কক্সবাজার সৈকত হারাচ্ছে রিডলির ‘আরিবাদা’

আশংকাজনক হারে কমছে মা কচ্ছপ আর ডিম

কক্সবাজার প্রতিনিধি | বুধবার , ১১ জানুয়ারি, ২০২৩ at ৪:১৮ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন সৈকতে এক যুগ আগেও শীত মৌসুমে শত শত কাছিমের দেখা পাওয়া যেত। প্রতি বছর, একই স্থানে এবং একই সময়ে রিডলি সামুদ্রিক কচ্ছপ দলে দলে সৈকতে এসে বাসা বাঁধত এবং ডিম পেড়ে আবার সাগরে চলে যেত। কেম্পস রিডলি ও অলিভ রিডলি প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিমের এই অনন্য আচরণ আরিবাদা নামে পরিচিত। স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থসমুদ্রপথে আগমন। রিডলির আরিবাদা বিশ্বের বিস্ময়গুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়।

কক্সবাজারস্থ বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, বিশ্বে সবচেয়ে বড় আরিবদার রেকর্ড রয়েছে মেক্সিকোর রাঞ্চো নুয়েভো সৈকতে। ১৯৪০ এর দশকের এখানে একসঙ্গে ও একরাতে ৪০ হাজারের বেশি রিডলি কাছিম ডিম পাড়তে আসে। আর সাম্প্রতিককালে এই সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। সে তুলনায় কঙবাজার সৈকতে ব্যাপক আকারে কমে গেছে আরিবাদা। বিষয়টি আশংকাজনক বলে জানান তিনি।

কঙবাজার সৈকতে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে কাছিম সংরক্ষণে কাজ করছে বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজোর্ভেশন এন্ড ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। সংস্থাটির আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোহাম্মদ শফিক এর মতে, মাত্র এক দশক আগেও সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত কঙবাজার উপকূলের অন্তত ৫৪টি পয়েন্টে শীত মৌসুমে ডিম পাড়তে আসতো শত শত মা কচ্ছপ। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে অন্তত ১৩টি পয়েন্টে কচ্ছপের দেখা মিলছে না। বাকী পয়েন্টগুলোতেও ডিম পাড়ছে খুব কম। গত মৌসুমে কঙবাজার থেকে টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপ সৈকত মিলে মাত্র ৪৯টি রিডলি কাছিম ডিম পাড়তে আসে এবং তারা মাত্র ৬৭৬৩টি ডিম পাড়ে।

সংস্থাটির ইকোলাইফ প্রকল্পের জেলা ব্যবস্থাপক জৈব সমুদ্র্রবিজ্ঞানী আবদুল কাইয়ূম বলেন, কঙবাজারের ‘ভার্জিন আইল্যান্ড’ খ্যাত সোনাদিয়া দ্বীপটি সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার জন্যও বিখ্যাত। এ দ্বীপের পূর্বপাড়া, পশ্চিম পাড়া, বদরখালীপাড়া, মগচর ও বেলেকের দিয়া; এই ৫টি পয়েন্টে ডিম পাড়ে কচ্ছপেরা। গত ছয়সাত বছর আগেও এসব পয়েন্ট থেকে প্রতিবছর কাছিমের ডিম পাওয়া যেতো ১০ থেকে ১২ হাজার, আর গত মৌসুমে পাওয়া গেছে মাত্র ৮শ ডিম। আর চলতি মৌসুমে কঙবাজার সৈকতের পেঁচারদ্বীপেই প্রথম ডিম পাড়তে আসে মা কাছিম। এই সৈকতে গত ৩ জানুয়ারি ও ৬ জানুয়ারি দুটি কাছিম ডিম পাড়তে আসে এবং তারা যথাক্রমে ১২৫টি ও ১২৯টি ডিম দেয়।

সম্প্রতি কঙবাজার সৈকতে রিডলি কাছিমের আরিবাদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি গত ৫ বছর ধরে হঙবিল টার্টল বা ভুত কাছিমের দেখা মিলছে না। এছাড়া গত ২ বছর ধরে সবুজ রঙা কাছিমেরও দেখা মিলছে না বলে জানান নেকমের সমুদ্র্রবিজ্ঞানী আবদুল কাইয়ূম।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ও সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর জানান, সারা বিশ্বের সাগরে প্রায় সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ সাতাঁর কেটে বেড়ায়। তবে আমাদের বঙ্গোপসাগরে রেকর্ড রয়েছে পাঁচ প্রজাতির। এরমধ্যে কঙবাজার সৈকতে অলিভ টার্টল বা জলপাই রঙা কাছিম, গ্রিন টার্টল বা সবুজ রঙা কাছিম এবং হঙবিল বা ভুত কাছিম ডিম পাড়তে আসতো। তিনি জানান, জলপাই রঙা রিডলি কাছিম কঙবাজার সৈকতে এবং সবুজ রঙা কাছিম ও ভুত কাছিম সেন্টমার্টিনেই বেশি দেখা যেত। তবে মাঝেমধ্যে হিমছড়ি ও পেঁচারদ্বীপেও সবুজ রঙা কাছিমের দেখা মিলেছে বলে জানান তিনি।

নেকম কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ শফিক এর মতে, এক দশক আগেও কঙবাজার উপকূলে ডিম পাড়তে আসা তিন প্রজাতির কাছিমের মধ্যে ৯৯% ভাগই ছিল অলিভ রিডলি টার্টল। বাকী একভাগ ছিল গ্রিন টার্টল ও হঙবিল টার্টল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেবল এক প্রজাতির কাছিমই ডিম পাড়তে আসছে কঙবাজার সৈকতে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা আইইউসিএন’র তালিকায় হঙবিল টার্টলের অবস্থান রেডলিস্টে।

একটি স্বাস্থ্যকর সমুদ্রের প্রয়োজনীয় অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত সিটার্টল বা সামুদ্রিক কচ্ছপ। এটি পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, সামুদ্রিক কচ্ছপ পানির বাইরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরা স্থলে ও সমুদ্রে একটি খাদ্য জালের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে কাজ করে। এরা সৈকতের বালিয়াড়িতে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ার মাধ্যমে সৈকতকেও পরিবেশগতভাবে সাহায্য করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসব নাগরিক পাবেন স্বাস্থ্য কার্ড
পরবর্তী নিবন্ধচবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচন ৮ ফেব্রুয়ারি