ভূ–গর্ভস্থ পানি দিয়ে লবণ উৎপাদন করে দেশে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে কুতুবদিয়ার লবণ চাষিরা। সনাতনী পদ্ধতিতে নদ–নদীর পানি দিয়ে লবণ উৎপাদনের চেয়ে এ নতুন পদ্ধতিতে নলকূপ বসিয়ে অনেক কম খরচে আগের চেয়ে ৩০%-৫০% বেশি লবণ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে চলতি মৌসুমে কুতুবদিয়ার দুটি ইউনিয়নে এ পদ্ধতিতে ব্যাপকভিত্তিতে লবণ চাষ শুরু হয়েছে।
দেশে লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য উপকূলজুড়ে এ নতুন পদ্ধতির লবণ চাষকে উৎসাহিত করতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কুতুবদিয়ার লবণ চাষিদের বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে সোলার সিস্টেম। লবণ মাঠে এই সোলার সিস্টেম বসিয়ে নলকূপ থেকে ভূ–গর্ভস্থ পানি তুলে সহজে লবণ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হলে বাংলাদেশ লবণ উৎপাদনে কেবল স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে না, দেশে নতুন বিপ্লব তৈরি হবে বলে মনে করছেন কক্সবাজারস্থ বিসিক লবণ কেন্দ্রের উপমহাব্যবস্থাপক ড. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া।
তিনি জানান, গত মৌসুমে দেশে লবণ উৎপাদনের টার্গেট ছিল ২৩ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। আর উৎপাদন হয়েছে ১৮ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ উৎপাদন ঘাটতি ছিল ২১% এর বেশি। আর চলতি ২০২২–২৩ মৌসুমে দেশে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন।
বিসিক সূত্র মতে, প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে নভেম্বর থেকে এপ্রিল–মে পর্যন্ত সময়ে কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলীয় জমিতে সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি আটকে রেখে এবং তা রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় লবণ। দেশের প্রায় ৬৩ হাজার ২৯১ একর জমিতে লবণের চাষ হয়ে থাকে। এরমধ্যে বাঁশখালীর ৮ হাজার ১৭৬ একর জমি ছাড়া বাকী জমি কঙবাজারের।
সূত্র মতে, গতবছর কঙবাজারের ৭ উপজেলার ৫৫ হাজার ১১৪ একর জমিতে লবণের চাষ হয়েছে। এরমধ্যে কুতুবদিয়ার ৬ হাজার ৫৬৩ একর, পেকুয়ার ৯ হাজার ৮শ ৪৫ একর, টেকনাফের ৩ হাজার ৯শ ৪৫ একর, চকরিয়ার ১০ হাজার ৬শ ২০ একর, কঙবাজার সদরের ৩ হাজার ৩শ ৩৮ একর, ঈদগাঁওর ৪ হাজার ৬শ ৯১ একর এবং মহেশখালীর ১৬ হাজার ১৮ একর জমি রয়েছে। এবছরও এসব জমি ছাড়াও আরও নতুন জমিতে লবণ উৎপাদন হবে বলে আশা করছে বিসিক। তবে কঙবাজারের ৯ উপজেলার মধ্যে রামু ও উখিয়াতে লবণ উৎপাদিত হয় না।
গত বছর কুতুবদিয়ায় ২ লাখ ৫৬ হাজার ৫শ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া মহেশখালীতে ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭শ মে. টন, পেকুয়ায় ২ লাখ ৭৬ হাজার ৫শ মে. টন, চকরিয়ায় ২ লাখ ৫৮ হাজার ১শ মে. টন, টেকনাফে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৫শ মে. টন, ঈদগাঁওতে ১ লাখ ৪১ হাজার ৭শ মে. টন ও কক্সবাজার সদরে ৮৩ হাজার ৬শ ৯০ মে. টন লবণ উৎপাদিত
হয়। এছাড়াও কঙবাজারের পেকুয়া সংলগ্ন চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে উৎপাদিত হয় ২ লাখ ৪৫ হাজার ৮শ ৬০ মে. টন লবণ।
কঙবাজারস্থ বিসিক লবণ কেন্দ্রের উপমহাব্যবস্থাপক ড. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদনের পরিমাণ ইতোমধ্যে এক লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। যা আগের মৌসুমে এই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। কুতুবদিয়ার লেমশিখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আকতার হোসেন জানান, প্রায় ৩ বছর আগে তার ইউনিয়নে পানীয় জলের জন্য বসানো একটি টিউবওয়েল থেকে তীব্র লবণাক্ত পানি ওঠে আসায় এক ব্যক্তি পরীক্ষামূলকভাবে সেই পানি দিয়ে লবণ চাষ শুরু করেন। পরে তার দেখাদেখি আশেপাশের অনেকেই এই পদ্ধতিতে লবণ চাষ করেন। আর চলতি মৌসুমে লেমশিখালীর পাশাপাশি পাশের ইউনিয়ন দক্ষিণ ধুরুং–এ একই পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন চলছে। বর্তমানে দুই ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার একর জমিতে এই পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন চলছে বলে তিনি জানান।
লেমশিখালীর লবণচাষি নুরুল আলম এবং দক্ষিণ ধুরুং এর আলী আকবর জানান, নদীর পানি দিয়ে লবণ চাষ করলে মাঠে লবণ হতে সময় লাগে ৫ থেকে ৬ দিন। আর ভূ–গর্ভস্থ পানি দিয়ে লবণ উৎপাদন করলে ৩ দিনের মধ্যে লবণ পাওয়া যায়। তাছাড়া লবণ উৎপাদন খরচও হয় অনেক কম। কুতুবদিয়ায় অঞ্চলভেদে ৮০ থেকে ১৫০ ফুট গভীরে নলকূপ বসিয়ে লবণ পানি পাওয়া যাচ্ছে।
লবণচাষি নুরুল আলম বলেন, সাগর বা নদীর পানি দিয়ে লবণ উৎপাদন করলে প্রতি একরে ৩শ মণ পর্যন্ত লবণ উৎপাদন করা যায়। আর ভূ–গর্ভস্থ পানির সাহায্যে লবণ উৎপাদন করলে প্রতি একরে ৪শ থেকে সাড়ে ৪শ মণ লবণ পাওয়া যায়। আর প্রতি একর লবণ চাষে সাগর বা নদীর পানির জন্য যেখানে সাড়ে ৪ হাজার টাকা খরচ হয়, সেখানে নলকূপের পানিতে লাগে মাত্র ১ হাজার টাকা।
কঙবাজারস্থ বিসিক লবণ কেন্দ্রের উপমহাব্যবস্থাপক ড. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া জানান, একটি অগভীর টিউবওয়েল বা নলকূপ দিয়ে ৫ একর এবং বৈদ্যুতিক মোটরযুক্ত নলকূপ দিয়ে ৩০ থেকে ৩৫ একর পর্যন্ত জমিতে লবণ উৎপাদন করা যায়। আর লবণ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে লবণ চাষিদের বিনামূল্যে সোলার সিস্টেম দেওয়া হচ্ছে। কুতুবদিয়ায় নলকূপের সাহায্যে পানি উত্তোলনের ফলে এখন লবণ উৎপাদনের জন্য বাঁশ, বেত ও টিনের তৈরি দোলনা সেচনি ব্যবহারের আর প্রয়োজন হচ্ছে না। লবণ উৎপাদনে এ নতুন আবিষ্কার কুতুবদিয়া দ্বীপের প্রান্তীক লবণ চাষিদের পাশাপাশি দেশের লবণ চাষিদের মনে জাগিয়েছে নতুন আশা।
তবে ভূ–গর্ভস্থ পানি দিয়ে লবণ চাষের বিরোধিতা করছেন পরিবেশবাদীরা। তাদের মতে, এর ফলে পানির স্তর নিচে নেমে যেতে পারে এবং পানীয় জলের রিজার্ভে বিপত্তি তৈরি হতে পারে। অবশ্য কঙবাজার শহরের প্রায় ২ হাজার নলকূপ যেখানে ৩শ ফুট থেকে ১ হাজার ফুট গভীর থেকে দৈনিক ২ কোটি লিটার ভূ–গর্ভস্থ পানি তুলছে, সেখানে কয়েকশ নলকূপ বসালে কী বড় প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে; তা কোনো উল্লেখযোগ্য কিছু নয় বলে মনে করেন কুতুবদিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সমুদ্র বিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর বলেন, লবণ চাষে ভূ–গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ইতিবাচক দিকগুলোকে উৎসাহিত ও নেতিবাচক দিকগুলোকে অনুৎসাহিত করার জন্য আমাদের বিজ্ঞানীরা শীঘ্রই একটি গবেষণা জরিপ পরিচালনা করবেন। এর মাধ্যমে কোন অঞ্চলে পানির কোনো স্তরে লবণাক্ততার পরিমাণ কেমন তা জানা যাবে এবং সেই অনুযায়ী লবণ চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হবে। তাছাড়া পানীয় জলের রিজার্ভে কোনো বিপত্তি তৈরি হয় কীনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।