পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাংলার সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরিচয়কে সাধারণ্যে উজ্জীবিত করতে স্বাধীনতাপূর্বকালে সাংগঠনিক রাজনীতির বাইরে থেকে কাজ করেছিলো একটি সংগঠন, ছায়ানট, যার জন্ম বাংলাদেশেরও আগে এবং বাংলাদেশ সৃষ্টিতেও রয়েছে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত বাঙালির পথপরিক্রমণের গৌরবের অংশ ছায়ানট। পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হলে সেই জাতীয়তাবোধ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটুকুও অনেকাংশে এ সংগঠনটিই কাঁধে তুলে নেয়। গত পাঁচ দশকে ছায়ানটের যা কিছু প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি, তার পুরোটাই একইসাথে বাংলাদেশেরও। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পঞ্চাশেরও বেশি বছর পর এসে যদি পেছনে তাকাই, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পথচলার ইতিহাসটা কেমন ছিলো?
ছায়ানটের বর্তমান সহসভাপতি ও প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী খায়রুল আনাম শাকিলের কাছে এমন আরো নানা প্রশ্ন নিয়ে হাজির হয়েছিলাম এক পড়ন্ত বিকেলে। ঘরোয়া সেই আলাপে উঠে আসে ছায়ানটের অতীত থেকে সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গ।
আলাপের প্রারম্ভেই ছায়ানটের আত্মপ্রকাশের ইতিহাস তুলে ধরলেন তিনি। ‘১৯৬১ সালে পাকিস্তানি শাসনের প্রতিকূল পরিবেশে শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রবীন্দ্র–জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করতে কতিপয় সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি একত্র হয়েছিলেন। এমন নয় যে সরকারিভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা এসেছিলো, কিন্তু একধরনের প্রতিকূলতা, বাধা এসেছিলো এই যুক্তিতে যে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কেউ নয়। কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম ব্যক্তিত্ব হলেন রবিঠাকুর। ফলে, এই বৈরিতা কেবল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতিরই বিরুদ্ধে। ভবিষ্যতে বাঙালি সংস্কৃতির উপর আরো বড় আঘাত আসতে পারে সেই আশঙ্কায় দায়বদ্ধতা থেকে প্রতিবাদ জানাতেই সমাজের সংস্কৃতিমনা নেতৃস্থানীয় বাঙালিরা ছোটো পরিসরে হলেও রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপন করেন। এটিই ছিলো পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।’
‘শতবার্ষিকী উদ্যাপন করবার পর এক বনভোজনে গিয়ে সুফিয়া কামাল, সিধু ভাই (মোখলেসুর রহমান), সায়েরা আহমদ, রোজ বু (শামসুন্নাহার রহমান), আহমেদুর রহমান, ওয়াহিদুল হক, সাইদুল হাসান, ফরিদা হাসান, সন্জীদা খাতুন, মীজানুর রহমান, সাইফউদ্দীন আহমেদ মানিকসহ কয়েকজন মিলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য সংগঠন করার সিদ্ধান্ত নেন এবং লোকগান, পঞ্চকবির গান থেকে শুরু করে বাঙালির যা কিছু উপজীব্য, তাই নিয়ে নিয়মিতই বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করতে লাগলেন তারা।’
‘কিন্তু দেখা গেলো শিল্পী পাওয়া যাচ্ছে না, অল্প কয়েকজন শিল্পীকে দিয়েই প্রতিবার গান গাওয়াতে হচ্ছে। এর কারণও ছিলো। ঐতিহাসিকভাবেই বাংলার সাধারণ মুসলমান পরিবারগুলোতে সন্তানদের গান শেখানো হতো না। মুসলমানদের আলাদা দেশ হওয়ায় অনেক হিন্দু পরিবার এ অঞ্চল ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমানোয় শিল্পী সঙ্কটের চিত্রটা লক্ষনীয় হয়ে ওঠে। এভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বা সংস্কৃতিচর্চা কোনটাই সম্ভব নয়। তাই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে গান শেখানোর প্রয়োজনও অনুভূত হয়। সেখান থেকেই ছায়ানটের যাত্রা শুরু। সংস্কৃতি ও সঙ্গীতচর্চাকে আরো ব্যাপক ও নিবিড় করে তোলার লক্ষ্যে সৃষ্টিশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয় ছায়ানটকে। বাঙালি সংস্কৃতির নবজাগরণের লক্ষ্যে গান, নৃত্য, যন্ত্রসঙ্গীত প্রশিক্ষণ ও প্রসারে ছায়ানট নিয়োজিত রয়েছে। সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে এ–প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং সাংস্কৃতিক বিকৃতি ও সংস্কৃতিহীনতা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে ছায়ানট বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।’
এখানে এসেই প্রশ্ন ওঠে, যে লক্ষ্যে ছায়ানটের যাত্রা শুরু, তাতে তারা কতটা সফল? আপাতদৃষ্টিতে দেখা যায়, যুদ্ধ পরবর্তী দুই দশকে সাংস্কৃতিক–সামাজিক সংগঠনের নানা উৎসব, পাড়ার জলসা, অফিস–দপ্তরেও বাৎসরিক অনুষ্ঠানমালার নিয়মিত আয়োজন ছিলো। এবং সংগঠনের কর্মীরাই কিংবা পাড়া–মহল্লার ছেলে–মেয়েরা নিজেরাই এসব আয়োজন জমিয়ে তুলতো। নব্বইয়ের দশকেও এসবের চল ছিলো। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে এসে এসব আয়োজন কমতে লাগলো। সংগঠন, ক্লাবের সংস্কৃতি উঠে যেতে লাগলো। ছেলে–মেয়েদের মধ্যে গান–নাচ শেখার আগ্রহ কমে যাওয়াটা তাই অস্বাভাবিক না। পাশাপাশি পারিবারিকভাবে শেখানোর প্রবণতাও পড়তিরই দিকে।
খায়রুল আনাম শাকিল অস্বীকার করলেন না সবটা। তার মতে, ‘যুগের সাথে সাথে মানসিকতায়, প্রবণতায় পরিবর্তন এসেছে অনেক। রাতারাতি খ্যাতি পাওয়ার মোহ আজকালকার তরুণদের মাঝে সাধনার প্রবণতাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমাদের সময় শিল্পী হওয়া এতোটা সহজ ছিলো না। রেডিও–টিভিতে তালিকাভুক্ত হতে পরীক্ষা দিতে হতো এবং ভালো গাইলেই কেবল এ–পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যেতো। ফলে সাধনা, সংস্কৃতিচর্চায় আত্মনিবেশ করতে হতো শিল্পীদের।’
বাঙালি জাতীয়তাবোধ জাগ্রত ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার যে লক্ষ্য থেকে ছায়ানটের কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তাতেও তো খুব একটা সফলতা আসেনি?
শাকিল বললেন, ‘কিছুটা ব্যর্থতা আমাদের রয়েছে বটে, কিন্তু এর বেশিরভাগটাই আসলে পারিবারিক। মুক্তিযুদ্ধের আগে–পরের কয়েক দশক পর্যন্ত এখানকার মানুষের মাঝে বাঙালিবোধ ছিলো। কিন্তু এর পরবর্তী প্রজন্মে ব্যাপারটা সেভাবে ছড়ায়নি। এর কারণ আমার মনে হয়, বাঙালি খুব দ্রুত স্বাধীনতা পেয়ে গিয়েছে। পৃথিবীতে আর কোন দেশ এতো অল্প সময়ে স্বাধীন হয়ে যায়নি। এর ফলে স্বাধীনতার মূল্য আমরা বুঝতে পারিনি। অনেক মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়েই স্বাধীনতা এসেছে ঠিক, কিন্তু সেই ত্যাগ, দুর্ভোগ দীর্ঘদিন আমাদেরকে বয়ে বেড়াতে হয়নি।’
‘আর, আমাদের সময় আজকের দিনের মতো সমগ্র বিশ্ব হাতের মুঠোর চলে আসেনি। ফলে আমরা নিজেদের গান, ঐতিহ্য এসব নিয়েই বেড়ে উঠেছি। বাঙালিবোধটুকু তাই আমাদের মাঝে বেশি ছিলো। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম সারা পৃথিবীর সবরকম সংস্কৃতি, সঙ্গীতের স্বাদ আস্বাদন করতে পারছে। এর প্রভাবও তো কম নয়। কিন্তু বিশ্ব নাগরিক হওয়ার সাথে সাথে আমাদেরকে বাঙালিও হতে হবে, এটাই এখনকার ছেলে–মেয়েরা ভুলতে বসেছে। বিশ্বকে জানা–শোনায় কোন বাধা নেই, তবে তার আগে বাঙালি হও– এ কথাটাই আমরা ছায়ানটে শেখাই।’
কিন্তু রাজধানী ঢাকার বাইরে এই শেখাটুকু কতোটা ছড়িয়েছে? বা যদি বলি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন? খুব বেশি ছড়িয়েছে বলে তো মনে হয় না। জেলা–উপজেলা পর্যায়ে অবস্থা তো খুবই নাজুক।
একুশে পদকের অধিকারী এ–শিল্পী বললেন, ‘এখনো যতটুকু সংস্কৃতিচর্চা দেশে হচ্ছে, তার কৃতিত্ব অনেকটাই ছায়ানটের। ছোট শহরগুলোতে যারা গান শেখাচ্ছেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যারা সম্পৃক্ত, তাদের বেশিরভাগই ছায়ানট থেকে শিখে গেছেন এবং সেই আদর্শই ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আমরা হয়তো ঘরে ঘরে এই আদর্শ বা সংস্কৃতির চর্চা পৌঁছে দিতে পারিনি, কিন্তু অনেককেই সচেতন করতে পেরেছি।’
অনেককে সচেতন করতে পেরেছে ছায়ানট, কিন্তু আরো অনেককেই পারেনি তারা। নিঃসন্দেহে ছায়ানট বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের জায়গা থেকে নানান কাজ করে যাচ্ছে। বর্ষবরণে দীর্ঘ অনেক বছর ধরেই রমনার বটমূল থেকে শুরু করে নানা স্থানে তারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। সারা দেশেই ছোট–বড় সব রকমের আয়োজনই করে থাকেন ছায়ানটের বা সমমনা মানুষেরা। কিন্তু বর্ষবরণের সেই আয়োজনেও বোমা হামলা হয়েছে। অবশ্যই এ–হামলা কেবল ছায়ানটের উপর নয়, বরং বাংলার আবহমান সংস্কৃতিরই উপর। রমনার বটমূল ছাড়াও বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো হামলা হয়েছে, কোথাও বা অনুষ্ঠান আয়োজনও করতে দেয়নি উগ্রগোষ্ঠীরা। যে আয়োজনকে বাঙালির প্রাণের উৎসব বলা হচ্ছে, সেখানেই কি করে একদল বাঙালি ছুঁড়ে দিতে পারে ভয়াবহ গ্রেনেড! সাম্প্রদায়িক যে অসহিষ্ণুতা সাম্প্রতিক সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বাংলার মাটিতে, তা কি কখনো হওয়ার কথা ছিলো? যে আদর্শসমূহ সামনে রেখে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, অসাম্প্রদায়িকতা তার অন্যতম। ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রে আমাদের অনাস্থার অন্যতম কারণও এটি। সেখানেই যখন ধর্মের নামে একদল বাঙালি নানা ধর্মের সহাবস্থানের উপরই হামলা চালায়, প্রশ্ন ওঠে, কতটা ছড়িয়ে দেওয়া গেছে বাঙালির আবহমান সেই আদর্শ? ছায়ানট কি তবে ব্যর্থ?
শাকিল এ অভিযোগও অস্বীকার করলেন না। ‘ব্যর্থ বলা যায় না, বলা যায়, এখনো আমরা সফল হইনি। সারা বিশ্বেই এখন ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, কেবল বাংলাদেশ একা নয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশেও ক্রমশ এই চিত্র প্রকট হয়ে উঠছে। এ–ব্যর্থতা কেবল ছায়ানটের নয়, সমগ্র বিশ্বেরই, সমগ্র মানবজাতিরই। এ–ব্যর্থতা রাজনৈতিক। আমরা যারা সাংস্কৃতিক কর্মী, আমাদের লড়াইটা এসবের বিরুদ্ধে। মানুষের মাঝে সম্প্রীতি, শুভবোধ জাগানোই শিল্পের কাজ, শিল্পীর কাজ।’
এভাবে কথা চলতেই থাকলো আমাদের। প্রশ্ন–উত্তরের সেতুবন্ধন রচিত হলো সন্ধ্যার শেষ আলো মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত। নানান বিষয় নিয়ে আলাপ তার নিজস্ব ঢঙে এগিয়ে গেছে, আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে। আলাপ শেষ হলেও আশা–হতাশায় মেশানো এসব প্রসঙ্গ আরো দীর্ঘসময় প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে বলেই বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। স্বাধীনতার পর থেকে যতোটা অর্জন বাংলাদেশের, তাকে ম্লান হয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে যে উগ্রগোষ্ঠীর আগ্রাসন দিন দিন তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইটাও লড়তে হবে সাংস্কৃতিকভাবে। আর এ–লড়াইয়ে ছায়ানটই বাংলাদেশের বাঙালিদের অন্যতম হাতিয়ার। সাফল্য–ব্যর্থতার হিসেব–নিকেশ তো অনেক করা যাবে, কিন্তু এই যে হাল না ছেড়ে, ভয় না পেয়ে এখনো এই সংগঠনটি কাজ করে চলেছে, তার সাধুবাদ তো তাদের দিতেই হয়, সাথে, রাখতে হয় আস্থা।