চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠ অবশেষে উন্মুক্ত করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে সরকারি মুসলিম হাই স্কুল কর্র্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তরের মাধ্যমে মাঠটি খুলে দেয়া হয়েছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাঠটি সংস্কার কাজ শুরু করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে মাঠের সংস্কার কাজ সম্পন্ন করা হয়। আগের ভাঙাচোরা সীমানা দেওয়ালগুলো সংস্কার করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ‘ছয় দফা মঞ্চ’। এছাড়া টেরাকোটার কারুকাজে আঁকা হয়েছে বাঙালি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতি স্মারক। ধূসর বালির ময়দানকে মোড়ানো হয়েছে সবুজ ঘাসে। সংস্কার কার্যক্রম শেষে ২০২১ সালের স্বাধীনতা দিবসে মাঠটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। সংস্কার কাজ শেষ হলেও আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় প্রায় দেড় বছর মাঠটি টিনের ঘেরায় ‘অবরুদ্ধ’ ছিল।
সর্বশেষ গত ৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এসে অন্যান্য ২৮টি প্রকল্পের পাশাপাশি ‘লালদীঘি মাঠ আধুনিকায়নের’ এ প্রকল্প উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক উদ্বোধনের পরও মাঠটিতে খেলাধুলার সুযোগ পায়নি শিক্ষার্থীরা। এর একমাসের মাথায় স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের মাধ্যমে অবশেষে মাঠটি উন্মুক্ত করা হলো। গতকাল দুপুরে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল আনুষ্ঠানিকভাবে লালদিঘী ময়দান সরকারি মুসলিম হাইস্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোস্তফা কামরুল আখতার, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান, সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মমতাজ আকতারসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। আনুষ্ঠানিক হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রায় তিন বছর পর মাঠটিতে প্রবেশের সুযোগ পেল শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ।
মাঠ হস্তান্তরকালে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, এই লালদিঘীর মাঠে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও এখানে জনসভা করেছেন, উনার সভা এখানে ইতিহাস হয়ে রয়েছে। লালদিঘী মাঠের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছে সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়। এটা মূলত স্কুলের শিক্ষার্থীদের খেলার জায়গা। তবে মাঠে বিভিন্ন দোকানপাট বসতো। গাড়ি পার্কিং করে রাখা হতো। অন্ধকার নামলে অসামাজিক কার্যকলাপ হত। ঐতিহাসিক এই মাঠের ঐতিহ্য দিন দিন হারাতে বসেছিল।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে মাঠটি আধুনিকায়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কোভিডের কারণে আমাদের কার্যক্রম ব্যহত হয়েছে। সময় না পাওয়ায় জনসম্মুখে মাঠের উদ্বোধন করতে পারিনি। এখন শিক্ষার্থীরা এখানে খেলতে পারবে। স্থানীয় শিশু-কিশোররাও খেলতে পারবে। বয়স্করা এখানে এসে হাঁটাহাঁটি করবেন। মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আগের নিয়মে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি করা যাবে জানিয়ে উপমন্ত্রী নওফেল বলেন, সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো আগে যেভাবে বুকিং দিয়ে সভা-সমাবেশ করেছে, সামনেও একইভাবে করতে পারবে। সিটি করপোরেশন এ মাঠের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে। জেলা প্রশাসনের একটি কমিটি থাকবে। সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কার্যক্রেমের অনুমোদন এ কমিটিই দেবে।
লালদীঘি মাঠ উন্মুক্ত হওয়ায় ডিসি হিলে অনুষ্ঠানের চাপ কমবে বলে মন্তব্য করেন উপমন্ত্রী। তবে জব্বারের বলিখেলার মেলা মাঠে বসতে দেওয়া হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, জব্বারের বলিখেলা চটগ্রামের ঐতিহ্যের অংশ। বলিখেলা মাঠেই হবে। তবে কোনো ধরনের মেলা ও গাড়ি পার্কিং এখানে করতে দেওয়া হবে না। মাঠে কোনো খুঁটি গাড়া যাবে না। কোনো অনুষ্ঠানের জন্য কেউ খুঁটি গাড়লে তারাই তা ঠিক করে দেবে। ক্ষতিপূরণ দেবে।
সংস্কার কার্যক্রম : সংস্কারের মাধ্যমে মাঠে মোট ১৮টি টেরাকোটায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ঐতিহাসিক সব ঘটনা। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণ, ভাষা আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শহিদ বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্ত ও মাস্টারদা সূর্যসেনের ম্যুরাল, ৫৪’র নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর প্রচারণা, ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনি প্রচারণা, ৭ মার্চের ভাষণ, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ স্থান পেয়েছে টেরাকোটায়।
এছাড়াও রয়েছে সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের দেয়াল চিত্র। শিশু কর্নারে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দেয়াল চিত্র। মঞ্চে ছয় দফার তিনটি করে দফা দুইপাশে সংক্ষিপ্ত আকারে মুদ্রিত করা হয়েছে। মাঝের অংশে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে জাতির পিতার সভা এবং ছয় দফার দাবিতে মিছিল সমাবেশের ছবি আঁকা আছে। চারপাশে সীমানা দেওয়াল ঘেরা মাঠে আছে কিডস কর্নার, বসার বেঞ্চ আর ওয়াকওয়ে।