চাকরির প্রলোভনে নারী নির্যাতন চলছে সমানে। উন্মোচন হয়েছে মানব পাচার চক্রের প্রতারণার একটি ফাঁদ। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক সংবাদে বলা হয়েছে, নামে রিক্রুটিং এজেন্সির লোক হলেও মূলত ওরা মানব পাচার চক্রের সদস্য। তাদের টার্গেট বেকার নারী। মধ্যপ্রাচ্যে ভালো বেতনে চাকরির
প্রলোভন দেখিয়ে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে বিদেশে লোক পাঠায়। সেখানে নিয়ে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে ভুক্তভোগী নারীরা যোগাযোগ করেন তাদের স্বজনদের সঙ্গে। কোনো উপায় না দেখে স্বজনরা যোগাযোগ করেন নামধারী সেই রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে। ভুক্তভোগীকে দেশে
ফিরিয়ে আনতে সহায়তা চান। এ সময় চক্রের সদস্যরা ভিকটিমকে দেশে ফিরিয়ে আনার বিনিময়ে আরও তিন লাখ টাকা দাবি করেন। চাহিদামতো টাকা দিতে না পারলে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন স্বজনদের সঙ্গে। এভাবেই প্রতারণার মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল চক্রের সদস্যরা। এ ধরনের দুটি চক্রের সাত
সদস্য ধরা পড়েছে এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) জালে। র্যাব–৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ পত্রিকান্তরে জানান, এক শ্রেণির ভুয়া রিক্রুটিং এজেন্সির টাকা আয়ের মূল উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নারী পাচার।
প্রতারিত ভিকটিমের স্বজনরা আমাদের কাছে প্রায়ই এ ধরনের অভিযোগ করছেন। সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাবের খিলগাঁও ক্যাম্প ১৩ ফেব্রুয়ারি একটি চক্রের পাঁচজনকে গ্রেফতার করে। বৃহস্পতিবার রাতে র্যাবের টিকাটুলি ক্যাম্প দুজনকে গ্রেফতার করে।
মানব পাচার এমন এক বৈশ্বিক সমস্যার নাম, যার শিকার আমাদের দেশের অগণিত নারী–পুরুষ। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের মতো দেশগুলো এ সমস্যার নিত্যকার শিকার। সমপ্রতি দেশে মানব পাচার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছেছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এ ছাড়া এমন
ঘটনা পুরোপুরি থামাতে না পারা এবং মানব পাচারসংক্রান্ত মামলাগুলোর জট ছাড়াতে না পারায় আন্তর্জাতিক চাপেও রয়েছে দেশ। আমরা মনে করি, সৃষ্ট পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে মানব পাচার রোধে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মানব পাচার এবং অভিবাসী চোরাচালান কেবল একক প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দ্বারা প্রতিরোধ করা যাবে না। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মানব পাচারকে একটি জঘন্য অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এবং এই অপরাধকে মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার মানব পাচার
প্রতিরোধ ও দমন আইন–২০১২ প্রণয়ন এবং ২০১৭ সালে এর অধীনে বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। সাত বিভাগীয় শহরে সাতটি মানব পাচার ট্রাইব্যুনাল স্থাপন করেছে। পাশাপাশি মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ২০১৮–২০২২ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাও উক্ত আইন বাস্তবায়নে যথাযথভাবে কাজ করছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মানব পাচার রোধে কাজ করা হচ্ছে। আমরা জানি, বাংলাদেশ সরকার এই ঘৃণ্য অপরাধ প্রতিরোধে সক্রিয় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। পাচারকারীদের প্রতিরোধ ও তাদের বিচার নিশ্চিতে এবং পাচারের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষায় আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদার করা হয়েছে।
মানব পাচারকে একটি ভয়ানক অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের এ ভয়ংকর প্রবণতা বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্রকে আরও কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত দেশের ভেতরেই কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, যাতে পাচারকারী চক্র বেকারদের প্রলুব্ধ করার সুযোগ না
পায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রবৃদ্ধিমুখী উন্নয়নকে কর্মসংস্থানমুখী করতে হবে। তবে মানব পাচার রোধে সবচেয়ে জরুরি যে কাজ সেটি হলো পাচারকারীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা। যারা মানব পাচারে সহায়তা করবেন, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। মানব পাচারের বিচারহীনতা রোধে হাইকোর্টের নিবিড়
তদারকি দরকার। নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালকে মানব পাচার মামলা নিষ্পত্তির এখতিয়ার দেওয়া হলেও ট্রাইব্যুনালগুলোকে অনেক সময় সব ধরনের মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এর অবসান দরকার।







