নানা ধরনের অপরাধে কিশোররা জড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধের পরিধিও বেড়েছে। কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর কারণ বেশ কিছু গবেষণা থাকলেও সেগুলোর প্রতি নজর বা তা থেকে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়ার আগ্রহ সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর নেই। আইন ও নীতিমালা থাকলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কিশোরদের মধ্যে পড়াশোনার চাপ ও আগ্রহ দুটিই কমে গেছে। এতে পাড়ায়–মহল্লায় চায়ের দোকানে কিশোরদের আড্ডা বেড়ে গেছে। এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে এলাকাভিত্তিক গ্রুপগুলো। তারা নিজেদের দল ভারী করতে এসব কিশোরকে দলে টানছে। এর মধ্য দিয়েই কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে মাদক–ইভটিজিং–ছিনতাইসহ নানা অপরাধে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে জড়িয়ে পড়ছে খুনোখুনিতেও।
গত রবিবার দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত ‘আড্ডাস্থলে আবার বেপরোয়া কিশোর, আধিপত্য বিস্তারের নামে জড়াচ্ছে অপরাধে’ শীর্ষক সংবাদে বলা হয়েছে, মাঝে কিছু দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড়, আটক করে অভিভাবকের জিম্মায় দেওয়া, আড্ডাস্থলে কান ধরে ওঠবস করানোসহ নানাবিধ উদ্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক বড় ভাইদের ‘আশীর্বাদের হাত’ মাথার ওপর থেকে সরে যাওয়ার কারণে বেপরোয়া কিশোর, উঠতি তরুণদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে সামপ্রতিক সময়ে আধিপত্য বিস্তারের জের ধরে কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় যেমন উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, একইভাবে নগরীর আড্ডাস্থলগুলোও উঠতি কিশোরদের দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। আড্ডাস্থলগুলোকে ঘিরে দিব্যি চলছে মাদক ব্যবসা, মাদক সেবন, কিশোর ও উঠতি বয়সী যুবকদের নিয়ে বড় ভাইদের রাজনৈতিক বৈঠক, স্কুল কলেজগামী ছাত্রীদের ইভ টিজিং, রাজনৈতিক গ্রুপিং ও এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তারের নামে রক্ত ঝরানো।’ উল্লেখ্য, সর্বশেষ গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টার দিকে নগরীর চকবাজার চমেক (চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ) ছাত্রাবাস সংলগ্ন চট্টেশ্বরী রোডে আধিপত্য বিস্তারের জেরে কিশোর গ্যাংয়ের একটি গ্রুপের সদস্যদের হামলায় প্রতিপক্ষের পাঁচজন আহত হয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য অনুযায়ী, চকবাজারের কিশোর গ্যাংয়ের নেতা রবিউল ইসলাম রাজুর নেতৃত্বে একদল কিশোর ধারালো কিরিচ, লাঠি, হকিস্টিক ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়। এদের মধ্যে জিকু নামে এক যুবককে মাটিতে ফেলে আঘাত করতে থাকে হামলাকারীরা। হামলার শিকার ও হামলাকারী উভয় গ্রুপ সরকার দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আজাদীর প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ, এমইএস কলেজ ক্যাম্পাস ও আশেপাশের এলাকায় বিভিন্ন গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিয়মিত চলছে অস্ত্রের মহড়া, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। গত এক বছরে উল্লেখিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অর্ধশতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবসে ফুল দেওয়াকে কেন্দ্র করে, আবার স্বরস্বতী পূজার আয়োজনে, র্যাগ ডে কিংবা ডিপার্টমেন্টাল কোনো অনুষ্ঠানে ‘পান থেকে চুন খসার’ আগেই শিক্ষার্থীদের শরীর থেকে ঝরে রক্ত। বিভাগের পিকনিক, প্রেমিকা বিষয়ক ঝামেলা, সালাম না দেওয়ার মতো তুচ্ছ বিষয়েও সহপাঠীর রক্ত ঝরাচ্ছে শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্ররা।
অপরাধবিজ্ঞানীরা বলেন, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা ও আইনের দুর্বল শাসন কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির কারণ। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আশ্রয়–প্রশ্রয়ে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির তুলনায় কিশোরদের আইন ভাঙার শাস্তি কম হওয়ায় একদল অসাধু ব্যক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাদের আশ্রয়ে গড়ে তুলছে কিশোর গ্যাং এবং তাদের দিয়ে সংঘটিত করাচ্ছে মাদক ব্যবসা, খুন, এমনকি মানব পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধ। সাধারণ মানুষের কাছে এখন আতঙ্কের নাম কিশোর অপরাধ। শহরে বা গ্রামে কিশোররা শিক্ষক কিংবা বয়স্ক কাউকেই তোয়াক্কা করে না। তামাকদ্রব্যের সহজপ্রাপ্যতা কিশোরদের অপরাধ জগতে শুরুটা করে দিচ্ছে। স্থানীয় রাজনীতি, পদ পদবির জন্য কিশোররা রাজনৈতিক নেতাদের অনুসারী হয়ে থাকে। এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্বে কিশোরদের ব্যবহার করা হচ্ছে।
যেখানে কিশোররাই হবে মানবতার অগ্রদূত, আমাদের দুঃখ, সেখানে তারা হয়ে উঠছে যমদূত। এদের নির্মূলে খুব দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের মনে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যা, ধর্ষণ ভীতি বাড়তেই থাকবে।
আমরা জানি, পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিশোর অপরাধ দমনে তৎপর রয়েছেন। রয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের নজরদারি। তবে কিশোর গ্যাংয়ের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। কিশোর অপরাধীদের তৎপরতা রোধে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি সময়ক্ষেপণ করা হয়, তাহলে এই দেশ অচিরেই অরাজক দেশে পরিণত হবে। তাই দেশকে বাঁচাতে কিশোর অপরাধ কঠোরভাবে দমন করা জরুরি।