সুফি সাধক হযরত শাহজাহান শাহ (র.) মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে সত্যিকারের বিশ্বাস বুকে ধারণ করে তাঁর প্রেমে আকুল হয়ে সারা জীবন ইসলামের পথে উৎসর্গ করেছেন। তিনি যে সাধনায় লিপ্ত ছিলেন তা অন্তর আত্মার পরিতৃপ্তি বা আধ্যাতিকতার এক স্বর্গীয় পথ। এই পার্থিব বস্তু জগতকে এক আধ্যাত্মিক মানদণ্ডে পরিচালিত করার লক্ষ্যে মানবজাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা এবং আত্মবিশ্বাসকে বৃদ্ধি করে সেই পথ।
আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি মানুষ তাঁর জীবনাদর্শ থেকে এমন এক শিক্ষা লাভ করতে সক্ষম যা মহান সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর সাথে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে আমাদের সহায়তা করে। আধ্যাতিকতার সাথে সাথে নৈতিকতা এবং সততা প্রতিষ্ঠা করার পথকে সুগম করে। সুফি সাধক হযরত শাহজাহান শাহ (র.)-এর দেখানো পথ অনুসরণ করলে আমাদের প্রতিটি সামাজিক কর্মকাণ্ডে ইসলামিক চর্চা বা অনুশীলন অপরিহার্য একটি বিষয় হয়ে উঠে। আমাদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড যেমন ব্যক্তিত্ব, সততা, শুদ্ধতা বা তাকওয়া, এহসান এসবের মাধ্যমেই সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভ করে কিভাবে স্বর্গীয় জীবন লাভ করা যায় তিনি তা আমাদের দেখিয়েছেন। যাতে নিয়োজিত থেকে আমরা প্রত্যেকে সমাজে অনন্তকালের জন্য এক স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
সুফী সাধক হযরত শাহজাহান শাহ (র.) আধ্যাত্মিক সাধনার এক উঁচু স্তরে নিজেকে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর এই অতি উঁচু মাত্রার অর্জন তাঁর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছিল। যা সমাজকে আজও আলোকিত করে চলেছে।
তিনি মানুষকে শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জনের উত্তম পথে পরিচালিত করেননি। তিনি তাঁর আচার–আচরণ এবং সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে সকলের প্রতি এক সুসম্পর্ক গড়ার প্রক্রিয়াও আমাদের দেখিয়েছেন। একজন অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন মুসলিম ত্রুটিপূর্ণ জ্ঞানে বিশ্বাস করেন না। তিনি কখনও কোনো কুসংস্কার বা মূর্খতাকে প্রশ্রয় দেননি বা এসবে তাঁর বিশ্বাস ছিল না।
ইসলাম আমাদের এমন এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিচালিত করে যার মাধ্যমে আমরা আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত একটি নৈতিক মানব সমাজ প্রতিষ্ঠা করার দিকে ধাবিত হই। একটু পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, দুনিয়ায় যেখানে ইসলাম চর্চা হয় না সেখানে সমস্যা প্রকট। ইসলাম বিহীন কোনো সমাজ ব্যবস্থাই মানব সমাজ হতে পারে না। বর্তমানে সকল বৈশ্বিক–সমস্যা সমাধানের একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে ইসলাম চর্চা বা সুফিবাদ। সুফিবাদ মানুষের ভেতরকার মানবিক শক্তি দ্বারা তার ভেতর লুকিয়ে থাকা সুপ্ত বিচার বুদ্ধিকে জাগিয়ে তোলে। এই বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ অনুসরণ করে প্রতিনিয়ত তা অনুশীলনের মাধ্যমে আমরা তার নৈকট্য লাভ করতে পারি। এই সাধনায় যারা সফলতা লাভ করতে পেরেছিলেন হযরত শাহজাহান শাহ (র.) তাদের মধ্যে অন্যতম।
ইসলামি সংস্কৃতির ধারক বাহকরা এই সমাজে সুফি সাধক হযরত শাহজাহান শাহ (র.)-এর মত এমন কিছু পণ্ডিত, দার্শনিক এবং অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তির জন্ম দিয়েছে যাঁরা বিশ্ব শান্তির তত্ত্বাবধায়ক ও উদ্যোক্তা হিসাবে এক অনন্য অবদান রেখে চলেছে। তাঁদের শিক্ষার পাঠ্যসূচি বংশ পরম্পরায় মানব সমাজ এবং তার পরবর্তী প্রজন্মকে সকল দ্বিধা–দ্বন্দ্ব থেকে দূরে রেখে আল্লার পথে পরিচালিত করে।
মহান সৃষ্টিকর্তার বাণী এবং তৌহিদের পথে আজকের মানব সমাজকে পরিচালিত করার জন্য সুফি সাধক হযরত শাহজাহান শাহ (র.)-এর মত একজন সুফির একান্ত অভাব আজ এই সমাজে। তাঁর আদর্শই হতে পারে আজকের এই অস্থির সমাজের জন্য একমাত্র সমাধান।
মহান সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সকল জ্ঞান এবং মানব–ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে আবিষ্কৃত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন মারনাস্ত্র দিয়ে একে অন্যের উপর আক্রমন চালাচ্ছি আমরা, যা মানব জাতির জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা। বিশ্বে অসংখ্য দুঃখজনক সমস্যার কারণ এই অস্থির মানব–লোভ, যেমন: দারিদ্র, ক্ষুধা, পুষ্টিহীনতা, শিক্ষার অভাব, চিকিৎসা সুবিধার অভাব এবং এছাড়াও আরও অনেক নানাবিধ সমস্যা। ইসলামের দেখানো পথে না হেঁটে তার উল্টো পথে চলার ফলেই আমরা আজ এই যাতীয় সমস্যার মুখোমুখি। সুফিবাদকে যেখানেই যথাযথভাবে সচল রাখা হয়েছে এবং যেখানে এটি অনুশীলন হচ্ছে সেখানে তুলনামূলক বলা যায় সমস্যা অনেকাংশে কম। তাই তার সুফল সবার সাথে ভাগাভাগি করে এবং এর সঠিক মূল্যায়ন ও তত্ত্বাবধান করে, লোভ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমাজের ভীত নাড়িয়ে দেয়া যায়। সকল অপশক্তি যেমন হিংসা–বিদ্বেষ, দ্বিধা–দ্বন্ধে নিমজ্জিত সকল সামাজিক অপতৎপরতাকে গুড়িয়ে দিয়ে এই সমাজকে একটি ন্যায় বিচার, সমতা, সন্ত্রাসমুক্ত, সততা, সমন্বয়তা, ভালোবাসা এবং পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সমুন্নত রেখে সকলের শান্তিপূর্ণসহ–অবস্থান করার উপযুক্ত বাসস্থান হিসাবে গড়ে তোলা দরকার।
আধ্যাত্মিকতার মাঝে এমন এক গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে যা আমাদের এ জীবনকে পরিবর্তন করে একটি সত্যিকারের জীবন গড়ার শিক্ষা দেয়। যা ধর্মীয় চেতনাকে ধারন করে এবং ধর্মীয় বানী প্রচার করে সংস্কারের মাধ্যমে সমাজে আমূল পরিবর্তন আনে। অতপর এটা ধরে নেয়া যায় যে, ভালোবাসা, সৎচরিত্র, আত্মার পরিশুদ্ধি একই টিকেটে সংগৃহীত এমন সব গুণাগুণ সম্ভলিত জীবন বা সমাজ ব্যবস্থা যা সকল অপকর্মকে দূর করে সমাজে সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনতে পারে। এই বিশ্বে বস্তুগত এবং সংস্কৃতিগত বিভাজনের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তথা দ্রুত প্রসারমান পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে সকল প্রকার আধ্যাত্মিক সাধনার উৎসগুলোকে এবং জীবনে চলার সুচিন্তিত পথে বিশ্বময় ইসলামি জ্ঞানকে কাজে লাগানো অত্যন্ত জরুরি।
আজ প্রখ্যাত সুফি সাধক হযরত শাহজাহান শাহ (র.)-এর ৫১৭তম ওফাত দিবসে সুফিবাদের প্রিয় বার্তা ইসলামি বিশ্ব এবং সাম্প্রতিক সমস্ত বিশ্ব–শৃঙ্খলার মাঝে সতেজতা ফিরিয়ে আনার ডাক দিচ্ছে। কোনো রকম মতবিরোধ ছাড়া বিশ্বের সমমনা সকল মানব জাতি একত্রে একটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির প্রশস্থ পথ নির্মাণ করে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা অক্ষুণ্ন রেখে বিশ্ব পরিস্থিতির এই সংকটময় মুহূর্তের অবসান ঘটানো অপরিহার্য। মানবতা বর্তমানে এক আত্মবিধ্বংসী ভাবমূর্তি ধারণ করে রয়েছে যা পূর্বের কর্মফল। এই অস্থির অশান্ত গ্রহ আজ সকল প্রকার সুখ শান্তি ও সহমর্মিতাকে বিলীন করে দিচ্ছে। বিখ্যাত সুফি দার্শনিক হযরত শাহজাহান শাহ (র.)-র সুফি দর্শন সমাজে এক নিরাপদ রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। তাঁর সুফি দর্শনের মূল ধারণা হল–এই বিশ্বে মানুষের অবস্থান ক্ষণস্থায়ী, তাই সমস্থ লোভ লালসা, দ্বিধা–দ্বন্দ্ব এবং বিতর্ক–বিসম্বাদ এড়িয়ে চলে আধ্যাত্মিক আনুগত্য ধর্মীয় নৈতিকতার বিশুদ্ধ অনুশীলন, ধর্মীয় আচারাধির প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য বা তৌহীদের (আল্লাহর একত্ববাদ) পথে নিজেকে সমর্পণ করা। আর সেটাই হবে আমাদের সকলের জন্য সবচেয়ে উত্তম পথ।
[সংশোধনী : গতকাল দৈনিক আজাদীর চতুর্থ পাতায় প্রকাশিত দ্বিতীয় উপ–সম্পাদকীয় কলামে লায়ন এম সামসুল হকের ছবির পরিবর্তে ভুলবশত জাতীয় সংসদের মাননীয় হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপি’র ছবি ছাপা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। –বি.স]