ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) ও তাঁর অবদান
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র পরিচিতি: তাঁর নাম আবদুল্লাহ উপনাম, আবু বকর উপাধি সিদ্দিক, সত্যবাদী (সর্বপ্রথম মিরাজের ঘটনার সত্যতায় বিশ্বাসী) আতিক (মুক্তিপ্রাপ্ত) জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত, নবীজি তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি, তখন থেকে তিনি আতিক নামে ভূষিত। (তিরমিযী হাদীস নং: ৩৬১০)
তাঁর পিতার নাম আবু কুহাফাহ, মাতার নাম উম্মুল খায়র সালমা, পিতা-মাতা উভয়ের দিক দিয়েই তার বংশধারা উর্দ্বতন সপ্তম পূরুষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। (তারিখুল খোলাফা, আরবি, পৃ: ২১) তাঁর পিতা পুত্র প্রোপুত্র সকলেই সাহাবী।
সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবী: রয়স্কদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী হযরত আবু বকর (রা.), মহিলাদের মধ্যে সর্বপ্রথম হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা.), বালকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী, হযরত আলী (রা.)। (আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড:২য়, পৃ: ১৫৩)
আল কুরআনের আলোকে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র মর্যাদা: নবীদের পর উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মর্যাদাবান ও সৌভাগ্যবান সম্মানিত ব্যক্তি হলেন হযরত আবু বকর (রা.)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা, ইসলামের জন্য তাঁর ত্যাগ কুরবানী ও অবদান উম্মতের মধ্যে সর্বদিকে দিয়ে অতুলনীয়। তাঁর মর্যাদা ও অবদান উল্লেখ করে অসংখ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছিলেন যখন তাকে কাফিররা বের করে দিয়েছিলো।
তিনি ছিলেন দুজনের একজন যখন তারা উভয়ে গুহার ভেতরে ছিলো সে তাঁর সাথীকে বললো চিন্তা করোনা, আল্লাহ আমাদের সাথেই রয়েছেন এরপর আল্লাহ তার অন্তরে তার পক্ষ থেকে সান্ত্বনা নাযিল করলেন এবং তাঁর সাহায্যে এমন বাহিনী পাঠালেন যা তোমরা দেখতে পাওনি। (আল কুরআন, ৯ সূরা তাওবাহ, ৪০)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক সাহাবী হওয়াটা আল কুরআনের অকাট্য আয়াত দ্বারা প্রমানিত। তাঁর সাহাবী হওয়া অস্বীকার করা কুরআন অস্বীকার করার শামিল। তাঁকে সাহাবী হিসেবে অস্বীকার কারী কাফির হিসেবে গন্য হবে।
রাফেযী ও শিয়ারা তাঁর সাহাবী হওয়া স্বীকার করেনা ও তাঁর শানে গালমন্দ ও কটূক্তি করার কারনে কাফির হিসেবে গণ্য। (আনোয়ারুল বায়ান, খন্ড:২য়, পৃ: ১৫৬)
আল্লাহ তা’আলা তাঁর শানে আরো উল্লেখ করেছেন, “যারা সত্য নিয়ে আগমন করেছে এবং সত্যকে যারা মেনে নিয়েছে তারাই তো মুত্তাকী। (আল কুরআন, ৩৯, সূরা: যুমার: ৩৩)
অতুলনীয় দানশীলতা: হযরত সিদ্দিকে আকবর (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর সমুদয় ধন-সম্পদ, জীবন-যৌবন সবটুকু ইসলামের খিদমতে নবীজির কদমে উৎসর্গ করেন। ইসলাম গ্রহণের সময় তাঁর নিকট চল্লিশ হাজার দিনার নগদ মওজুদ ছিল। ঈমান গ্রহণের পর রাত্রে দশ হাজার, দিনে দশহাজার, গোপনে দশ হাজার, প্রকাশ্যে দশ হাজার আল্লাহর পথে উৎসর্গ করে দেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রশংসায় পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করেন, “যারা নিজেদের ধন-সম্পদ রাত্রে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে তাদের পূণ্যফল তাদের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দু:খিত ও হবেনা।” ২ বাকারা, পারা:-৩, আয়াত: ২৭৪)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) তাঁর জীবন ধন-সম্পদ সবটুকুই ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন নবীজি তাঁর আবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বলেছেন, “ আমি কারো সম্পদ দ্বারা সেই পরিমান উপকৃত হইনি যতটুকু উপকৃত হয়েছি আবু বকরের সম্পদ দ্বারা। (তিরমিযী, হাদীস : ৩৫৯৪, মিশকাত শরীফ: পৃ: ৫৪৪)
তিনি ছিলেন নবীজির নিত্য সঙ্গী: তিনি সুখে দু:খে আপদে বিপদে হিজরতের রজনীতে সাওর পর্বতের গুহায় নবীজির সাথী ছিলেন। ওফাতের পরও নবীজির সাথে আছেন, নবীজি তাঁকে উদ্দেশ্য করে এরশাদ করেছেন, হে আবু বকর তুমি হাউযে কাউসারের কিনারায় আমার সাথী হবে। যেভাবে তুমি সাওর গুহায় আমার সাথী ছিলে। (তিরমিযী, খন্ড: ২য়, পৃ: ২০৮)
প্রিয় নবীজির তিনটি প্রিয় জিনিস: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন। তোমাদের দুনিয়ার তিনটি জিনিষ আমার নিকট অধিক প্রিয়। ১: সুগন্ধি, ২. নারী জাতি, ৩. নামাযে আমার চক্ষুর শীতলতা। (নাসাঈ শরীফ, খন্ড: ২, পৃ: ৭৭)
নবীজির অদ্বিতীয় আশেক হযরত আবু বকর সিদ্দিক এ অমূল্য বানী শ্রবণ করে বললেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি সত্য বলেছেন, তবে আমার নিকট দুনিয়ার তিনটি জিনিস সবচেয়ে অধিক প্রিয়। ১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার চেহারা মুবারকের প্রতি দিদার লাভ করা। ২. আমার ধন-সম্পদ আল্লাহর রসূলের জন্য উৎসর্গ করা। ৩. আমার কন্যা আয়েশা সিদ্দিকা রাসূলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র বিবাহে থাকা। (মুনাব্বিহাতত, আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী, আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:২, পৃ: ১৬৬)
প্রতিটি নেক আমলে ছিলেন অগ্রগামী: হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) যে কোন নেক আমল সম্পাদনে সদা সচেষ্ট থাকতেন কোনো প্রকার অবহেলা উদাসীনতা বিলম্বতা তাঁর মাঝে পরিলক্ষিত হতনা। তিনি ছিলেন নবীজির জীবনাদর্শের এক উজ্জ্বল নমুনা। হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা:) কে জিজ্ঞেস করলেন, আজকের দিনে তোমাদের মধ্যে কে রোজাদার আছো? আবু বকর (রা:) বললেন, আমি, নবীজি আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজকের দিনে তোমাদের মধ্যে কে জানাযায় অংশগ্রহণ করেছো? আবু বকর (রা:) বললেন, আমি।
নবীজি জিজ্ঞেস করলেন, আজকের দিনে তোমাদের মধ্যে কে মিসকীনকে খাবার দিয়েছো? তিনি বললেন, আমি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবার জিজ্ঞেস করলেন, আজকের দিনে তোমাদের মধ্যে কে অসুস্থ ব্যক্তির সেবা করেছো? আবু বকর (র:) বললেন, আমি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তির মধ্যে এতগুলো নেক আমল একত্রিত হবে সে জান্নাতেই প্রবেশ করবে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস :-১৭০৭)
ওয়াকিদি ও হাকিম কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে, মাহবুবে মুস্তফা আবু বকর সিদ্দিক (রা:) ৭ জমাদিউস সানী ১৩ হিজরিতে গোসল করলেন শীতের প্রচন্ড তীব্রতায় তিনি জরাক্রান্ত হলেন, দীর্ঘ পনের দিন অসুস্থ ছিলেন অবশেষে হিজরি ১৩ সনের ২২ জমাদিউস সানি ৬৩৪ খ্রি. মুতাবিক ২৩ আগষ্ট সোমবার ৬৩ বছর বয়সে মাওলায়ে হাকিকীর সান্নিধ্যে গমন করেন। দু বছর তিন মাস দশ দিন মতান্তরে দু বছর তিন মাস ছাব্বিশ দিন ইসলামী খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পালন করে বিশ্বববাসীর জন্য অনুস্মরনীয় আদর্শের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যান। আল্লাহ তা’আলা আমাদের কে রাসূলুল্লাহর এ মহান সাহাবীর আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ আবদুল জব্বার
বাহুলী, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: মৃত্য ব্যক্তিকে গোসলদানকারীর ফযীলত কি? কে কাকে গোসল দিবে? গোসল প্রদানকারী বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ কিনা?
উত্তর: মৃত ব্যক্তিকে গোসল প্রদানকারীর বিশেষ ফযীলতের কথা হাদীস শরীফে উল্লেখ রয়েছে। রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মৃত ব্যক্তিকে গোসল প্রদানকারী ব্যক্তি গুনাহ থেকে এমনভাবে পবিত্র হয়ে যাবে যেমন যেদিন তার মা তাকে নিষ্পাপ প্রসব করেছিল। (মুজামুল আওসাত লিত তাবরানী, হাদীস: ৯২৯২)
গোসল প্রদানকারী ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির দোষ ক্রটি গোপন রাখলে আল্লাহ তা’আলা তাঁর চল্লিশটি গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (মুজামুল কবীর, হাদীস নং: ৯২৯)
গোসল প্রদানকারী ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির নিকটাত্মীয় হওয়া উত্তম। এমন ব্যক্তি পাওয়া না গেলে অন্য ব্যক্তি যিনি মুত্তাকি পরহেজগার তিনি গোসল দেবেন। (আলগীরি,খন্ড:১ম, পৃ:১৫৯)
পুরুষ-পুরুষকে গোসল দিবে। মহিলা-মহিলাকে গোসল দিবে। তবে ছোট ছেলেকে মহিলাও গোসল দিতে পারবে। এবং মেয়ে যদি ছোট হয় পুরুষও তাকে গোসল দিতে পারবে। (আলমগীরি, খন্ড:১ম, পৃ: ১৬০)
মৃত ব্যক্তিকে কোন বিনিময় ছাড়া গোসল দেওয়া উত্তম। গোসল প্রদান করার মতো যদি অনেক লোক থাকে সেক্ষেত্রে বিনিময় গ্রহণ জায়েজ। আর যদি একজনই থাকে সেক্ষেত্রে বিনিময় গ্রহণ জায়েজ নেই। (আলমগীরি, ওয়াকারুল ফতোওয়া, খন্ড:২য়, পৃ: ৩৩৯)