১৯৫৮ এর ৭ অক্টোবর রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে প্রেসিডেন্ট (২৩ মার্চ ’৫৬ – ২৭ অক্টোবর ’৫৮) মেজর জেনারেল এস্কান্দর মির্জাকে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূনের নেতৃত্বাধীন রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে সংবিধান ’৫৬ ও প্রথম সাংবিধানিক সংসদ (৫৬–৫৮) বাতিল করে সামরিক শাসন জারি করে। জেনারেল আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মির্জা থেকে পদত্যাগ স্বাক্ষর করিয়ে ইরানী কন্যা তার সুন্দরী স্ত্রী নাহিদ মির্জাকে দেশত্যাগে বাধ্য করে।
জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়ে সাড়ে ১০ বছরের (৭ অক্টোবর ’৫৮ – ২৫ মার্চ ’৬৯) এক অদ্ভুত প্রকারের শাসন চালায়। সকল রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি নিষিদ্ধ, সংবাপত্রের স্বাধীনতা হরণ, মিছিল মিটিং নিষিদ্ধকরণ, রাজনৈতিকবর্গকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা (এবডো), জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কারারুদ্ধ করে সামরিক ও অনুগত সরকারি কর্মচারীদের সমন্বয়ে দেশ শাসন শুরু করে। বাঙালিদের উপর চলে অত্যাচর নির্যাতনের স্ট্রিম রোলার ১৯৬০ সালে কুখ্যাত শরীক শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও চালু, ৬২ তে সামরিক ও আমলাদের সমন্বয়ে সংবিধান প্রণয়ন ও ১ মার্চ হতে চালু করে ৬২–র ২৮ এপ্রিল ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে নির্দলীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে।
ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিছু প্রবীণ নেতার বিরোধীতার মুখে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে সভাপতি করে আওয়ামী লীগকে পুনঃর্জীবিত করে আইয়ুবের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে দলকে রাজপথে নিয়ে এলে শুরু হয়ে যায় তিনি সহ দলীয় নেতাকর্মী সমর্থকদের উপর জেল–জুলুম। বাংলার মানুষের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬৬–র ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলীয় নেতাদের বৈঠকে তাঁর প্রণীত ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবী উত্থাপন করলে সবাই প্রত্যাখ্যান করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের জনসভায় প্রকাশ্যভাবে তা জাতির কাছে উত্থাপন এবং ২২ মার্চ শুক্রবার পল্টনের জনসভায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি (২১ মার্চ ’৬৬– ২৫ জানু ’৭৫) হিসাবে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন – জীবনের বিনিময়ে হলেও ৬ দফা দাবী আদায় করিয়া জাতিকে মুক্ত করব, ইনশাল্লাহ, (দৈনিক ইত্তেফাক / ২৩ মার্চ ’৬৬ / ১ম পৃষ্ঠা) এবং ঐদিন গভর্ণর ভবনে মুসলিম লীগ দলীয় নেতা–কর্মীদের উদ্দেশ্যে ৬ দফা দাবীকে অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করা হবে বলে আইয়ুব খান কঠোর ভাষায় হুশিয়ারী স্থাপন (দৈনিক ইত্তেফাক / ২৩ মার্চ ’৬৬/ লীড নিউজ)।
আর এই হুশিয়ারীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মামলা তৈরী করে প্রতিরক্ষা আইনে গ্রেফতার করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের হাতে তুলে দেয়। ৬ দফা সমর্থনকারী হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ছাত্রলীগ শ্রমিকলীগ নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতনের চরম কর্মকাণ্ড শুরু হয়।
সকল প্রকার আইয়ুবীয় দমন–নির্যাতনকে রুখে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া), ছাত্র ইউনিয়নে (মেনন) সাথে মাহবুবুল হক দুলনের নেতৃত্বে এন.এস.এফ–এর একটি বৃহৎ অংশ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৬৮–র ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের উপরে কালো পতাকা উত্তোলন করে ডাকসুর সহ–সভাপতি ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে এক বিশাল ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অন্যান্য দলের সাথে এনএসএফ–এর (দুলন) পক্ষে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক এনসিএফ নেতা নাজিম কামরান চৌধুরী ছাত্র সমাজের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
৬৯–র ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বটতলায় তোফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে ডাকসুর জি.এস নাজিম কামরান চৌধুরী, এনএসএফ–এর মাহবুবুল হক দুলন, ছাত্রলীগের আবদুর রউফ, ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপের মাহবুল্লাহ ও সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক এবং এনএসএফ–এর ফখরুল ইসলাম মুন্সি এক বিশাল ছাত্র সমাবেশে সরকার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন।
এই গণ–অভ্যুত্থানের লক্ষ্যে ৩ জানুয়ারি রাত ১১ টায় ইকবাল হলে মহান ১১–দফা দাবী প্রণীত হয় এবং এতে স্বাক্ষর করেন তোফায়েল আহমদ, নাজিম কামরান চৌধুরী, মাহবুবুল হক দুলন, ফখরুল ইসলাম মুন্সি, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, মোস্তফা জামাল হায়দার, দীপা দত্ত, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক ও সামসুদ্দোহ প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ। ৪ জানুয়ারি ডাকসুর ভিপি হিসাবে তোফায়েল আহমদ আনুষ্ঠানিকভাবে সমগ্র জাতির কাছে তা পেশ করেন (তোফায়েল আহমদ/সাপ্তাহিক মেঘনা/পৃ: ৩৭–৩৯/৮ জানুয়ারি ’৮৬)।
সমগ্র দেশব্যাপী ছাত্র সমাজের এই আপোষহীন সংগ্রামের ফলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিঃশর্ত মুক্তি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, জননিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার এবং স্বরচিত আইয়ুবীয় সংবিধান বাতিলসহ সংসদ ও মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে আইয়ুব খান ইতিহাসের দ্বিতীয় হিটলার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
এই গণঅভ্যুত্থানের সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফাঁসির মঞ্চ হতে প্রথম জীবন লাভ করেন। ’৬৯–র ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলনের সর্বাত্মক সার্থকের শেষ পর্যায় ১২ মার্চ শনিবার আমার সভাপতিত্বে লালদিঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগাম পরিষদের সর্বশেষ সভায় ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নাজিম কামরান চৌধুরী, এন.এস.এফ (দুলন) ফখরুল ইসলাম মুন্সি, ছাত্রলীগের খালেদ মুহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন) মাহবুব উল্লাহ ও ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া) সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক ১১ দফা আদায় করে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয় জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
লেখক: জীবন সদস্য–বাংলা একাডেমি; সভাপতি (১৯৭২–৯০) শেখ মুজিব গণ পাঠাগার (গহিরা, রাউজান, চট্টগ্রাম) ও কলামিস্ট।