জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতাল চট্টগ্রাম বিভাগের একটি আদি মেটারনিটি হাসপাতাল। এই হাসপাতালটির জন্ম চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরও পূর্বে। বর্তমানে প্রায় প্রতিদিন চট্টগ্রামের এই হাসপাতালের বেডে জন্মের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে আগত শিশুর সংখ্যা ২০–৩০ জনের মত যাদের মধ্যে সিজারের চেয়ে নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। এখানে মেটারনিটি সেবার পাশাপাশি ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে স্বেচ্ছায় রক্ত দাতাদের নিকট হতে রক্ত সংগ্রহ করে যথাযথভাবে পরিসঞ্চালন করে নিরাপদ রক্ত সরবরাহ করা হয়, থ্যালাসেমিয়া ইউনিটের মাধ্যমে নামমাত্র মূল্যে হিমোফিলিয়া, থ্যালাসেমিয়া ও রক্তশূন্যতায় রক্ত ট্রান্সফিউশন করা হয় এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট এর মাধ্যমে ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ইন নার্সিং কোর্স ও ১৮ মাস মেয়াদী মিডওয়াইফারী কোর্স পরিচালিত হয়। নবজাতকদের স্বাস্থ্য সেবা, মেডিসিন ও ডেন্টালের ইউনিটের মাধ্যমে স্বল্প পরিসরে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়।
আমরা হয়ত অনেকেই জানিনা হাসপাতালটি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট কর্তৃক পরিচালিত একটি প্রকল্প মাত্র। তবে হাসপাতালটি তার সেবার মাধ্যমে তার মাদার সংগঠনকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে তা অনেক পূর্বের অসাধারণ সব অর্জনের গল্প মাত্র। ১৯৭৩ সালের পিও ২৬ নং এর আর্টিকেল ৭.৩ মূলে জেলা পরিষদ সমূহের চেয়ারম্যানগণ পদাধিকারবলে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট জেলা ইউনিটসমূহের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান জনাব এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম বিগত ২৮.১১.২০২২খ্রি. তারিখে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রথম সভার মাধ্যমে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কোনো আনুষ্ঠানিকতাও পরিলক্ষিত হয়নি। অনেকটা নিজে থেকে অনুপ্রবেশের মত করে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে প্রবেশ করতে হয়েছে চেয়ারম্যান মহোদয়কে। তার একাধিক বক্তব্যে উঠে এসেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জনাব ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, বীর চট্টগ্রামের অধিবাসী মাননীয় মন্ত্রিবর্গ, সম্মানিত সংসদ সদস্যবৃন্দ, পেশাজীবী নেতৃবৃন্দ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হতে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে নানা অভিযোগ শুনতে শুনতে তিনি ভীষণভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। তার অজ্ঞাতে ইউনিটের এজিএম হয়েছে। হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ময়লা ও আবর্জনার ভাগাড়, ওটি রুম, ওটি বেড, কেবিনগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা, ইলেকট্রিক কানেকশনগুলোরও বেহাল দশা। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দীর্ঘ ৭–৮ মাসের বেতন বকেয়া সবকিছু মিলে হতাশার অথৈই সাগরে নিমজ্জিত হওয়ার মত অবস্থা কিন্তু এরপরও তিনি হাল ছেড়ে না দিয়ে শক্ত হাতে ধরলেন নেতৃত্বের রশিটি।
প্রথমেই তিনি নিজেকে তুলে ধরলেন সকল স্টেকহোল্ডারদের মাঝে খুবই স্বচ্ছতার সাথে। তিনি শুরুতেই ঘোষণা করলেন তার জন্য বরাদ্দকৃত হাসপাতালের গাড়িটি তিনি ব্যবহার করবেন না, মোবাইল বিল বাবদ প্রাপ্য বরাদ্দ নেবেন না, সভায় অংশগ্রহণের জন্য সম্মানী নেবেন না, কোনো ধরনের আপ্যায়নের বিল নেবেন না। এখানে উল্লেখ্য চেয়ারম্যান পদের কোন সম্মানীও নেই। জেলা পরিষদ থেকে প্রায় ৪৪.০০ লক্ষ টাকা হাসপাতালের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ প্রদান করার মাধ্যমে তিনি জানান দিলেন, তিনি এখানে এসেছেন কিছু করার জন্য। কিছু নিলেন না অথচ দেয়া শুরু করলেন তার মাধ্যমে চেয়ারম্যান মহোদয়ের প্রতিষ্ঠানটির প্রতি দরদ সুপ্রতিষ্ঠিত হল।
এরপর হতে তিনি বারবার হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন। ইউনিটের এক্সিকিউটিভ কমিটির সভা করলেন, ডাক্তারদের সাথে মতবিনিময় সভা করলেন এবং যুব রেড ক্রিসেন্টের সাথে মতবিনিময় সভা করলেন। হাসপাতালে কর্মরত সকল কর্মকর্তা কর্মচারীর সাথে বিভাগ ভিত্তিক আলোচনা করলেন। হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগী এবং তাদের স্বজনদের সাথে নিয়মিত কথা বলে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির হেডকোয়ার্টারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলছেন বিভিন্ন জায়গায় ও বিভিন্ন পরিবেশে। এই সমস্ত উদ্যোগের মাধ্যমে হাসপাতালে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করতে সমর্থ হলেন। এর মধ্য হতে কিছু সমস্যা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন– হাসপাতালে প্রয়োজনের অধিক জনবল বিদ্যমান, গাড়ি ও জেনারেটরের জন্য তেল বাবদ অতিরিক্ত অর্থ অপচয়, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার অভাব, কিছু সংখ্যক ডাক্তারের রোস্টার অনুযায়ী উপস্থিতির ক্ষেত্রে বিলম্ব, কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নিয়মিত উপস্থিতির ক্ষেত্রে বিলম্ব, সভায় সম্মানী ও আপ্যায়নের নামে টাকা উত্তোলন, অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল, অনেক ক্ষেত্রে নগদে খরচ করা, নিয়োগ, পদোন্নতি, ও গ্রেড পরিবর্তনে স্বচ্ছতার অভাব, ওটি রুম, লেবার রুম, কেবিন ইত্যাদি ব্যবহার অনুপযোগী, নার্সিং ও মিডওয়াইফারী কোর্সে ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম, যাবতীয় ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব, নতুন প্রস্তাবিত ১৪ তলা ভবনের জায়গা নিয়ে মামলা ও নামজারীর নামে অনিয়ম, সফটওয়্যার ব্যবহারে অনিয়ম, এক্সরে মেশিন নষ্ট, ইলেকট্রিক সুইচ, ক্যাবলসমূহ বিপদজ্জনক অবস্থায় থাকা ইত্যাদি নানা সমস্যায় হাসপাতালটি জর্জরিত। সমস্যা চিহ্নিত করার পর্ব শেষ করে শুরু করলেন পরবর্তী অধ্যায়। চেয়ারম্যান মহোদয়ের দীর্ঘ রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা এবং সংশ্লিষ্ট সকলের মতামত ও পরামর্শ নিয়ে নেমে পড়লেন ইনিংস মেরামতে। এর কিছু উদ্যোগ নিয়ে আলোকপাত করা যাক–তিনি প্রায় প্রতিদিন হাসপাতালে গিয়ে আউটডোর ও ইনডোর রোগীদের সাথে কথা বলেন, হাসপাতালের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা হয়েছে, সকল প্রকার ব্যয়ের ক্ষেত্রে নগদ লেনদেন বন্ধ করা হয়েছে, ১৯৪ জন ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সার্ভিস বুকসমূহ তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন নেয়া হয়েছে, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা, রেজাল্ট জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন করা হয়েছে, ডাক্তারদের ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী ডিউটি নিশ্চিত করা হয়েছে, ইতোমধ্যে টাইম রিডিং মেশিন বসানো হয়েছে, গাড়ি এবং জেনারেটরের তেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে লগ বইয়ের ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বছরে ৪০ লক্ষ টাকা সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে, হাসপাতালের জন্য জেলা পরিষদ হতে ৪৪ লক্ষ টাকার মাধ্যমে ওটি ও লেবার রুমের যন্ত্রপাতি মেরামত, গেইট নির্মাণ, গ্রিল নির্মাণ, কেবিনসমূহ ও ফ্লোরে ইলেকট্রিক মেরামত, জেনারেটরে ওভার হোলিং করণ, কেবিনসমূহে সেনিটারি মেরামত, কেবিন ও বারান্দায় রংয়ের কাজ, কাঠের দরজা জানালা মেরামত, লোহার পেশেন্ট বেড মেরামত, বেবি কট ও বেড সাইড লকার মেরামত, কেবিনের জন্য বেডশীট, পর্দা, রাবার শীটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, হাসপাতালের রেট্রোফিটিংসের কাজ করা, নতুন প্রস্তাবিত জায়গায় মৌজার নামের ভুল ইতোমধ্যে উপযুক্ত আদালতের মাধ্যমে সংশোধন করা হয়েছে, নামজারী প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যাবতীয় ক্রয় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনায়ন করা হয়েছে, সকল সভার আপ্যায়ন ও সম্মানী বন্ধ করা হয়েছে, দৈনিক আয় ব্যয়ের প্রতিবেদন নেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, সকল ধরনের ডিসকাউন্ট বন্ধ করা হয়েছে, অক্সিজেন পরিবহনের নামে অপচয় রোধ করা হয়েছে, নার্সিং কলেজ, ব্লাড ব্যাংক, থ্যালাসেমিয়া ইউনিট এবং নতুন রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জঙ্গল সলিমপুর মৌজায় ৫.০০ একর জমি বরাদ্দ চেয়ে জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম বরাবর আবেদন করা হয়েছে, সকল ব্যয়ের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান মহোদয়ের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সকল ক্রয় প্রক্রিয়া পিপিআর এর আলোকে সম্পাদন করা হচ্ছে।
প্রথমদিকে যেখানে হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে চেয়ারম্যান মহোদয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়নে অনীহা পরিলক্ষিত হতো আজ ৯০ দিনের পথচলার পর একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় চেয়ারম্যান মহোদয়ের যেকোন নির্দেশনা অত্যন্ত আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে প্রতিপালিত হচ্ছে। রেড ক্রিসেন্ট আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছা শ্রমের একটি সর্বোচ্চ মানবিক সংগঠন। জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল চেয়ারম্যান মহোদয়সহ ইউনিটের সকল সদস্যের স্বেচ্ছাশ্রমে এবং ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সত্যিকারের একটি উপাসনালয়ে পরিণত হবে এবং এই হাসপাতালে মাতৃত্বের স্বাদ নেয়া সকল মায়েরা এবং তাদের আগত সন্তাদের জীবন হোক আরো অনেক অনেক সুন্দর জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম পরিবারের এই প্রত্যাশা থাকবে। জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতালের সাময়িক ঘন কালো মেঘ কেটে যেতে শুরু করছে। এখন শুধু এগিয়ে যাওয়ান পালা। পৃথিবীর সকল মাতৃত্ব হোক নিরাপদ এবং সকল সন্তানদের জন্ম ও জীবন হোক সুন্দর ও সার্থক।
লেখক: নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা পরিষদ, চট্টগ্রাম।