরে যে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তার কাছেই আছে মূল চাবিকাঠি। তারা মাঠে ময়দানে কল কারখানায় কাজ করে দেশকে সচল রাখেন। বছরের পর বছর হরতাল অবরোধ ও হাঙ্গামাবিহীন অর্থনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে সেটা দৈখার পর ও কি আমরা বিশ্বাস করবো না?

আমার ধারণা নারীশক্তির জাগরণই দেশের মূলস্তম্ভ। বাংলাদেশের অর্জনের চালিকা শক্তি যেমন শেখ হাসিনা তেমনি তাঁর মতো এ দেশের নারীরা ই আছেন অগ্রভাগে। নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে “জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা২০১১”। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে গৃহীত হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। প্রযুক্তি জগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মতো ইউনিয়ন ভিত্তিক তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও। “জাতীয় শিশু নীতি২০১১” প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দেশের ৪০টি জেলার সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেল। দুস্থ্‌, এতিম, অসহায় পথশিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নারী ও শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূষিত করা হয়েছে জাতিসংঘের সাউথসাউথ এওয়ার্ডে। পাকিস্তানের সাথে এই তফাৎ আমাদের অনেক এগিয়ে রেখেছে। যা এখন সে দেশের বুদ্ধিজীবীরা ও স্বীকার করে। পাকিস্তানের কথা বারবার বলছি এই কারণে এখনো দেশের জনগণের এক অংশ পাকি প্রেমে মশগুল। তাদের এই মানসিক অবস্থান আমাদের অর্থনীতিকে পিছিয়ে রাখছে। কারণ এরা মন ও মগজে বাংলাদেশী হতে পারে নি এখনো। এই জাতীয় অভ্যন্তরীণ অবরোধ না থাকলে আমাদের অর্থনীতি আরো এগিয়ে থাকতো।

বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ আর কাচের দেয়াল নয়। কেউ চাইলেই তাকে চুরমার করতে পারবে না। যতদিন কোন অপশক্তি তা রুখে না দেয় ততদিন সচল থাকবে এই যাত্রা। একটা কথা বলতেই হবে আমাদের দেশে অভাব আছে এখনো। বিশ্বের সাথে সাথে আমাদের দেশের বাজার এখন অশান্ত। দাম বাড়ছে হু হু করে। সাধারণ মানুষের কষ্ট ও বাড়ছে। এমন কঠিন বাস্তবতায় বাংলাদেশের উন্নয়ন ব্যাহত হলে দুঃখের সীমা থাকবে না। তাই রাজনীতির উচিৎ হবে কথা কমিয়ে ব্যয় কমিয়ে দেশকে ঠিক পথে রাখা। বিরোধীদের দায়িত্ব বিরোধিতা যৌক্তিক করে তোলা। কারণ সবার আগে দেশ আর দেশের মানুষ।

আমি তথ্য উপাত্ত দিয়ে লিখতে পছন্দ করি কম। কারণ এগুলো ধার করতে হয়। আর এসব বোরিং বিষয়। কিন্তু পজিটিভ বাংলাদেশ যেখানে আমাদের সবার দেশ ও দেশের বাংলাদেশীদের কাম্য সেখানে বারবার নেগেটিভিটি এসে আক্রমণ করে আমাদের। পথ লম্বা। পথ অসীম। আজ একদল কাল হয়তো আরেক। তার মানে এই না যে এদের সবকিছু অস্বীকার করতে হবে। বলতে হবে সব শেষ সব শেষ। বরং যে যতটা দিচ্ছে তাকে কেন্দ্র করেই এগুবে দেশ ও সরকার। দেশ সরকার জনগণের সাথে থাকবে চাই এটাই আমাদের চাওয়া। আজকের বিশ্ববাস্তবতায় নানা ধরনের প্রতিকুলতা মোকাবেলা করে ই সামনে যেতে হবে। কিন্তু সবার আগে পজিটিভ বাংলাদেশ। এই পজিটিভিটি যেন নষ্ট না হয়। তাহলেই আমাদের জয় অনিবার্য।

লেখক : কবিশিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধকুমিল্লার নানুয়া দিঘির সেই ইকবালের এক মামলায় সাজা