তথ্যে সত্যে উজ্জ্বল স্বদেশ ও নববর্ষের প্রার্থনা
আমরা আরেকটি নতুন বছরে পা রেখেছি। বাংলা নববর্ষ আমাদের উৎসব আমাদের অস্তিত্ব। কিন্তু বছরের হিসেব নিকেশ এমন কি জাতীয় বিজাতীয় সব উৎসব বা দিনগুলো ও পালন করা হয় ইংরেজী বা খৃষ্টীয় ক্যালেন্ডার অনুসারে। যেমন আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন ও আত্মত্যাগে সমুজ্জ্বল দিনটিও পালন করা হয় ইংরেজি তারিখ অনুযায়ী। স্বাধীনতা, বিজয়, জাতীয় শোক দিবস সবই সে মতে করার রেওয়াজ। ফলে র্নিদ্বিধায় বলা চলে এর ভেতর দিয়েই সূচিত ও সমাপ্ত হয় বর্ষপঞ্জি।
ইংরেজী নববর্ষ দুনিয়াব্যাপী এক আনন্দ উৎসবের দিন। মূলত: ৩১ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে শুরু হয় আনন্দ উদযাপন। মধ্যরাত ১২-০১ মিনিটে শুরু হয়ে যায় নতুন বছর বরণ। আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম তখন পড়তাম জাপান সূর্যোদয়ের দেশ। কিসের ভিত্তিতে বলা হয়েছিল জানি না। তবে অষ্ট্রেলিয়া এসে দেখলাম জাপান থেকে সিডনি দু ঘণ্টা এগিয়ে। জাপানে যখন রাত দুটো সিডনিতে তখন ভোর চারটা। তার মানে এখানেই সূর্য ওঠে আগে। এখানেই শেষ নয়। ২০০০ সালে পৃথিবী জানলো এখন অবধি নিউজিল্যান্ডেই প্রথম সূর্য ওঠে দুনিয়ার। সেখানকার এক দ্বীপে ভোরের শুরু।
অকল্যান্ডের পর আমাদের সিডনি নগরীর আলোকসজ্জা পৃথিবীর সেরা আকর্ষণ। বলতে গেলে সিডনির মধ্যরাতের আলোকসজ্জা এখনো আকর্ষণ তালিকার শীর্ষভাগে। সিডনি হার্বার ও অপেরা হাউসের এই আলোকসজ্জা দেখতে গেছি অনেকবার। প্রতিবার মনে হয় এ আর নতুন কী! কিন্তু রাতের অন্ধকার ভেদ করে জেগে ওঠা মনোরম আলোকসজ্জায় অভিভূত হয়ে ফেরার বিকল্প থাকে না। এবার ও তাই হয়েছে। অতিমারী করোনার থাবায় নিথর হয়ে পড়া জীবনে আলোকসজ্জা ছিল না। ছিল না প্রাণ স্পন্দন। এবার তা ফিরে এসেছিল। আমার ডাক্তার শ্যালকের বাড়িটি থেকে এই আলোকসজ্জা সম্পূর্ণ দেখা যায় বলে ভীড় ঠেলে যানজট এড়িয়ে যেতে হয় নি শহরের প্রাণকেন্দ্রে। বাড়িতে বসেই চিকিৎসক শ্যালক দম্পতির কল্যাণে আমরা উপভোগ করেছি দু দুটি লাইট শো। আতসবাজির জমজমাট উৎসব।
বাংলাদেশের মানুষজন দেশের মঙ্গল কামনা করেই বছর শুরু করে। তাদের বিশ্বাস দেশ ও দেশের মানুষ ভালো থাকলেই তারা ভালো থাকে। এ ধারণা অমুলক না। আমাদের দেশ ও দেশের সবকিছুতে যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে তা বলাবাহুল্য। বছরের শেষ সপ্তাহে আমি এদেশের রাজধানী ক্যানবেরায় গিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য নিছক ভ্রমণ কিছু ছিল না। আমার কাজ ছিল দূতাবাসে। একদা এই দূতাবাসের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ শুনতাম। এমন কি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হবার পর শেখ হাসিনা যখন সিডনি এসেছিলেন তখন তাঁর নাগরিক সংবর্ধনা সভায় এ নিয়ে প্রশ্নোত্তর ও হয়েছিল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সে সময় ই কড়া ধমক ও উপদেশ দিয়ে গেছিলেন। আজ আওয়ামী লীগের সরকার যখন ধারাবাহিকভাবে দেশ শাসন করছে এবং শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী তখন পরিবর্তন তো ঘটবেই।
পাসপোর্ট নবায়ন সহ কনস্যুলার সার্ভিসে সেবা দানরত তিনজন কর্মীকে সেদিন আমি প্রচুর পরিশ্রম করতে দেখেছি। তাঁদের একজন নারী। তিনজন ই কাজ করছিলেন মেধা ও শ্রম দিয়ে। নি:সন্দেহে তাঁদের সেবার মান ভালো। শুধু তাই নয় দু জন যখন আমাকে চিনতে পেরেছিলেন আলাপ হয়ে উঠেছিল ব্যক্তিগত। জানলাম কাজের চাপ আর মানুষের চাহিদা মেটানোর জন্য তাঁরা অনেক রাত অবদি কাজ করেন। কথাগুলো যে সত্য তার প্রমাণ গেলেই বোঝা সম্ভব। কাজ শেষ করে বেরুবার সময় মনে হলো না বুঝে না জেনে যারা চাপ দেয় বা নিন্দা করে তাদের উচিৎ সরেজমিনে দেখা এবং ব্যাপারটা বুঝতে পারা। ডিজিটাল বাংলাদেশে নবায়ন বা নতুন পাসপোর্ট কিংবা আই ডি কার্ড এর যে ঝামেলা তার জন্য দূতাবাস কর্মীরা দায়ী নয়। এর দায় আমাদের সিস্টেম এবং ব্যবস্থার। যেসব তথ্য বা ডকুমেন্ট চাওয়া হয় তার ভিতরে কিছুটা গলদ আছে। যেমন ধরুন অসংখ্য মানুষের জন্মদিন ১ জানুয়ারী। এর কারণ আমরা সবাই জানি। তাছাড়া যাদের জন্ম ৪০ /৫০ বছর আগে তাদের জন্য জন্মসনদ বা ডিজিটাল সার্টিফিকেট এক জাতীয় মাথাব্যথার কারণ বৈকি। সরকার বা কর্তারা নিশ্চয়ই জানেন তখন না ছিল তেমন কোন সিস্টেম না তেমন সব যন্ত্রপাতি। ছিল না নিবন্ধনের সুযোগ। এসব সত্য মাথায় রেখে পলিসির পাশাপাশি কিছু ব্যতিক্রম বা নিয়ম সহজ করার পদ্ধতি না থাকলে মানুষের কষ্টের যেমন লাঘব হবে না তেমনি মানুষ মিথ্যার আশ্রয় নিতেও বাধ্য হবে। সত্যের খাতিরেই এই নিয়মে পরিবর্তন জরুরি।
নববর্ষের অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আজ আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। আমরা সবাই মানি দেশ এগুচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে কারো সাধ্য নেই তাকে পেছনে ঠেলে। এটাও সত্য তিনি হয়ে উঠেছেন বিকল্পহীন। ফলে তাঁর জন্য ভালোবাসা শ্রদ্ধা আর সম্মানের পাশাপাশি আমদের সবার মনে শংকা থাকে অত:পর? এই অত:পরের নাম ই হয়তো গণতন্ত্র। আগেই বলে রাখি আমেরিকার সেংশান বা বিধিনিষেধে কাবু হবার দেশ নয় বাংলাদেশ। যারা এসব অপপ্রচারে মুগ্ধ হয় তারা উজবুক। তাদের ভাবনা তাদের মাথায় থাকুক। কিন্তু মানতে হবে নানা কারণে সংকট কাটে নি। সারাবিশ্বে নতুন করে দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া হানা দিয়েছে। বলাবাহুল্য দেশে ও তার বদ আছর পড়েছে। পার্থক্য একটাই অন্য দেশের সরকার এসব স্বীকার করে তাদের কার্যক্রম ঠিক করে। পথ তৈরী করে। আমাদের সরকারি দল কখনোই স্বীকার করতে চায় না। করলে আসলে তাদেরও লাভ। এবং সমস্যা সমাধানে মানুষের সমর্থন পাওয়া যেতো অধিক ।
নতুন বছরে সবচেয়ে দুর্ভাবনার জায়গাটি কি জঙ্গীবাদের নয়া দুশ্চিন্তা না সংস্কৃতির শক্তিহীনতা? এ নিয়ে তর্ক হতেই পারে। তবে মানতেই হবে সংস্কৃতির শক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়েছে। এর কারণগুলো কারো অজানা থাকার কথা না। শক্তি ও প্রতিবাদে ঝলসে ওঠা বাঙালির সংস্কৃতি সবসময় তাকে পথ দেখায়। অন্যায় অবিচার রুখে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সে শক্তির দৌলতে আমরা একনায়ক তাড়িয়েছিলাম। আমাদের কাছে নতজানু হয়েছিল পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি। আজ যদি তোষামোদ আর লোভের কাছে সে আবেগ সাহস পরাজিত হয় দুর্দশার অন্ত থাকবে না। তাই নতুন বছরে সে জায়গাটি পোক্ত করা জরুরি।
দেশের কথা অনেকেই লেখেন। আমাদের চট্টগ্রামের কথা থেকে যায় চার দেয়ালের আবর্তে। চট্টগ্রামে যেসব উন্নয়ন কাজ হচ্ছে বিশেষ করে গভীর সমুদ্র বন্দর ও কক্সবাজারের রেলপথ এগুলো দেশের চেহারা বদলে দিতে যথেষ্ট। এ সব যেমন সত্য তেমনি সত্য আমাদের চট্টগ্রামের প্রতি যথাযথ মনোযোগের অভাব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম সফরে এসে চাটগাঁইয়া কথায় মানুষের চিত্ত জয় করে গেছেন। তাঁর গোচরীভূত করতে পারলে এই শহর এই বন্দরের জনজীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে বাধ্য। বিশেষত : চট্টগ্রাম তার অধিকার বজায় রেখে যেন সঠিক পথে ধাবমান হতে পারে। সবাই জানেন জাতীয় উন্নয়নে চট্টগ্রামের ভূমিকা কতটা বিশাল।
নববর্ষ সব সময় আশার বাতি জ্বালিয়ে আসে। নির্ভর করে আমরা তাকে কতটা সম্মান করি কতটা কাজে লাগাই। করোনা মহামারীর আতংক আর বিভিষীকা এখনো মিলিয়ে যায় নি। তবু মানুষ দেশে দেশে বুকে সাহস রেখে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সবাইকে তাক লাগিয়ে জনবহুল বাংলাদেশ ও মোকাবেলা করেছে এই অতিমারীর। এখন সময় সংহত হবার। রাজনীতির কদর্যতা এড়িয়ে উন্নয়নশীল দেশটিকে সমৃদ্ধ ও বিজ্ঞানমুখি করার। ঢাকার মেয়ে সেজুঁতি সাহা। এবার বিশ্বনন্দিত লেনসেট বিজ্ঞান নিউজে সেরা দশজন বিজ্ঞানীর একজন হয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমরাও পারি। এর পাশাপাশি আছে নানা অর্জনের বিরাট তালিকা।
এখন এক বাংলাদেশী টাকা পাকিস্তানী রুপির দ্বিগুনেরও বেশি। এটাই আমাদের বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান ছিল ৭০ শতাংশ বেশি ধনী। আর এখন বাংলাদেশ তাদের তুলনায় ৪৭ শতাংশ অধিক ধনী দেশ। জয় হোক মাতৃভূমির।
লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, ছড়াশিল্পী