রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে বিশ্বে জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। এতে জ্বালানির মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। বাড়তি দামে জ্বালানি আমদানি করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশ আর্থিক সংকটে নিপতিত হয়। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে জীবন যাত্রা কঠিন হয়ে পড়ে। রিজার্ভের সংকটে পড়ে বিভিন্ন দেশ। সারা বিশ্বে একটি অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনি শোনা যায়। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিও হুমকির মুখে পড়ে। অর্থনৈতিক মন্দার মুখে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ বিভিন্ন দাতা সংস্থাসহ আইএমএফ বিশ্বব্যাংক ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক তহবিলের দারস্থ হয়।
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ঋণের শর্ত হিসাবে বাংলাদেশের আর্থিক খাতে সংস্কারের তাগিদ দেয়। ব্যয়, কৃচ্ছতাসাধন ও ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দেয়। সে জন্য সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃচ্ছতা সাধনের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে উচ্চ মূল্যের জ্বালানি বিশেষ করে তেল আমদানি করতে গিয়ে সরকার বেশি বেকায়দায় পড়ে যায়। তবে সময়মত সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে এক্ষেত্রে আরেকটু সাশ্রয়ী হওয়া যেতো, যদি আমরা পরিশোধিত তেল আমদানি না করে অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে পারতাম। কিন্তু সেটি সম্ভব নয় কারণ আমাদের জ্বালানি তেল পরিশোধন করার সক্ষমতা হলো চাহিদার এক চতুর্থাংশ। ফলে দেশে জ্বালানি তেল পরিশোধনের পর্যাপ্ত সক্ষমতা না থাকায় বেশি পরিমাণে পরিশোধিত তেল বিশেষ করে ডিজেল আমদানি করতে হয়। এতে প্রতিবছর বাড়তি লাখ লাখ ডলার খরচ করতে হয়। তবে সরকার এখন চাপে পড়ে জ্বালানি সাশ্রয়ে আমদানি কমানোর চেষ্টা করছে। অথচ গত ৫০ বছরেও দেশে তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ায় নি। এরমধ্যে সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একটি প্রকল্প নেওয়া হলেও গত ১০ বছরেও প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়নি। বর্তমানে বছরে জ্বালানি তেলের চাহিদা ৬৫ লাখ টন। উৎপাদন সক্ষমতা হলো মাত্র ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে গ্যাসের উপজাত হিসেবে দেশি গ্যাসক্ষেত্রে পাওয়া কনডেনসেট ও আমদানি করা ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) পরিশোধন করে জ্বালানি তেল উৎপাদন করা হয়। তবে শোধন সক্ষমতা না বাড়ায় ডিজেল ও ফার্নেস তেলের মতো পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি বাড়ছে প্রতিবছর।
এদিকে গত অর্থবছরে ৬৫ লাখ টন জ্বালানি তেল বিক্রি করেছে বিপিসি। এর মধ্যে ৪৬ লাখ টন ডিজেল। দেশের একমাত্র শোধনাগারটি থেকে পাওয়া গেছে মাত্র ৬ লাখ টন ডিজেল, বাকিটা আমদানি করতে হয়েছে। বিপিসি ও ইআরএল সূত্র বলছে, অপরিশোধিত তেল এনে ডিজেল উৎপাদন করা হলে ১ ব্যারেলে (১৫৮ দশমিক ৯৯ লিটার) সাশ্রয় করা যায় ১১ ডলার। তার মানে ডলারের বর্তমান আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার ধরে হিসাব করা হলে প্রতি লিটার ডিজেলে সাশ্রয় হবে ১০ টাকা। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,বর্তমানে বিশ্ব বাজারে ডিজেলের যে দাম,এ অবস্থায় দেশে পরিশোধন করা হলে লিটারে ১৫ টাকার বেশি সাশ্রয় করা সম্ভব। নতুন পরিশোধনাগার চালু হলে উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৪৫ লাখ টনে। এতে বছরে সাশ্রয় করা যাবে ২৪ কোটি ডলার। ৪ বছর ৯ মাসে উঠে আসবে বিনিয়োগ। অথচ এখন বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেই দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতা বাড়াতে ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল–২’ নামের প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১২ সালে। এরপর উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) ১০ বার সংশোধন করা হয়েছে। এতে ব্যয় বেড়েছে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে এটি পরিকল্পনা কমিশনে জমা আছে। দেশে একমাত্র সরকারি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) নির্মাণ করা হয় ১৯৬৮ সালে। বিপিসির মাধ্যমে আনা অপরিশোধিত জ্বালানি তেল শোধন করে তারা। উৎপাদিত ডিজেলসহ বিভিন্ন জ্বালানি তেল নেয় বিপিসি। আগেই বলেছি ইআরএলের বছরে তেল শোধনের সক্ষমতা ১৫ লাখ টন। ইআরএল–২ প্রকল্পের আওতায় নতুন পরিশোধনাগারের সক্ষমতা হবে ৩০ লাখ টন। প্রকল্পটি মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিলে ঠিকাদার নিয়োগে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। ঠিকাদার নিয়োগের পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে শোধনাগারটি স্থাপন করবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো,সময়মতো ইআরএল–২ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতো না। পরিশোধন সক্ষমতার সঙ্গে মজুতক্ষমতাও বেড়ে তিন গুণ হতো। এতে উচ্চ মূল্যে জ্বালানি তেল আমদানি না করে পরিস্থিতি বুঝে অপেক্ষা করার সুযোগ পেত বিপিসি। তবে শুধু ইআরএল–২ নয় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে এরকম ২ টি প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারন নতুন দুইটি প্রকল্পে শোধন করা যাবে ৬০ লাখ টন অপরিশোধিত তেল। যা দেশের সম্পূর্ণ চাহিদা মিটাতে সাহায্য করবে। আর যদি দেশের চাহিদা নাও বাড়ে, তবে অপরিশোধিত তেল শোধন করে পেট্রোল ডিজেল অকটেন বিদেশে রপ্তানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে। যা দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করতে সাহায্য করবে। মনে রাখতে হবে আমাদের পাশ্ববর্তী দেশ ভারত সহ বিশ্বের বহু দেশ অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে রপ্তানি মাধ্যমে লাখ লাখ ডলার আয় করে।
বিপিসি ও ইআরএল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান পরিশোধনাগারটি নির্মাণ করেছিল ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান টেকনিপ। নতুন পরিশোধনাগারটিও তাদের মাধ্যমে করার নীতিগত অনুমোদন দেয় সরকার। কারিগরি নকশা তৈরি করতে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে টেকনিপের সঙ্গে চুক্তি করে বিপিসি। নকশা তৈরি করতে তিন বছর সময় নেয় টেকনিপ। একই সময়ে টেকনিপ ও বিপিসির মধ্যে সমঝোতা চলে। পরিশোধনাগার নির্মাণের পর চালু করার আগেই দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল টেকনিপ। এমন শর্ত মানতে রাজি নয় বিপিসির পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া অন্যান্য কিছু শর্তের বিষয়েও আপত্তি ছিল বিপিসির। এতে কাজটি করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে চলে যায় টেকনিপ।
জানা যায়, ১০ দফা ডিপিপি সংশোধনের মাধ্যমে বর্তমানে ইআরএল–২ বাস্তবায়নে খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। শুরুতে এটি ছিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। চালুর পর মাত্র ৪ বছর ৯ মাসের মধ্যে এ টাকা উঠে আসবে বলে ডিপিপিতে বলা হয়েছে। তবে শুরু থেকে বিনিয়োগ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। বিদেশি অর্থায়নের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। এরপর সরকারের অর্থায়নের অপেক্ষায় কেটে যায় আরও কয়েক বছর। এখন বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। গত ১০ বছরে প্রকল্পটি জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসির মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে। এবার পরিকল্পনা কমিশনে গেছে।
শীঘ্রইএটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের জন্য তোলা হবে বলে জানা গেছে। জ্বালানি তেল পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে ডিপিপি বলছে, বর্তমানে দেশের পেট্রোলিয়াম পণ্যের মাত্র ২০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে ইআরএল। দেশে প্রতিবছর জ্বালানি তেলের চাহিদা বাড়ছে। ২০২৬–২৭ অর্থবছরে চাহিদা ৮০ লাখ টন ছাড়াতে পারে। আমদানি করা জ্বালানি তেলের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করতে হলে দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হবে। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা যাবে না। জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তাই দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ইআরএল–২ প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট












