নতুন বইয়ের ঘ্রাণ তো আছেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ছড়া, কবিতা, গান এবং কথামালার ছন্দ ও সুর। এ পাঁচের সম্মিলনে নতুন করে যেন প্রাণ পেয়েছে বইমেলা। গতকাল ছিল মেলার ১২তম দিন। বইমেলার মঞ্চে আয়োজন করা হয় ছড়া উৎসব। চট্টগ্রামের ছড়াকাররা ছন্দে ছন্দে মাতান সবাইকে। এরপর
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাইদের আয়োজনে ছিল গান, কবিতা ও কথামালা, যার আবেশ ছিল পুরো মেলা প্রাঙ্গণে।
বইমেলায় অংশ নেয়া বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার স্টলের বিক্রয়কর্মী এবং প্রকাশকরা জানিয়েছেন, মেলামঞ্চে কোনো আয়োজন থাকলে সেদিন পাঠক–দর্শনার্থী বাড়ে। লোক সমাগম বাড়ার সাথে সাথে বিক্রিও বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, যারা প্রকৃত পাঠক তারা মেলায় আসেন। আসতে না পারলেও
কোনো না কোনো মাধ্যমে বই সংগ্রহ করেন। এরপরও মেলামঞ্চে ভালো কোনো আয়োজন থাকলে তার টানে প্রকৃত পাঠকের পাশাপাশি অনেক দর্শনার্থী
আসেন। ভালো কোনো আলোচক থাকলে তার কথা শুনতে আসেন অনেকে। কেউ ছড়া–কবিতা বা সাংস্কৃতিক আয়োজন উপভোগ করতে আসেন। আবার যারা
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন তাদের স্বজন, বন্ধু–বান্ধবরাও আসেন। যারা ঘুরে দেখেন পুরো মেলা প্রাঙ্গণ। এর মধ্যে কোনো বই পছন্দ হলে কিনে নেন। এভাবেই বাড়ে বিকিকিনি। যদিও এবার মেলামঞ্চে প্রতিদিন আয়োজন থাকে না। এদিকে এবার প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা বইগুলোর
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কামরুল হাসান বাদলের নির্বাচিত কলাম সংকলন ‘স্বকালচিত্র’, জাতির পিতাকে নিবেদিত হাফিজ রশিদ খানের গদ্য ও কবিতার বই ‘লালঝুঁটি সেই রাতা’, আ. ফ. ম. মোদাচ্ছের আলীর গল্পগ্রন্থ ‘জয় বাংলা’, জাহেদ মোতালেবের শিশুদের গল্পগ্রন্থ ‘রামানুষ’, অমল বড়ুয়ার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘সমকালীন আধ্যান’ এবং রফিক আহমদ খানের ভ্রমণকাহিনি ‘মালায়ুর দেশে’।
এর মধ্যে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেককে ‘স্বকালচিত্র’ উৎসর্গ করেছেন কামরুল হাসান বাদল। স্বকালচিত্রে স্থান পাওয়া সমকালকে ধরে রাখার কলামগুলো ভবিষ্যতে আজকের পরিস্থিতিকেই উন্মোচন করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ফ্ল্যাপে লেখা আছে, কামরুল হাসান বাদলের লেখার বিষয় বিচিত্র।
তিনি সমসাময়িক বিষয় নিয়েই লিখতে পছন্দ করেন। দেশের রাজনীতি, বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য, স্থানীয় ও জাতীয় সমস্যা ইত্যাদি তাঁর কলামে উঠে এসেছে। দেশ যখন দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা, কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কারে নিমজ্জমান তখন সেসবের বিরুদ্ধে তাঁর
নির্ভীক লেখনী সোচ্চার থাকে। তিনি সত্য উচ্চারণে কখনো দ্বিধাগ্রস্ত হননি। যেখানে মানবতার অপমান, যেখানে অবিচার, তিনি সেখানে প্রতিবাদে উচ্চকণ্ঠ থেকেছেন। তাই তিনি দেশের সামপ্রদায়িক–মৌলবাদীগোষ্ঠীর কাছে কট্টর আওয়ামী লীগার, আওয়ামী লীগের কাছে কমিউনিস্ট, কমিউনিস্টদের কাছে বুর্জোয়া
আর বুর্জোয়াদের কাছে ফকির–মিসকিন হিসেবে বিবেচিত। আসলে তাঁর কোনো দল নেই, মঞ্চও নেই। তিনি সাধারণ মানুষের। বঞ্চিত মানুষের।
‘জয় বাংলা’র ফ্ল্যাপে লেখা আছে, দেশ, মাটি, মানুষের লেখক আ. ফ. ম. মোদাচ্ছের আলী। তাঁর মধ্যে দেশপ্রেমের প্রাবল্য মুগ্ধ করে। যে স্লোগান দিয়ে আমরা প্রতিটি যুদ্ধজয়কে স্মরণীয় করেছি সেই জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা’। ছোটদের জন্য এই শিশুতোষ গল্পগ্রন্থটি লেখকের মুক্তিযুদ্ধকালীন শৈশবের স্মৃতিময়
ঘটনার অনুরণন, জীবন থেকে নেয়া। এই ধরনের ইতিহাসভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের লেখা শিশুকিশোরদের জন্য যত বেশি লেখা হবে রণাঙ্গনের যোদ্ধারা প্রাণিত হবে।
দৈনিক আজাদীর চিফ রিপোর্টার হাসান আকবরের ভ্রমণকাহিনি ‘দূরের টানে বাহির পানে’ বেরিয়েছে ২০১৯ সালে। এবারের বইমেলায় বলাকা প্রকাশনার স্টলে পাওয়া যাচ্ছে বইটি। বইটি ঘিরে এবারও পাঠকের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। হাসান আকবরের ভাষায়, ‘দূরের টানে বাহির পানে’
কোনো সাহিত্য নয়, নিছক ভ্রমণকাহিনি। বইটির লেখাগুলো তাঁর আমেরিকা, মেক্সিকো এবং ইংল্যান্ড সফরের উপরের রচিত। এসব দেশে ঘুরতে গিয়ে যেখানে যা দেখেছেন তা সরলভাবে তুলে ধরেছেন। সাংবাদিকদের অন্তর্দৃষ্টি নয়, সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রকাশের চেষ্টা করেছেন লেখক।
অমল বড়ুয়ার সমকালীন আধ্যানের ফ্ল্যাপে লেখা আছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অতুলনীয় ক্রমবিকাশের এ সময়েও মানবজাতিকে ভাবাচ্ছে পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের মতো নেতিবাচক বিষয়াবলী। এর সাথে যুক্ত হয়েছে মানবিক বিপর্যয়, বৈষম্য ও বাস্তুচ্যুতির মতো ঘটনা। দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে
বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতি। আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় উন্নতি ও প্রগতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও দুর্নীতি এখনো জবাবদিহিতা, সুশাসন ও শুদ্ধাচারের পথের কাঁটা। অবিরাম ঘটমান এরকম ঘটনা–প্রবাহ থেকে উৎসারিত দেশ–কাল–সমাজ ভাবনার মেলবন্ধন ‘সমকালীন আধ্যান’।
ছড়া উৎসব : ছড়া উৎসবে প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক পূর্বকোণের পরিচালনা সম্পাদক জসিম উদ্দীন চৌধুরী। বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি রাশেদ রউফের সভাপতিত্বে ছড়া পাঠ করেন এমরান চৌধুরী, আ. ফ. ম মোদাচ্ছের আলী, অরুণ শীল, আখতারুল ইসলাম, ফারজানা রহমান শিমু, মিজানুর রহমান
শামীম, সৌরভ শাখাওয়াত, গোফরান উদ্দীন টিটু, কেশব জিপসী, অমিত বড়ুয়া, মর্জিনা আখতার, সনজিত দে, তালুকদার হালিম, নিশাত হাসিনা শিরীন, আজিজ রহমান, উৎপল কান্তি বড়ুয়া, জুবাইর জসীম, ইসমাইল জসীম, সাইফুল্লাহ, আবুল কালম বেলাল, কাঞ্চন চক্রবর্তীসহ ৫০ জন ছড়াকার।