(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
তিনি অনর্থক খানকা শরীফে বসে গল্প গুজব পছন্দ করতেন না। এই রকম কিছু দেখলে সাথে সাথে বলে ফেলতেন, নামায, তকরির, মুনাজাত শেষ হয়েছে। এখানে অহেতুক গল্প গুজব না করে যার যার কাজ কর্মে ছড়িয়ে পড়। ১৯৮৬ সনে বাংলাদেশে হুজুর কেবলার শেষ সফর। ঢাকায় মাদ্রাসা–এ কাদেরিয়া থেকে নাস্তা করে স্বদেশে ফিরে যাবেন। ফজর নামাজের মুনাজাত শেষে আমরা সবাই কাঁদছিলাম। তিনি মিম্বর থেকে উঠে হঠাৎ পিছনে ফিরে ক্রন্দনরত পীর ভাইদের উদ্দেশ্যে বললেন– তোমরা কাঁদতেছ কেন। নামাজ পড়– ছবক যা দেয়া হয়েছে তা পালন করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। বাতিলের প্রতিরোধ কর। এমন কিছু কর না– যাতে রোজ কেয়ামতে আমাকে শরমিন্দা হতে হয়। বুঝলাম হুজুর কেবলা আর আসবেন না। কর্মকর্তারা প্রায়ই ছিরিকোট যেত। ফিরে এসে আশেকান পীর ভাইদের প্রবোধ দেয়ার জন্য বলত– আগামী বৎসর তিনি আসবেন। কিন্তু বৎসর যায়– হুজুর কেবলা আর আসেন না। খবর পেলাম তিনি অসুস্থ। ১৯৯০ সালে তাই বেকারার হয়ে ভাই আজিজের নেতৃত্বে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট টীম হুজুরকে দেখার জন্য ছিরিকোট শরীফ যাওয়া হলো। প্রসঙ্গত হুজুর কেবলা কে–কে আসছে আগে থেকেই খবর নিয়ে রেখেছেন। এবং নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন রাতে যাতে পিন্ডি থেকে রওয়ানা না হই। পথে আফগান উদ্বাস্তুরা– সুযোগ পেলে লুটপাট করে। তাই রাওয়ালপিন্ডিতে রাত কাটাতে হলো এক ধনী মার্বেল পাথর ব্যবসায়ী পীরভাই মরহুম ওসমান গণির বাসায়। পরদিন সকালের নাস্তা, দুপুরের খানা খেয়ে সিরিকোটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
মাগরিবের আগে দরবার শরীফ পৌঁছলাম। শুকরিয়া জানালাম আল্লাহ্র কাছে। নীচে মেহমান খানায় সবাই। আমাদের তিনজন আমি, মেট্রোপোল কমিউনিটি সেন্টারের মালিক জনাব লতিফ সাহেব, আরামিট লি: এর কর্মকর্তা আমার বন্ধু আলী ইমাম এর জায়গা হল নতুন ভবনের দোতলায়– যাতে এসি ও আধুনিক ওয়াশ রুম দেখে কৃতজ্ঞতা জানালাম। এদিকে মাগরিবের নামাজ ও সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মাজার জিয়ারত শেষে রুমে এলাম– সাথে সাথে নীচে চা–নাস্তার ডাক পড়ল। হুজুরের সাথে দেখা হত– সকালে নাস্তার সময়। প্রথমে সালাম বিনিময়। খাটে বসা কোমর থেকে পা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা। বললেন ‘এখানে আসা অনেকটা কষ্টকর, কিন্তু ফায়দা বেশী।’ তারপর দিন ছিরিকোটী রাহ্মাতুল্লাহি আলায়হি–এর ওরশ মোবারক। দরবারের আদব, সিস্টেম, শৃঙ্খলা, সময়নিষ্ঠা দেখে আপ্লুত হলাম। ওরশের দিন কোথায় গরু–ছাগল জবাই হয়েছে, কোথায় রান্না হচ্ছে ধোঁয়া পর্যন্ত দেখলাম না। খাওয়ার সময় হতেই দেখলাম পিল পিল করে মানুষ পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে। নীচের খালি জায়গায় রশির চারপায়ায় চারজন বসে তবরুক খেয়ে নীরবে চলে যাচ্ছে। না আছে কোন হাঁক ডাক, চিল্লাচিল্লি। আমাদের এখানে তো এই অবস্থা নেই। দরবারে বেশী থাকা আমাদের কাছে সমীচীন মনে হয়নি। যেহেতু এখানে রান্না বান্নার জন্য কোন কাজের মেয়ে নেই। ঘরের মেয়েরাই রান্না–রান্না করেন। আর পরিবেশন করেন সাহেবজাদাগণ। কাঁধে রুটির ডালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমাদের লজ্জা করত। যাই হোক ৪ দিন পর হুজুর কেবলা থেকে বিদায় নিয়ে ছিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মাজার জেয়ারত শেষ করে গাড়ীতে উঠলাম। পথে হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মাজার জেয়ারত ও জোহরের নামাজ শেষে মাজার কর্তৃপক্ষের দেয়া আপ্যায়ন শেষ করে রাওয়ালপিন্ডি, লাহোরে হযরত দাতা গঞ্জেবখশ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মাজার জেয়ারত, ড. ইকবালের কবর জিয়ারত ও দিল্লীতে হযরত নিজাম উদ্দীন আউলিয়া ও হযরত বখতিয়ার কাকী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মাজার জেয়ারত শেষে কোলকাতা হয়ে দেশে ফিরে এলাম। কাজী সাহেবের সাথে দেখা হতেই বলল– তুই’ত হুজুরের সাথে দেখা করে আসলি– আমি ‘ত পারলাম না। কিভাবে তাকে প্রবোধ দিই। বললাম কপালে থাকলে তুইও পারবি।
২০০৪ সনে তাহের শাহ্ হুজুর কেবলা (ম.) এক চিঠির মাধ্যমে আমাকে জামেয়ার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব প্রদান করেন। আমি তো প্রথমে বিশ্বাস করিনি। আমার থেকে বহু যোগ্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও। তখন আমি কাপ্তাই–এ গাউসিয়া কমিটির সদস্যদের সাংগঠনিক ট্রেনিং– কাজে নিয়োজিত। যেহেতু আমি বিশ্ব শিক্ষক সংগঠনের উদ্যোগে ও অর্থায়নে শ্রীলংকায় লীডারশীপ ট্রেনিং প্রাপ্ত। আনজুমান কর্তৃপক্ষের অনুরোধে অন্যান্য গাউসিয়া কমিটির নেতৃবৃন্দের সাথে আমাকে সেখানে যেতে হয়েছিল। ফিরতি পথে সেক্রেটারী জেনারেল মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন এর টেলিফোন। তোকে জামেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে না করিস না। রাত্রে বাসায় ফিরলে আমার স্ত্রী আমাকে বাসায় আনোয়ার সাহেবের টেলিফোনের খবরটি জানাল। দায়িত্ব নেয়ার পর সেক্রেটারী জেনারেল এর সার্বিক সহযোগিতা ও পরামর্শ আমি চিরদিন স্মরণ রাখব। তার পরদিন আনজুমান অফিসে গেলে সবার প্রিয় মরহুম রশীদুল হক খবরটি জানিয়ে আমাকে বললেন– যেন এ দায়িত্ব সানন্দে গ্রহণ করি। যাই হোক দু’দিন পর জামেয়ায় গেলাম– দেখি হৈ. চৈ. আর মাদ্রাসার দরজা–জানালা ভাঙচুর চালাচ্ছে একদল যুবক। নীচে আনজুমানের শাখা অফিসে গিয়ে দেখি লোকমান মুহাম্মদ ইব্রাহীম সাহেব বসা। বললাম চলুন প্রিন্সিপাল অফিসে যাই। তিনি বললেন দেখছেন না মাদ্রাসা ভাঙচুর চলছে। বললাম কলেজে থাকতে ঘেরাও–এর অভিজ্ঞতা আমার আছে– চলুন যাই। তাঁকে সহ যাওয়ার সময় দেখলাম দরজা জানালা ভাঙচুর এর নমুনা। জিজ্ঞাসা করলাম এরা কারা? উত্তর এল মাদ্রাসার কিছু উশৃঙ্খল ছাত্র ও বাইরের কিছু ছাত্র মিলে এ কান্ড ঘটিয়েছে।
ভিতরে ঢুকে দেখলাম কিছু সংখ্যক উশৃঙ্খল ছাত্র অধ্যক্ষের সাথে বাক বিতন্ডায় লিপ্ত। এইভাবে প্রায় দুই ঘন্টা বসে সব শুনছিলাম। তার পর তারা চলে গেল। পরে এদেরকে নিয়ে কোর্ট কাচারি হয়েছিল। আর এটাই আমার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা।
আমার নিয়োগ নিয়ে কাজী সাহেবের একটু মর্মবেদনা ছিল। একদিন আমাকে বলেই ফেল্ল। তোকে আমি হাত ধরে তৈয়ব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির হাতে বায়াত করালাম– আর নেয়ামত তুই পেয়ে গেলি। কিছুই বললাম না। এদিকে রাউজান দারুল ইসলাম কামিল মাদ্রাসায় সভাপতি–এর পদ খালি। আমরা চেয়েছিলাম কাজী সামশুকে পদটি দিতে। কিছুটা প্রতিরোধ আসল বিভিন্ন মহল থেকে। অনেক কষ্টে আনজুমান নেতৃবৃন্দের সহায়তায় তাকে উক্ত মাদ্রাসার জি.বি.-র সভাপতি পদে সমাসীন করা হল। কাজী সামশু আমৃত্যু এর উন্নয়নের জন্য পরিশ্রম করে গেছেন। তার দাফনের দিন মাঠ সহ বহুতল বিশিষ্ট একাডেমিক ভবন দেখে আপ্লুত হয়েছি। জানাযা ও মাগরিবের ক্ষণিক আগে তাকে তার পিতা হুজুরের মুরীদ মরহুম কাজী আবদুল গণির পাশে সমাহিত করা হয়। আমার সাথে উপস্থিত ছিল চট্টগ্রাম জেলার কলেজ শিক্ষক সমিতির বর্তমান নেতৃবৃন্দ। এক সময় আমি যখন প্রথমে সম্পাদক ও পরে চট্টগ্রাম কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি সেই সময়ে কাজী সামশু সমিতির একজন কর্মকর্তা, পরে সরকারী কমার্স কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতির সদস্যের পদ অলংকৃত করে। এছাড়া সে আনজুমানের প্রেস এণ্ড পাবলিকেশন সেক্রেটারী পদে থেকে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।
প্রসঙ্গত আমি যখন সঙ্গত কারণে স্বেচ্ছায় জামেয়ার চেয়ারম্যানের পদ হতে পদত্যাগ করি। পদত্যাগ পত্র পাওয়ার সাথে সাথে সেক্রেটারী জেনারেল আমাকে ফোন করে পদত্যাগ পত্র পরিহার করার জন্য বারবার জোর তাগিদ দেন। যতরকমের আবদার, অনুরোধ এবং বন্ধু হিসেবে নির্দেশও প্রদান করেন। তাছাড়া কাজী সামশুর রহমান সেক্রেটারীর সাহেবের সুরে আমাকে পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করে। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। কি কারণে আমি পদত্যাগ করেছি তা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উপলক্ষে হুজুর কেবলা তাহের শাহ্ (ম.) হুজুর কেবলা ছাবের শাহ্ (ম.) ও সাহেবজাদা কাসেম শাহ্ (ম.) বাংলাদেশে অবস্থানকালে– হুজুর কেবলা ছাবের শাহ্ (ম.) সাথে একান্ত বৈঠকে সম্যক সবকিছু মুখে ও লিখিত আকারে বিনীতভাবে অবহিত করি। এরপর তিনি ১৬ অক্টোবর ২০২২ আনজুমান কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় আমাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করেন। এ প্রসঙ্গে হুজুর কেবলা সাবির শাহ্ (ম.জি.আ.) বলেন The Chairman of Jamea, Professor Mohammad Deedarul Islam has already been relieved of his Post as Chairman. We respect and exress our gratitude ot him for the way he has carried out his duties with Sincerely while he has been in charge. He said that he expressed his opinion in the meeting that he should be given an honur in recognition of his or not. It should be noted that the present members agreed with the opinion of Huzur Keblaye Alam. এরপর ২১শে অক্টোবর জামেয়ার জুলুস মাঠে অগণিত পীর ভাইদের উপস্থিতিতে বাদ এশা নামাজের পর হযরত তাহের শাহ্ (ম.) হযরত ছাবের শাহ্ (ম.) ও সাহেবজাদা কাসেম শাহ্ (ম.) এর উপস্থিতিতে আমাকে একটি ক্রেস্ট ও একটি সার্টিফিকেট দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মানিত করেন। যা কিছু জামেয়ার জন্য করেছি তা অতি নগণ্য। আরও কিছু করার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু পারিনি। এরিমধ্যে খবর পাই বন্ধু কাজী সামশু অসুস্থ অবস্থায় ঈ.ঝ.ঈ.জ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। হাসপাতালে তাকে দেখতে যাই। মাইল্ড হার্ট এটাক্ ও অন্যান্য উপসর্গ। আমি তখন ওখানে উপস্থিত বড় মেয়েকে বলি– যদি সম্ভব হয় বাবাকে ঢাকা নিয়ে যাও। এরপর আমার স্ত্রীকে নিয়ে পর পর আরও দু’বার তার বাসভবনে যাই। ইতিমধ্যে তাকে ভারতের চেন্নাই নেয়া হয়েছে। হাসপাতালে ৪ নভেম্বর ভোর ৬.৩০ মিনিট কাজী সামশু ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি. …..)। আমি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহ্ তা‘আলা তার সকল খেদমতের বিনিময়ে তাকে বেহেশত্ নসীব করুন। আমিন।
লেখক : জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসার প্রাক্তন চেয়ারম্যান।