সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্য শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। তাই উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেখানে শিক্ষাকে আধুনিক, যুগোপযোগী ও কর্মমুখী করার জন্য বছরের পর বছর ধরে নানা গবেষণা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও মত বিনিময় সভা করা হয়। শিক্ষাক্রম পরিবর্তন বা সংশোধন করতে হলে অন্তত বছর ব্যাপি প্রস্তুতি নেওয়া হয়। প্রস্তুতির অংশ হিসাবে নতুন শিক্ষাক্রমের ব্যাপক প্রচার প্রচারণা ও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে, তবেই তা বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলো বাংলাদেশ। এখানে শিক্ষকদের তাড়াহুড়া করে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত পাঁচ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০২৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করা হচ্ছে। এর ফলে বদলে যাবে দেশের শিখন ও মূল্যায়নের পদ্ধতি।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম এই তিন শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাকী শ্রেণিগুলোতে ২০২৪ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়িত হবে। যদিও বিশেষজ্ঞরা শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও সময় দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া না হলে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। কারণ নতুন শিক্ষাক্রম হচ্ছে অভিজ্ঞতা নির্ভর। এতে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। এর মধ্যে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো প্রথাগত পরীক্ষা থাকবে না। পরবর্তী শ্রেণিগুলোতে মূল্যায়ন হবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন পদ্ধতিতে। এখন কার মত এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচীর ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে হবে দুটি পাবলিক পরীক্ষা।
অন্যদিকে ২০২৩ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে দেওয়া হবে নতুন বই। এর ধারাবাহিকতায় পরের বছরগুলোতে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বইও দেয়া হবে। শুধু বই নয় ২০২৩ সাল থেকে পাঠদান প্রক্রিয়া ও মূল্যায়ন পদ্ধতিও সম্পূর্ণ পাল্টে যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে যে প্রক্রিয়ায় ক্লাস নেওয়া হতো, এখন সেই প্রক্রিয়ায় ক্লাস নেওয়া যাবে না। নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক সরাসরি কোনও বিষয় পড়ানো শুরু করবেন না। চারটি ধাপ অনুসরণ করে শিক্ষক পাঠদান করবেন। প্রথম ধাপে তিনি কোন একটি বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত যাচাই করবেন। এক্ষেত্রে তিনি শিক্ষার্থীদের একক বা দলগতভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে পারেন।
এর মধ্য দিয়ে শিক্ষক শিক্ষার্থী দের জ্ঞানের স্তর সম্পর্কে ধারণা পাবেন ও দুর্বল শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করতে পারবেন। দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষক প্রত্যেকের বা প্রতিটি দলের মতামতের ভিত্তিতে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিমত বা প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করবেন। এ সময় শিক্ষক লক্ষ্য করবেন তারা গুরুতর কোনো ভুল করছে কিনা। তিনি তাদের আলোচনা সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়াকে উৎসাহিত করবেন। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক জ্ঞানের সঞ্চারণ ঘটবে। তৃতীয় ধাপে শিক্ষক পুরো বিষয়টি পরিষ্কার করবেন ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। এই অংশে শিক্ষকের ভুমিকা হবে মুখ্য। আলোচনার মধ্যে তিনি শিক্ষার্থীদের মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের জবাব দিবেন। চতুর্থ বা শেষ ধাপে শিক্ষক পর্যবেক্ষণ করবেন শিক্ষার্থীরা বিষয়টি কতটুকু বুঝতে পেরেছে। শিক্ষার্থী তার অর্জিত জ্ঞান বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারছে কিনা এবং তা যাচাই করা চতুর্থ ধাপের লক্ষ্য। পাঠদানের মত মূল্যায়ন পদ্ধতিও পরিবর্তন হবে। মূল্যায়নের কাজটি চলবে বছর জুড়ে। শ্রেণি কক্ষের বিভিন্ন কাজের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত যোগ্যতাগুলো অর্জন করার চেষ্টা করবে।
এক্ষেত্রে শিক্ষার্থী কতটুকু যোগ্যতা অর্জন করেছে বা পারছে তা শিক্ষক একটি সীটে নোট করে রাখবেন। এর একটি নির্দিষ্ট মান থাকবে যা শিক্ষার্থী বছরের যে কোনও সময় অর্জন করলেই চলবে। কোন শিক্ষার্থী যোগ্যতা অর্জন করার আগেই যদি শিক্ষক তাকে সফল বলে চিহ্নিত করেন তবে শিক্ষার্থী পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হলেও প্রকৃত দক্ষতা অর্জনে সক্ষম হবে না। আর নতুন শিক্ষাক্রম নম্বর বা জিপিএ ভিত্তিক না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীকে ফলাফলের পিছনে ছুটতে হবে না। আগের শিক্ষাক্রম ছিলো প্রতিযোগিতামূলক যেখানে একজন শিক্ষার্থী আরেক শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার ব্যাপারে সহযোগিতা করতো না। আর নতুন শিক্ষাক্রম হলো সহযোগিতামূলক, যেখানে শিক্ষার্থীরা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পথে এগিয়ে যাবে। এতে বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক মূল্যায়ন বেশি হবে। এই শিক্ষাক্রমের বিশেষত্ব হলো এটি অভিজ্ঞতা নির্ভর, যা আগে ছিলো মুখস্থ নির্ভর। এখানে শিক্ষার্থীরা চিন্তা করতে শিখবে। সমস্যার সমাধানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তারা যে জ্ঞান অর্জন করবে, সেটি তাদের জীবনে কাজে লাগাতে পারবে। এতে করে শিক্ষার্থীরা আরো সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। তবে এগুলো সব শ্রেণিতে সমান গুরুত্ব পাবে না। গুরুত্ব পাবে ধাপে ধাপে।যেমন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে গুরুত্ব দেওয়া হবে মাতৃভাষা ও গনিতের দক্ষতা বাড়ানোর উপর। পরে ধাপে ধাপে বিজ্ঞানের গুরুত্ব বাড়বে। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে ১০টি বিষয় প্রবর্তন করা হয়েছে। এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। তবে প্রাক প্রাথমিকে শিশুদের জন্য কোন বই থাকবে না, শিক্ষকরাই শিখাবেন। নবম ও দশম শ্রেণিতে জীবন ও জীবিকা বিষয়ে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থী কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি পেশায় দক্ষতা অর্জন করবে ফলে দশম শ্রেণি শেষে শিক্ষার্থী যেকোনও একটি পেশায় কাজ করার মতো পেশাদারি দক্ষতা অর্জন করবে।
শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুযায়ী প্রাক প্রাথমিক, প্রথম দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে কোনও পরীক্ষা থাকবে না। এসব শ্রেণিতে শতভাগ মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন ধারাবাহিকতার উপর। ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ৬০% মূল্যায়ন হবে। বাকি ৪০% মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার ভিত্তিতে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন কার্যক্রমের ভিত্তিতে এই দুই শ্রেণির শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা ও শিল্পকলা বিষয়ের পুরোটাই মূল্যায়ন হবে।
ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৬০% মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। এর বাইরে আরো পাঁচটি বিষয়ের শতভাগ মূল্যায়ন হবে ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে। বিষয়গুলো হলো জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। নবম ও দশম শ্রেণিতেও এই পাঁচটি বিষয়ে একইভাবে মূল্যায়ন করা হবে। এর বাইরে এই দুই শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৫০% মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন ও বাকি মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার মাধ্যমে। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে অভিন্ন বিষয় পড়তে হয়। শিক্ষার্থী সাইন্স আর্টস নাকি কমার্সে পড়বে সেটি বর্তমানে ঠিক হয় নবম শ্রেণিতে। নতুন শিক্ষাক্রমে এই বিভাজন হবে একেবারে উচ্চমাধ্যমিকে অর্থাৎ একাদশ শ্রেণিতে। সেজন্য ষষ্ঠ হতে দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে ১০ টি অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নে জোর দেওয়া হবে। এই স্তরে ৭০% মূল্যায়ন হবে পরীক্ষার মাধ্যমে এবং বাকি ৩০% মূল্যায়ন হবে শিখন কালীন।
একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, আগের শিক্ষাক্রমের তুলনায় নতুন শিক্ষাক্রমে আসছে আমুল পরিবর্তন। নতুন বই ও বিষয়ের সাথে যুক্ত হচ্ছে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিও। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত প্রচলিত পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। তাই নতুন পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষাদান ও শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতি সব বিবেচনাতেই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট