নগরের ষোলশহর রেল স্টেশন সংলগ্ন চশমা খালের পাড়ে চারতলা একটি ভবন হেলে পড়েছে। ‘ফেরদৌস প্লাজা’ নামে ভবনটিতে দাঁতের চিকিৎসকের চেম্বার ও মুদি দোকানসহ আটটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ভাড়ায় ছিল। গতকাল সকালে ভবন হেলে পড়ার খবর পেয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক এসে মালামাল সরিয়ে নেয়। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে ভবনটিতে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয় এবং সতর্কতামূলক ফিতা টেনে ঘেরাও করে দেয়।
ভবনের মালিকের দাবি, ভবনের পাশে চশমা খালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মেগা প্রকল্পের আওতায় কাজ চলছে। কাজ করার সময় পর্যন্ত ‘প্রটেকশন’ (সুরক্ষা) না দেয়ায় ভবন হেলে পড়েছে। তবে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার দাবি, সর্বোচ্চ প্রটেকশন দেয়া হয়েছে। ভবনের ডিজাইনের ত্রুটির কারণে হেলে পড়েছে। এদিকে সিডিএর সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক) চিঠি দেয়ার কথা রয়েছে।
গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে দেখা গেছে, প্রধান সড়ক থেকে ষোলশহর রেল স্টেশনে প্রবেশের মুখে চশমা খালের উপর একটি ব্রিজ আছে। ওই ব্রিজ ঘেঁষেই রয়েছে ফেরদৌস প্লাজা। পশ্চিমমুখী (প্রবেশ পথ) ভবনটির বাম পাশে খালের দিকে হেলে পড়েছে। এসময় উৎসুক লোকজন ভবনটির সামনে জড়ো হয়েছিলেন। ভবনে ভাড়ায় থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বের করছিল বিভিন্ন মালামাল।
ভবনটির নিচতলায় রয়েছে জাকির স্টোর নামে একটি মুদি দোকান, একটি ইজি লোডের দোকান, একটি ড্রাইভিং স্কুল এবং গ্যাসের ঠিকাদারের অফিস। এছাড়া দোতলায় দাঁতের চিকিৎসকের চেম্বার, তিন তলায় তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং চতুর্থ তলায় রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ৩৫তম ব্যাচের একটি কার্যালয়।
জাকির স্টোরের মালিক মো. জাকির হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, গতকালও (মঙ্গলবার) দোকান করেছি। আজ (বুধবার) সকাল ৬টায় দোকান খুলতে এসে তালা খুলতে পারছিলাম না। কারণ বিল্ডিং নিচের দিকে দেবে যায়। পরে অন্য পাশ দিয়ে খুলে ঢুকে দেখি দোকানের মাঝখানে বড় ফাটল। এরপর তাড়াহুড়ো করে মানুষজন ডেকে এনে দোকানের মালামাল কোনোভাবে বের করলাম। পরে দেখলাম পেছনের একটা দেয়াল পুরো ফেটে গেছে। একদম আলাদা হয়ে গেছে সেটা। এপার–ওপার দেখা যাচ্ছে। কর্নারে একটা মূল পিলারও ফেটে গেছে। তিনি বলেন, হঠাৎ করে এমন ঘটনায় খুব কষ্টে পড়ে গেছি। জিনিসপত্র কোনোভাবে সংরক্ষণ করেছি। সবার একই সমস্যা হয়েছে।
ভবনটিতে থাকা ইরেবু নামের আইটি ফার্মের স্বত্ত্বাধিকারী সাদরুল কবির উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, সকালে স্থানীয় দোকানি ফোন করে ভবন হেলে পড়ার কথা জানায়। এরপর ছুটে আসি। প্রতিষ্ঠানে ১৮টি কম্পিউটার, চেয়ার–টেবিলসহ নানা জিনিসপত্র আছে। হঠাৎ করে এসব নিয়ে কোথায় যাব বুঝতে পারছি না।
গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে উপস্থিত হয়ে দেখা যায়, তখনো কৌতুহলী লোকজনের ভিড় লেগেছিল। এসময় এক ব্যক্তি নিজেকে টেকনিশিয়ান পরিচয় দিয়ে জানান, ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকা দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারের বিভিন্ন জিনিসপত্র বের করতে পারলেও দুই–আড়াই লাখ টাকা দামের একটি ইক্যুপমেন্ট বের করতে পারিনি। ওটা খুলে বের করতে হয়। সেটা বের করার জন্য এসেছি। কিন্তু ফিতা টেনে ভবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় ঢুকতে পারছি না।
জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে ১ গন্ডা ৩ কড়া জায়গার উপর ভবন নির্মাণে অনুমোদন নেয়া হয়। ১৯৯০ সালে ভবন নির্মাণ করেন ফেরদৌস। বর্তমানে ভবনটি দেখভাল করেন তার ছেলে মো. খোরশেদ আলম বাপ্পী। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, সিডিএ মেগা প্রকল্পের কাজের জন্য সমস্যা হয়েছে। ওটার শিট ফাইল যেটা বসিয়েছে সেটা সঠিকভাবে বসায়নি, সাপোর্টিংটা ভালো হয়নি। ভবনের ডিজাইনের ত্রুটি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খোরশেদ আলম বাপ্পী বলেন, ডিজাইন ঠিক না থাকলে এত বছর বিল্ডিংটা কীভাবে ছিল। অতীতেও তারা কোনো সময় বলেনি ডিজাইন ঠিক ছিল না। এখন কেন বলছে?
ভবনের পরবর্তী কার্যক্রম প্রসঙ্গে ভবন মালিক বলেন, সিডিএ–সিটি কর্পোরেশন যেভাবে বলে সেরকম করব। কিন্তু আমার ক্ষতিপূরণটা যেন তাড়াতাড়ি পাই। এই ক্ষতিপূরণের উপর নির্ভর করছে ভবনের ছোট–বড় আটটি ভাড়াটিয়ার অ্যাডভান্স পরিশোধের বিষয়টি। মেগা প্রকল্পের আওতায় ইতোপূর্বে ভবন ভাঙা হয়েছে কীনা জানতে চাইলে বলেন, তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ২১ ফুট ৮ ইঞ্চি আমি নিজে ভেঙেছি।
সিডিএ’র অথরাইজড অফিসার–১ মোহাম্মদ হাসান আজাদীকে বলেন, ভবনটি নির্মাণের সময় যেভাবে ফাউন্ডেশন দেয়ার কথা ছিল সেভাবে দেয়নি। ভবনের প্রায় ২২ ফুট খালের মধ্যে ছিল। সেটা আগে ভাঙা হয়েছিল। বর্তমানে যে অংশ সেটা খালের মধ্যে নাই। ভবনের অনুমোদনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ভবন মালিক ১৯৮৬ সালের একটি অনুমোদনের কথা বলেছে। কিন্তু আমাদের দেখাতে পারেনি। সিডিএর পক্ষ থেকে পরবর্তীতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে কীনা জানতে চাইলে বলেন, ভবনটি বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। সেটা আমরা সিটি কর্পোরেশনকে জানিয়ে চিঠি দেব।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল শাহ আলীর কাছে মেগা প্রকল্পের কাজের কারণে ভবন হেলে পড়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, খালের মাটি কাটার কারণে বিল্ডিং হেলে পড়েনি। বরং বিল্ডিংয়ের সমস্যা আছে। খালে কাজ করার সময় আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ প্রটেকশন দিয়েছি। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ত্রুটি ছিল না। কিন্তু ভবনের ডিজাইনের ত্রুটির কারণে সমস্যা হচ্ছে। খালের পাড়ে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে যেভাবে ডিজাইন করার কথা সেভাবে করেনি তারা। ফলে খালের মাটি কাটার পর ফাইলিং ড্রাই করতে যে ভাইব্রেশন হয় তার প্রভাবে তাদের ভবন বসে যাচ্ছে। যদি ফাউন্ডেশন নির্দিষ্ট ডেফথে দিয়ে না থাকে তাহলে বসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেটাই হয়েছে এখানে।
লে. কর্নেল শাহ আলী বলেন, অবৈধ স্থাপনার অংশ হিসেবে ভবনের কিছু অংশ আমরা বছর দুয়েক আগে ভেঙেছিলাম। এখন আবার খাল বড় করতে গিয়ে ৮/১০ ফিট মত আমরা ভেঙেছি। সেটার ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। তার প্রক্রিয়া চলছে।
ফায়ার সার্ভিসের বায়েজিদ স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার কবির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কর্মীরা গিয়ে ভবনে কাউকে পায়নি। সবাই নিরাপদে বেরিয়ে গেছে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে ডিসেম্বর মাসে মাদারবাড়ি এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ চলাকালে খালের পাশের দুটি ভবন, একটি মন্দির ও একটি কাঁচা ঘর হেলে পড়েছিল।