হেগি থ্রি- অদ্ভুত এক সাইন-অন

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

১৯৮৮ সালের নভেম্বর মাস। আমি খুব ফুরফুরে মন নিয়ে উড়ছি। তৎকালীন অনিশ্চয়তার চাকরির বাজারে, খুবই অভাবনীয়ভাবে একটা ভালো অফার পেয়ে, দশ মাসের কন্ট্রাক্ট শেষে দেশে ফিরেছি মাত্র। সেই কোম্পানিতে আগামীতেও কন্ট্রাক্ট করতে থাকলে, ভালই ইনকামের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সেসময়ে, আমিই প্রথমদিকের একজন, বিদেশি জাহাজে কাজ পেয়েছিলাম। সেই জাহাজ, মিস্ট্রাল (Mistral ) সম্পর্কে আগে লিখেছি। অনেকদিন পরে দেশে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, গল্পগুজবেই দিন কাটছিলো। আমার সবচেয়ে বড়ভাই, ডাঃ মামুনের তখন একটা মোটরসাইকেল ছিলো। প্রায়দিন সকালেই আমি আর উনি সেটায় চড়ে আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে মেডিক্যাল কলেজে ওনাকে নামিয়ে, আমি মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যেতাম আগ্রাবাদে মেরিনারদের অফিস আর আস্তানায়। একদিন এরকমই মেরিন অফিসার্স এসোসিয়েশানের আগ্রাবাদ অফিসে বসে গল্প করছি, হঠাৎ একজন সেখানে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে রেফায়েতকে মোনেম সার খুঁজছে। আমরা মেরিনরা খুবই ক্লোজনিট কমিউনিটিসকলে খুবই ঘনিষ্ঠ। একে অন্যকে খুবই ভালমত চিনিজানি। একাডেমিতে আমার তিন বছরের সিনিয়র, চিটাগাং কলেজে আমার ভাইয়ের বন্ধু মোনেম সার আমাকে স্নেহ করতেন। কোথায় তিনি? উনি হেগি থ্রি (Hegge Three ) জাহাজের সেকেন্ডইঞ্জিনিয়ার।

একজন মেরিনার জাহাজে যোগ দিলে বলে ‘সাইনঅন’; আর স্বভাবতই কয়েকমাস পরে কাজ শেষে ফিরে আসাটাকে বলে “সাইনঅফ”। একটা কোম্পানিতেই যদি বছরের পর বছর থাকি, কোম্পানিই সাইনঅন/অফের সময় হিসাব করে ডাকবে; সেজন্যে একটা কোম্পানিতে থাকাটাই শ্রেয়। তাতে করে কোম্পানিতে সুনাম থাকবে, পদোন্নতিতে অগ্রাধিকার ও আরো অনেক সুবিধা। ’৮০-’৯০ এর শতকে ইচ্ছা করলেই, মাঝেমাঝেই কোম্পানি বদলাতাম। নানান কারণেভালো অফার পেলে, পদোন্নতি পেলে বা যেই ধরনের জাহাজ চাইছেন (ট্যাঙ্কার বা কন্টেইনার) সেগুলো বিবেচনা করে। এগুলো মূলত প্রাইভেট কোম্পানির জন্যে প্রযোজ্য। সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি (বিএসসি) হলে অবশ্য অন্য কথাএখানে সরকারি কর্পোরেশানের রুল্‌স্‌। তবে, প্রাইভেট বা সরকারি যেই কোম্পানিই আপনাকে সাইনঅন বা অফ করাবে, তারা আপনার বাসা থেকে জাহাজ পর্যন্ত যাওয়াআসার খরচ বহন করবে। জাহাজ দুনিয়ার যেই পোর্টে আছে, কোম্পানিই আপনাকে সেখানে নিয়ে যাবে। বিএসসি বা বাংলাদেশী মালিকানাধীন জাহাজগুলোর ক্ষেত্রে অধিকাংশই সাইনঅন/অফ হতো চট্টগ্রামে বা মংলায়।

পাসপোর্টের মতই আরেকটা ডকুমেন্ট থাকে, নাম CDC (Continuos Discharge Certificate); জাহাজে যোগদানের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যেই সাইনঅন/অফের তারিখ, পোর্টের নাম ইত্যাদি পূরণ করে ক্যাপ্টেনের সাইন থাকে। প্লেনেও এই সিডিসির বদৌলতে কিছু সুবিধা ভোগ করি বেশী লাগেজ নিতে পারি। কারণ আমরা কয়েক মাসের জন্যে জাহাজকে বাসা বানাতে চলেছি, সঙ্গে তো অনেক মালপত্র থাকবেই। আজকাল দোহা এয়ারপোর্টে সিডিসি দেখিয়ে মেরিনার্স লাউঞ্জের বিশেষ সুযোগসুবিধা পাওয়া যায়।

যাক, এত পাঁয়তারা করলাম, হঠাৎ টপিক বদলে এত কথা বললাম কেন বুঝবেন একটু পর। মোনেম সার হেগি থ্রি জাহাজের সেকেন্ডইঞ্জিনিয়ার, খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ। সেখানে তিনি কোনো মনমতো ফোর্থইঞ্জিনিয়ার না পেয়ে, আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজছেন। আমি দোটানায় পড়লাম ভালো বৃটিশ কোম্পানিতে কাজ করে ফিরেছি; এবং সেখানেই আবার যাবো সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, আবার এদিকে সার একটু বেকায়দায় পড়েছেনআমারও একটু দায়িত্ববোধ আছে, তাইনা? বেশী কিছু চিন্তা না করে, আমার মেরিনার বন্ধু বল্টুকে মোটরসাইকেলে নিয়ে পোর্টের দিকে রওনা দিলাম। ড্রাইডক পার হয়ে দেখি, মুরিংজেটি থেকে জাহাজটার দড়িদাড়া মাত্র খুলে, রওনা দিচ্ছে। ইঞ্জিনের প্রপেলার একবার কি দুইবার ঘুরেছে মাত্র। আর জেটিতে দাঁড়ানো জাহাজের এজেন্ট ও অন্যান্য লোকদের মাঝে জাহাজের মালিক স্বয়ং জিন্নাহ্‌ সাহেবও রয়েছেন। সরাসরি ওনাকে গিয়ে বললাম, আপনার জাহাজে নাকি ফোর্থইঞ্জিনিয়ার লাগবে। দু’তিন সেকেন্ড উনি হতবাক তাকিয়ে থেকে, জিজ্ঞেস করলেন কেন, আপনি পারবেন? আমি নিজের সার্টিফিকেটকোয়ালিফিকেশান বললাম। উনি বললেন সঙ্গে সিডিসি, সার্টিফিকেট, কাগজপত্র আছে? আমি হ্যাঁসূচক মাথা নাড়তেই উনি বললেনজাহাজ থামাও, জাহাজ ফিরাও। জাহাজ ততক্ষণে কর্ণফুলির মাঝনদীতে। ওয়াকিটকিতে ক্যাপ্টেন ও পাইলটের সঙ্গে কথা বলে জাহাজ ফেরত আনার ব্যবস্থা করা হলো। এর মাঝে দেখি জাহাজ থেকে মোনেম সার উঁকি দিয়ে আমাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে হাত নাড়ছেন।

আমি বল্টুকে বললাম দোস্ত, এই মোটরবাইকটা আমার ভাইকে ফেরৎ দিস্‌। সে বলে, আমি তো এটা চালাতে জানি না। হায়! হায়! এখন কী হবে? ড্রাইডকের কাছের এই মুরিংবয়া জেটি থেকে কীভাবে সে এটা আমার ভাইকে ফেরত দিবে? তখনকার দিনে মোবাইল তো ছিলই না, ল্যান্ডফোনও তো সবখানে পাওয়া যেতো না। তারপরেও তার হাতে বাসার ফোন নাম্বার ধরিয়ে দিয়ে, একটা নৌকায় উঠে বসলাম। সেটা আমাকে নিয়ে হেগি থ্রিতে তুলে দিলো, এবং জাহাজ যেই আনাড়ি ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে রওনা দিয়েছিলো, সেই বেচারাকে নামিয়ে নিলো। আমি এক কাপড়ে উঠে গেলাম, পরবর্তী গন্তব্য সিংগাপুর।

সকালে ব্রেকফাস্ট করেছিলাম বাবামা বড়ভাইয়ের সাথে বাসাতেই। এখন সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে দুপুরে লাঞ্চ করবো, জাহাজে বঙ্গোপসাগরে আর রাতের ডিনার করবো সিঙ্গাপুরের পথে। আমার পরনে কিন্তু একটাই কাপড়। জাহাজেরও সকলেই সারপ্রাইজ্‌ড্‌ এবং শক্‌ড্‌; এইভাবে কাউকে কোনদিন জাহাজে জয়েন করতে দেখে নাই। জিন্নাহ্‌ সাহেব ক্যাপ্টেনকে জানিয়ে দিয়েছেনকোনো দুশ্চিন্তা নাই; ওনার প্রভাব খাটিয়ে, শিপিংঅফিস থেকে আমার সাইনঅন জনিত সব কাজ করিয়ে নিবেন। আমি তো আমাকে নিয়ে চিন্তা করছিলাম না; আমার দুশ্চিন্তাপল্টুটা বড়ভাইয়ের মোটরসাইকেল নিয়ে কী করবে?

যাক, জাহাজে উঠার পরে, রিফিউজির মত সকলে ইমার্জেন্সিবেসিসে আমাকে কাপড়চোপড় দান করলো। জিন্নাহ্‌ সাহেবকেও আব্বার নাম্বার দিয়েছিলাম; উনি আব্বাকে খুবই ভালো চিনেন। উনি জানালেন, জাহাজ পৌঁছালে উনিও প্লেনে সিঙ্গাপুরে আসবেন। তখন আমার জন্যে কাপড়চোপড় নিয়ে আসবেন। এবং করেওছিলেন তাই।

অন্যদিকে, কাজের কথায় আসি। মোনেম সার নিজে খুবই স্মার্ট এবং পারদর্শী ইঞ্জিনিয়ার। আমরা দুইজনে মিলে জাহাজটাকে ভালোমতই চালিয়েছিলাম। বর্তমানে হেগি কোম্পানি নাই, তখন সেই একটা জাহাজ দিয়েই চলতো। খুবই পুরাতন, লক্কড়ঝক্কর মার্কা জাহাজ। কিন্তু, আমাদের কিচ্ছুই আসে যায় না। সাউথ চায়না সী বা অন্যান্য অনেক জায়গাতেই বেশ কয়েকবারই ভালই ঝড়তুফানে পড়েছিলাম। কিন্তু, মেরিনারদের কাছে সেগুলো কিছুই না। জাহাজ চলবেই; আমরা সেটাকে চালিয়ে নিয়ে যাবই। সেই জাহাজে আমি দুইটা ভয়েজ করেছিলাম। মানে চট্টগ্রাম থেকে একবার রওনা দিয়ে সারা সাউথ এশিয়া ঘুরে চট্টগ্রামে ফিরে এসে; আবারো প্রায় একই রুটে আরেকবার চলেছিলাম। সিংগাপুর, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং, কোরিয়া, জাপানএ সমস্ত দেশগুলো। জাহাজে আমি থার্ডইঞ্জিনিয়ার প্রমোশানও পেয়েছিলাম।

দুইটা ঘটনা এখনো খুব মনে আছে। তখন, হঠাৎ করে অবৈধভাবে মালেশিয়া ও জাপানে অনেক বাংলাদেশী যেত। আমরা ব্যাঙ্ককে দেখতাম দলে দলে বাংলাদেশী ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাঙ্ককের বিশাল এক শপিংমলে দেখি, একজন তার কন্টাক্টপার্সনকে হারিয়ে ফেলে, প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তার বিদেশের মাটিতে এই প্রথম, ইংরেজি পারে না, ঠিকানা জানে না, কই যাবে জানে না, দরদর করে ঘামছে। আমরা অনেক বুঝিয়ে, পানি, সফটড্রিংকস খাইয়ে, সান্ত্বনা দিয়েছিলাম। মাসখানেক পরে ’৮৯ সালের জানুয়ারিতে জাপানের পোর্টে বসে বসে টিভিতে দেখি প্রায় দুইতিনশ’ বাংলাদেশিকে আটক করেছে। তখনকার দিনে এরকম ক্যাবল, ডিশ, ইইঈ, ঈঘঘ ইত্যাদি ছিলো না; আর জাপানে ইংরেজি কোনো চ্যানেল ছিলো না বলে জাপানিজ টিভিতে কিছুই বুঝতাম না। শুধু শুধু চলতো। হঠাৎ নিউজে চোখ গেলে দেখলাম অনেক বাংলাদেশী মুখ। তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছিলো। সেসময়ে, জাপানের সম্রাট হিরোহিতো মারা গিয়েছিলেন। একজন সাংবাদিককে জানালো, সে হিরোহিতোর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে এসেছে। আরেকজন জানালো, তার পত্রমিতালী বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। খুব খারাপ লেগীছিলো তাদের জন্যে। এর দুইদিন পরে জাহাজ জাপান ছেড়ে চলে এসেছিলো। জানি না, তাদের ভাগ্যে কী হয়েছিলো।

ওহ্‌ একটা কথা এখনও শেষ হয়নিআমার বন্ধু বল্টু ও সেই মোটরসাইকেল। প্রথম ভয়েজ শেষ করে এসে, খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম যে, সেদিন বল্টু সেটা ড্রাইডক থেকে ঠেলতে ঠেলতে আগ্রাবাদ জাম্বুরীফিল্ডের কাছে মেরিনঅফিসার্স এসোসিয়েশানে নিয়ে এসে, ভাইকে ফোন করেছিলো। পরদিন ভাই এসে সেটা নিয়ে গিয়েছিলেন। বল্টুকে এজন্যে বেশ কয়েকবার বিরিয়ানি খাইয়েছি। আপনারাই বলেন, ঠিকমত ক্ষতিপূরণ কি দিয়েছিলাম তাকে?

দ্রষ্টব্যঃ বল্টু ও মোনেম সার দুইটাই কল্পিত নাম হলেও; ঘটনাগুলো একশত ভাগ সত্যি।

টলিডো, ওহাইও, ২০২৩

refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধকুহকের ডাক এবং জহির রায়হান
পরবর্তী নিবন্ধশেষ হলো বাঁশখালীর ঋষিকুম্ভ মেলা