গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব মোস্তফা কামাল সংসদে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ কুড়ি জন ঋণখেলাপির নামের তালিকা প্রকাশ করেছেন। নামগুলো ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে দেশের সকল পত্র–পত্রিকায় গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়েছে। এই ২০ জন শীর্ষ ঋণখেলাপিকে প্রদত্ত মোট ঋণের পরিমাণ ১৯,২৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা, যার মধ্যে ১৬,৫৮৭ কোটি ৯২ লাখ টাকা খেলাপিঋণ। সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছেন বাংলাদেশে মোট সাত লাখ ছিয়াশি হাজার পঁয়ষট্টি জন ঋণখেলাপি রয়েছেন। শীর্ষ কুড়ি ঋণখেলাপির এক নম্বরে থাকা প্রতিষ্ঠানের খেলাপিঋণ ১,৬৪০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, আর কুড়ি নম্বরের খেলাপিঋণ ৫৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা। কিন্তু, ওয়াকিবহাল মহল সাথে সাথে এই তালিকাকে প্রত্যাখ্যান করে অভিযোগ তুলেছেন যে অর্থমন্ত্রীর তালিকায় বাংলাদেশের ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’ হিসেবে কুখ্যাত একজনের নামও খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ তারিখে দেশের ইংরেজী দৈনিক দি ডেইলি স্টার প্রথম পৃষ্ঠার হেডলাইন করেছে, ্তুঘড়ঃড়ৎরড়ঁং যধনরঃঁধষ ফবভধঁষঃবৎং সরংংরহম ভৎড়স ষরংঃ্থ (মানে, নিয়মিতভাবে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া কুখ্যাত ঋণখেলাপিদেরকে তালিকায় পাওয়া যাচ্ছে না)।
২০১০ সালে প্রকাশিত আমার সাড়া জাগানো গবেষণা–গ্রন্থ অ চৎড়ভরষব ড়ভ ইধহশ খড়ধহ উবভধঁষঃ রহ ঃযব চৎরাধঃব ঝবপঃড়ৎ রহ ইধহমষধফবংয–এ এই ‘হেবিচুয়াল ডিফলটারস’ দেরকে আমি ‘উইলফুল ডিফলটারস’ আখ্যায়িত করেছি, যার বাংলা অর্থ হলো ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’। এর মানে, এই রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা রাজনৈতিকভাবে এবং আর্থিকভাবে এতই প্রভাবশালী যে তারা ব্যাংকের ঋণ ফেরত না দিলেও ব্যাংক–কর্তৃপক্ষ, সরকার বা দেশের বিচারব্যবস্থা তাদেরকে শাস্তি দিতে পারছে না। এ–সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বছরের পর বছর ঋণখেলাপি হয়ে বহাল তবিয়তে তারা দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা গৃহীত ঋণের বড় অংশটাই বিদেশে পাচার করে ঘরবাড়ী ও ব্যবসাপাতি কিনে তাদের পরিবারের প্রায় সবাইকে বিদেশে অভিবাসী করে ফেলেছে। ১৯৯৬–২০০১ মেয়াদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া ১৯৯৭ সালে এক কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রস্ত যে ২১১৭ জন ঋণখেলাপির তালিকা সংসদে পেশ করেছিলেন ঐ তালিকার বৃহত্তর এক হাজার ঋণখেলাপি থেকে ১২৫ টি নমুনা বাছাই করে আমরা গবেষণাটি পরিচালনা করেছিলাম। আমি তখন ডেপুটেশনে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট এর ডাইরেক্টর জেনারেল। ১৯৯৯ সালের মে মাসে গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল নিয়ে আমরা একটি জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠানের সাথে সাথে খেলাপিঋণ নিয়ে দেশে–বিদেশে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমাদের গবেষণার ফলাফল নিয়ে বিরোধী দল বিএনপি’কে সংসদে তুলোধুনা করেছিলেন। কিন্তু, তখনকার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের অসহযোগিতায় আমাদের গবেষণা ভন্ডুল হওয়ার উপক্রম হয়। অনেকদিন গবেষণা বন্ধ রাখার পর ‘রিসার্চ মেথডলজি’ পরিবর্তন করে ‘কেস স্টাডি মেথড’ ব্যবহার করে আমরা দীর্ঘ বিলম্বের পর গবেষণাটি সম্পন্ন করে ২০১০ সালে বই হিসেবে প্রকাশ করি। বইটি অতি দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। ঐ বইয়ের সপ্তম অধ্যায়ে বাংলাদেশের শীর্ষ ৩১ জন ঋণখেলাপির কেস স্টাডি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যাদেরকে আমি গত ১২ বছর ধরে মনিটর করে যাচ্ছি। আমার জানামতে ঐ ৩১ জন ঋণখেলাপির মধ্যে ছয় জন ছাড়া অন্যরা হয় এখনো ঋণখেলাপি রয়ে গেছেন অথবা ঋণখেলাপি থাকা অবস্থায় মারা গেছেন। তাদের একজনের নামও অর্থমন্ত্রী কর্তৃক সংসদে পেশ করা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। (বলা বাহুল্য, খেলাপিঋণ সমস্যাটিকে আমি গত এক যুগ ধরে গভীরভাবে স্টাডি করে চলেছি)। অর্থমন্ত্রী কর্তৃক এবার উপস্থাপিত কুড়ি জন ঋণখেলাপির মধ্যে অর্ধেক চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান, যেগুলো খেলাপিঋণের কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তালিকার মধ্যে ঢাকার কয়েক’শ রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের একটিকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যাদের প্রত্যেকটির খেলাপিঋণের পরিমাণ প্রকাশিত এই কুড়িটি প্রতিষ্ঠানের চাইতে বেশি বলে দেশের ব্যাংকিং সম্পর্কে খোঁজখবর রাখা সকলেরই জানা আছে। দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর মনে করেন, সরকারের প্রদত্ত সুযোগ নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান খেলাপিঋণের ২ শতাংশ ফেরত দিয়ে হয়তো তাদের নাম ১০ বছরের জন্য ঋণখেলাপি তালিকা থেকে উধাও করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিনও বলেছেন, সরকারের প্রদত্ত রিশিডিউলিং–এর নিয়ম এভাবে শিথিল করার সুযোগ নিয়ে এবং ঋণ ফেরত দেওয়ার নীতিকে উদার করায় হয়তো এ ধরনের অপকর্মের হোতারা (ডেলিংকোয়েন্ট বোরোয়ার্স) পার পেয়ে গেছেন!
জনাব মোস্তফা কামাল ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর খেলাপিঋণকে লুকিয়ে ফেলার যে নীতিগুলো একের পর এক গ্রহণ করেছিলেন তার তালিকাটি দেখুন:
১) ২০১২ সাল থেকে প্রচলিত তিন ধরনের শ্রেণীকরণের নিয়ম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতের অনাদায়ী ঋণকে শ্রেণীকরণের নূতন নিয়ম চালু করেছিল: এক, পূর্বে নির্দিষ্ট মেয়াদের তিন মাস পর যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হত সেগুলোকে ‘সাব–স্ট্যান্ডার্ড ঋণ’ শ্রেণীকরণ করা হতো, নূতন নিয়মে তিন মাসের পরিবর্তে সময়টা ছয় মাস করা হয়েছে; দুই, পূর্বে নির্দিষ্ট মেয়াদের ছয় মাসের বেশি যেসব ঋণ মেয়াদোত্তীর্ণ হত সেগুলোকে ‘ডাউটফুল ঋণ’ বলা হত, নূতন নিয়মে নয় মাস মেয়াদোত্তীর্ণ হলে ‘ডাউটফুল’ শ্রেণীকরণ হবে; এবং তিন, আগের নিয়মে নয় মাসের বেশি কোন ঋণ খেলাপি হলে ‘মন্দঋণ’ শ্রেণীকরণ করা হতো, এখন এক বছর বা তার বেশি সময়ের জন্যে ঋণ অনাদায়ী হলে ‘মন্দঋণ’ বা ‘লস’ শ্রেণীকরণ করা হবে। ২০১২ সালের নিয়মটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ছিল, কিন্তু অর্থমন্ত্রীর চাপে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরানো শ্রেণীকরণ পদ্ধতিতে ফিরে গেল।
২) এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ বা অবলোপনের নিয়মনীতি অনেকখানি শিথিল করে নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করল: আগের নিয়মে যেখানে পাঁচ বছরের খেলাপি মন্দঋণ ‘রাইট অফ’ করার যোগ্য বিবেচিত হত সেক্ষেত্রে নতুন নিয়মে দুই বা তিন বছরের মন্দঋণও ‘রাইট–অফ’ করায় কোন বাধা থাকবে না। পাঠকদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, মন্দঋণ ‘রাইট–অফ’ বা অবলোপন করার মানে হলো ঐ অবলোপনকৃত মন্দঋণের হিসাবটা ব্যাংকের মূল ব্যালেন্স শিট থেকে অপসারণ করে আরেকটি লেজারে হিসাবটা সংরক্ষণ করা। ‘রাইট–অফ’ করার দুটো শর্ত হলো: (১) ঐ ঋণ সুদাসলে আদায়ের জন্যে ব্যাংক মামলা দায়ের করবে, (২) যে পরিমাণ ঋণ ‘রাইট–অফ’ করা হয় তার সম–পরিমাণ অর্থ ‘প্রভিশনিং’ বা ‘সঞ্চিতি’ করতেই হবে। প্রভিশনিং মানে হলো, ঐ পরিমাণ অর্থ অন্য কাউকে ঋণ দেওয়া যাবে না। রাইট অফ করার ফলে ব্যাংকের ক্লাসিফাইড লোনের পরিমাণ ঠিক অতটুকু কম দেখানো যাবে। অতএব, নতুন নিয়ম চালু করে ক্লাসিফাইড লোন কমানোর হাতিয়ার ব্যাংকগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হলো। আর একটা সুবিধে ঘোষিত হলো, মামলা করার বাধ্যবাধকতার জন্যে আগে যে সর্বনিম্ন সীমা (ফ্লোর) ছিল ৫০,০০০ টাকা ওটাকে বাড়িয়ে ২,০০,০০০ টাকা করা।
৩) তারপর ২৫ মার্চ ২০১৯ তারিখে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, মাত্র ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ প্রথম কিস্তিতে শোধ করলে ঋণখেলাপিকে ১০ বছর সময় দেওয়া হবে, যার মধ্যে তিনমাসের কিস্তিতে মাত্র ৭ শতাংশ সুদে বাকি ঋণ শোধ করা যাবে। (পরে তিনি বললেন সুদের হার ৯ শতাংশ হবে)।
৪) এরপর ৭ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে তিনি বললেন, ‘আমি খেলাপি ঋণের জন্যে ব্যবসায়ীদেরকে কিভাবে জেলে পাঠাব?’ দুর্নীতির দায়ে যদি দেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী জেল খাটেন তাহলে ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ ব্যবসায়ীরা আইন মোতাবেক শাস্তি পেলে তাঁর প্রাণ কাঁদবে কেন? ব্যবসায়ীরা কি আইনের উর্ধ্বে?
৫) ২৮ এপ্রিল ২০১৯ তারিখে তিনি সংসদে বললেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইন কার্যকর করার মাধ্যমে ঋণখেলাপিদেরকে মাফ করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
৬) সর্বশেষ, যে ১৫ জন খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে ২০১৫ সালে মন্দঋণ রিস্ট্রাকচারিং–এর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তাঁদেরকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে ঐ সুবিধা গ্রহণ করলে আর কখনো নতুন করে ঋণ রিশিডিউলিং–এর সুযোগ পাওয়া যাবে না। কিন্তু, ১৫ জনের মধ্যে মাত্র চারজন ঐ শর্ত মেনে সুযোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছিল। বাকি ১১ জনকে আর রিশিডিউলিং সুযোগ দেওয়া হবে না বলা হলেও অর্থমন্ত্রীর চাপের কাছে নতি স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংক তাদেরকে আবারো ঋণ রিশিডিউল করার অনুমতি দিয়েছিল।
উপরের পদক্ষেপগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, দায়িত্ব নেয়ার শুরু থেকেই জনাব মোস্তফা কামাল ঋণখেলাপিদেরকে অস্বাভাবিক রকম ছাড় দিতে শুরু করেছিলেন। গত চার বছর ধরে তিনি তাঁর এই ঋণখেলাপি–প্রীতি অব্যাহত রেখেছেন আরো অনেক নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ক্লাসিফাইড লোনের যে হিসাব প্রকাশ করলো তাতে মাত্র পঁচানব্বই হাজার কোটি টাকায় নেমে গেলো ক্লাসিফাইড লোন। বলা হলো, নতুন পদক্ষেপগুলোর কারণে খেলাপিঋণ কমে গেছে। কিন্তু আইএমএফ এই দাবির প্রতিবাদে ব্যাখ্যাসহ জানালো, ঐ পর্যায়ে বাংলাদেশের খেলাপিঋণের প্রকৃত পরিমাণ দুই লক্ষ চল্লিশ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু, আইএমএফ এর উল্লিখিত পরিমাণে যেহেতু রাইট–অফ করা মন্দঋণ অন্তর্ভুক্ত ছিল না তাই প্রকৃত খেলাপিঋণ তখনই তিন লাখ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা। এরপর যখন ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস মহামারি আঘাত হানলো তখন আর কোন ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি ঘোষণা না করার নীতি গ্রহণ করলো সরকার। আড়াই বছর পর গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষের হিসেব প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ঐ সময় ক্লাসিফাইড লোন ছিল এক লাখ চৌত্রিশ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, এখন দেশে খেলাপিঋণের প্রকৃত পরিমাণ হয়তো চার লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রী মহোদয় তাঁর চার বছরের মেয়াদে সফলভাবে তাঁর ‘রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি’দের খেলাপিঋণকে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেলা সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকগুলোতে হু হু করে তা বেড়ে চলেছে। এটাই হলো দুঃখজনক বাস্তবতা। তাঁর প্রদত্ত তালিকার কুড়ি জন ‘শীর্ষ ঋণখেলাপি’ শীর্ষে স্থান পাওয়ার যোগ্য নয়। ‘আসল রাঘববোয়ালরা’ এখনো আড়ালেই রয়ে গেলেন!
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়