ক্রিকেট কতটা গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা সেটা যেন আরো একবার প্রমাণ হলো গতকাল। আর টি–টোয়েন্টি ক্রিকেটতো আরো বেশি অনিশ্চয়তার এবং রোমাঞ্চে ভরা। সেটাও দেখল গতকাল জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের গুটিকয়েক দর্শক। ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়া বরিশাল রানের পাহাড়ে চড়া আবার বল হাতে প্রতিপক্ষকে গুটিয়ে দেওয়া সব মিলিয়ে রেকর্ড গড়া এক জয় তুলে নিল সাকিবের দল। হার দিয়ে বিপিএল শুরু করা বরিশাল আর পেছনে ফিরে থাকায়নি। নিজেদের প্রথম ম্যাচে সিলেটের কাছে হেরেছিল সাকিবের দল ১৯৪ রান করে। তবে আর কেউ থামাতে পারেনি সাকিবের দলের জয়রথ। এরপর টানা চার ম্যাচে জিতে পয়েন্ট তালিকায় দ্বিতীয় স্থানটি ধরে রেখেছে সাকিবের বরিশাল। অনেক রেকর্ডে মোড়ানো ম্যাচটি বরিশাল জিতেছে ৬৭ রানে। সাকিব–ইফতেখারের ব্যাটিংয়ের পর মিরাজ এবং ওয়াসিমের বোলিং বরিশালের এই জয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। এই জয়ের ফলে নক আউটের পথে অনেকটাই এগিয়ে গেল সাকিবের বরিশাল।
টসে হেরে ব্যাট করতে নামা বরিশালের শুরুটা ভাল হয়নি। যে আশায় প্রতিপক্ষকে আগে ব্যাট করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রংপুরের অধিনায়ক সে প্রত্যাশা যেন দারুণভাবে পূরণ করছিলেন দলের দুই পেসার হারিস রউফ এবং হাসান মাহমুদ। ৩০ রানে বিচ্ছিন্ন হন দুই ওপেনার এনামুল এবং মিরাজ। হারিস রউফ প্রথম ওভারে বল করতে এসে প্রথম বলেই ফেরালেন ৮ বলে ১৪ রান করা এনামুলকে। একই ওভারে ইব্রাহিম জাদরানকে রানের খাতাও খুলতে দেননি রউফ। হাসান মাহমুদের করা ইনিংসের ষষ্ঠ এবং নিজের দ্বিতীয় ওভারে পরপর দুই বলে দুটি ছক্কা খেলেন মেহেদী হাসান মিরাজের কাছে। তৃতীয় বলে ফেরালেন মিরাজকে। পরের বলে আরো বড় ধাক্কা। এবার রানের খাতা খোলার আগেই এক বল খেলে ফিরলেন মাহমুদউল্লাহ। মিরাজ ২০ বলে ২৪ রান করলেও ৪৬ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপাকে তখন সাকিবের দল। কিন্তু কে জানতো রংপুরের বোলারদের সব জারিজুরি শেষ সখানেই।
এরপর কেবলই সাকিব এবং ইফতেখারের রাজত্ব। বল যেন এ দুজনের কথা শুনছিল। তাদের কথামতই যেন চলছিল বল। দুজন প্রথমে ইনিংস মেরামতের চেষ্টা করলেন। এরপর রানের দালান তুলে ফেললেন। যে দলটি শতরান পূরণ করতে পারবে কিনা তেমন শঙ্কার মধ্যে ছিল সে দলটি কিনা দুইশ ছাড়িয়ে গেল। শুধু দুইশ ছাড়িয়ে যাওয়া নয়। আর একরানের জন্য বিপিএলের সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর গড়তে পারল না। বিপিএলের সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর ২৩৯। যা ২০১৯ সালে এই চট্টগ্রামেই স্বাগতিক চট্টগ্রামের বিপক্ষে করেছিল। গতকাল সাকিব এবং ইফতেখার তাদের দলীয় স্কোরকে ২৩৮ রানে নিয়ে গেলেন। যা বিপিএলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দলীয় স্কোর। অবশ্য ২৩৮ রান করেছিল চট্টগ্রামও। সেটাও ২০১৯ সালে এই চট্টগ্রামে কুমিল্লা ওয়ারিয়র্সের বিপক্ষে।
গতকাল সাকিবের দল বরিশাল সে স্কোরে ভাগ বসাল। বরিশাল এবারের বিপিএলে দ্বিতীয়বার দুইশর বেশি রান করল। চট্টগ্রাম পর্বের প্রথম দিনেই স্বাগতিক চট্টগ্রামের বিপক্ষে ২০২ রান করেছিল সাকিবের দল। এর আগে ঢাকা পর্বে সিলেটও ২০১ রান করেছিল স্বাগতিক ঢাকার বিপক্ষে। ৪৬ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর রংপুরের বোলারদের উপর ঝড় বইয়ে দিয়েছেন সাকিব এবং ইফতেখার। ইনিংস মেরামত করতে করতে এক সময় দুজনের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কে আগে সেঞ্চুরি করবেন। তবে সে প্রতিযোগিতায় সাকিবকে পেছনে ফেলে দিলেন ইফতেখার।
তিনি তুলে নিলেন বিপিএলে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি। এবং এবারের আসরের তৃতীয় সেঞ্চুরি। সাকবিকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে ৮৯ রান করে। দুজন মিলে পঞ্চম উইকেটে যোগ করেন অবিচ্ছিন্ন ১৯২ রান। যা বিপিএলের পঞ্চম উইকেটতো বটেই সব মিলিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপ। সর্বোচ্চ গেইল আর ম্যাককালামের দ্বিতীয় উইকেটে ২০১ রান। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভিনসেন্ট আর শাহারিয়ার নাফিসের উদ্বোধনী জুটিতে ১৯৭ রান। পঞ্চম উইকেটে এটি সর্বোচ্চ পার্টনারশিপের রেকর্ড। ২৯ বলে হাফ সেঞ্চুরি করা ইফতেখার ফিরতে পারতেন ৪৬ রানে।
শামীম পাটোয়ারির সে ওভারে চারটি ছক্কা মারলেও শেষ বলে ক্যাচ দিয়েছিলেন। কিন্তু রনি তালুকদার সে ক্যাচ রাখতে পারেননি হাতে নিয়েও। তার পরের গুলোতো ইতিহাস। বেদড়ক পিটিয়েছেন সাকিব এবং ইফতেখার রংপুরের বোলারদের। ৪৫ বলে সেঞ্চুরি করেছেন ইফতেখার। মেরেছেন ৬টি চার এবং ৯টি ছক্কা। সেই ১০০ রানেই অপরাজিত থাকেন তিনি। আর সাকিব অপরাজিত থাকেন ৪৩ বলে ৯টি চার এবং ৬টি ছক্কার সাহায্যে ৮৯ রান করে। বোলারদের চরম হতাশার দিনে রংপুরেই পেসার হারিস রউফ এবং হাসান মাহমুদ নিয়েছেন দুটি করে উইকেট।
২৩৯ রানের টার্গেট তাড়া করে বিপিএলে জয়ের রেকর্ড নাই। আর সে লক্ষ্য তাড়া করতে যেভাবে শুরু করা দরকার সেভাবে শুরুও করতে পারেনি রংপুর রাইডার্স। ২৮ রানের মাথায় রান আউট হয়ে ফিরেন রনি তালুকদার। ফিল্ডিং এর সময় ইফতেখারের ক্যাচ মিস করা রনি করেছেন ১১ রান। পরের ওভারে পারভেজ হোসেন ইমন ফিরেন ১ রান করে মিরাজের হাতে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। সে ধাক্কা না সমালাতেই মিরাজের দ্বিতীয় শিকার হয়ে ফিরেন আরেক ওপেনার সাইম আইয়ুব। তিনি করেন ১৮ বলে ১৮ রান। স্বদেশী তরুণ মোহাম্মদ ওয়াসিমের বলে বোল্ড হয়ে শোয়েব মালিক যখন ফিরেন তখন রংপুরের রান ৬০। দলের প্রধান ভরসা হয়ে থাকা নাঈম শেখ ফিরেছেন অপ্রয়োজনীয় রান আউট হয়ে। ১৮ বলে ৩১ রান করেন তিনি। দুই বল পর মেহেদী হাসান ফিরেন ২ রান করে স্টাম্পিং হয়ে। সপ্তম উইকেটে নেওয়াজ এবং শামীম পাটোয়ারী ৫৭ রান যোগ করে পরাজয়ের ব্যবধানটা কমানোর চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ২৪ বলে ৩৩ রান করা নেওয়াজের বিদায়ে ভাঙ্গে এ জুটি। একটি চার এবং একটি ছক্কায় ৬ বলে ১৩ রান করে ফিরেন রবিউল। হারিস রউফ ফিরেছেন পরের বলেই। শেষ পর্যন্ত রংপুর থামে ১৭১ রানে। শামীম ফরাজিত ছিলেন ২৪ বলে ৪৪ রান করে। বরিশালের পক্ষে মিরাজ ২৬ রানে ৩টি এবং ওয়াসিম ৩১ রানে ২টি উইকেট লাভ করে।












