ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যখন তাঁর ৩২নং ধানমণ্ডির বাসভবনে অবস্থান করেছিলেন তখন তাকে দেখতে গেলাম আমি ও আমার ফুফাতো ভাই চৌধুরী শওকত আলী। আমি তখন চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। সেই সুবাদে এক দফা আন্দোলনের প্রবক্তা চট্টল শার্দ্দুল মরহুম এম.এ. আজিজ আমার রাজনৈতিক গুরু। আত্মীয়তার সূত্রে জননেতা মরহুম জহুর আহমেদ চৌধুরীর ও আমি ছিলাম স্নেহভাজন। সকাল বেলায় যখন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম তখন তিনি নীচ তলার বারান্দায় বসে একটি বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন। কোনো বাধা বিঘ্ন ছাড়াই আমরা তাঁর কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে পরিচয় জানাতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বাড়ির চারপাশের ফুলের বাগান ঘুরে ঘুরে দেখালেন প্রকৃতিপ্রেমী, দেশপ্রেমী মানুষটি। বললেন– গোলাপ তাঁর খুবই প্রিয়। তখন তিনি সর্দিতে ভুগছিলেন মনে হলো। কারণ রুমাল দিয়ে ঘন ঘন নাক মুছছিলেন। এরপর ‘রেনু’ ‘রেনু’ বলে ডাকলেন তার সহধর্মীনিকে, বললেন দেখ– এরা চাঁটগা থেকে এসেছে আমায় দেখতে। তখন বয়সে খুবই তরুণ হলেও আমার সাহস ছিল অসীম। ছোটবেলা থেকেই জেদী হিসেবে আমার বদনাম আছে। কথা প্রসঙ্গে আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, চট্টগ্রাম এলে কাট্টলী কর্ণেলহাট মাঠে একটি জনসভা করতে হবে। কারণ শিল্প এলাকা হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। আমার পীড়াপীড়িতে তিনি শুধু হাসলেন আর মাথা নাড়লেন। সেই স্মৃতি আমার মানসপটে এখনও জ্বল জ্বল করছে দিবালোকের মতো। আমাকে খুশী করার জন্য যেন মনে হলো তিনি শুধু বললেন, আচ্ছা দেখা যাক। এর কিছুদিন পর তিনি চট্টগ্রাম এলেন, উঠলেন ‘হোটেল শাহজাহানে’। আমার ছোট বোন লতিফা মাবুদ (আঙ্গুর) কে নিয়ে আমি সেখানে তাঁকে দেখতে গেলাম। সে আমার শেখানো একটি বক্তৃতা বঙ্গবন্ধুকে শুনালো–এতে তিনি খুব খুশী হলেন। তখন তিনি কতিপয় শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি পেয়েছেন। জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি আমাকে এবং আমার ছোট বোনকে খাটের পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। আমি সাথে সাথে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম তাঁর ৩২নং বাড়িতে আমার সেই পুরোনো আবদারের কথা। আপনাকে কাট্টলী যেতে হবে। তিনি তখন পাশে বসা মরহুম এম.এ আজিজকে বললেন– আজিজ দেখতো ছেলেটা কী বলে? যাঁর কাছে আমার রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি সেই এম.এ আজিজকে আমি মামা বলে ডাকতাম। তিনি একটু চিন্তা করে বলে ফেললেন ঠিক আছে আগামীকাল বিকেলে বঙ্গবন্ধু কাট্টলী যাবেন এবং কর্ণেল হাটের নতুন ছাত্রলীগ অফিস উদ্বোধন করবেন। আমি আনন্দে দিশেহারা। আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অবস্থা। সাথে সাথে ছুটে এলাম গ্রামে। পরদিন বঙ্গবন্ধু কাট্টলী আসছেন সেই সংবাদ যেন বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে। চট্টগ্রামের কাট্টলী ছাত্রলীগ তখন থেকেই খুব সক্রীয় সংগঠন এর প্রতিটি কর্মী ও নেতারা ছিল নিবেদিত প্রাণ। ঢাকা ট্রাংক রোডে বিশাল এক তোরণ নির্মাণ করা হলো যার গায়ে লাল ব্যানারে লিখা ছিল– ‘এশিয়ার লোহ মানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কাট্টলী আগমন বার্তা’। পরদিন সন্ধ্যায় তিনি এলেন সাথে মরহুম এম.এ. আজিজ ও আলহাজ্ব জহুর আহমেদ চৌধুরী। সমস্ত এলাকা লোকে লোকারণ্য। ফিতা কাটার কাঁচি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছোট বোন মজিদা নোমান (আনার)। মুহূর্মুহূ করতালি আর শ্লোগানে মুখরিত হাজার হাজার জনতার উপচে পড়া ভিড়ে ছাত্রলীগ অফিস উদ্বোধন করা হলো। সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন তিনি। আমার জীবন পাতায় সেই স্মৃতি অক্ষয় অম্লান হয়ে রইলো। নিজেকে ধন্য মনে হলো তাঁর কাট্টলী আগমনে। বঙ্গবন্ধু তনয়া আওয়ামীলীগ প্রধান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগমনেও ধন্য হয়েছে আমার এ কাট্টলী গ্রাম।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সহ–সভাপতি,
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি।












