১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের ইতিহাস। আমাদের মুক্তিযুদ্ধপূর্ব প্রেক্ষাপট ও ঘটনাপ্রবাহের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই সংগ্রাম পরিণতি অর্জন করেছে কয়েকটি ধাপে- যার প্রতিটি ধাপে রয়েছে এদেশের নারীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও আত্মত্যাগ। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম দুটি নক্ষত্র প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্ত। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের যোগ্য উত্তরসূরী- বাংলাদেশের নারীদের রয়েছে সাহসী সংগ্রাম, যুদ্ধ ও আত্মদানের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই ছিল জনযুদ্ধ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে নারী-পুরুষ সকলেই সর্বাত্মক ও সমানভাবে এই যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রির গণহত্যার পর পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী যখন পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করে, সেই সময় ঢাকাসহ সারাদেশেই সাধারণ মানুষ তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন। বিপন্ন নারী-পুরুষ ও শিশুর দল গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ছাড়িয়ে শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। পাকিস্তানি বাহিনী নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা ছাড়াও নারীর ওপর নিপীড়ন, ধর্ষণ, লাঞ্ছনা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে বাছবিচারহীনভাবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যদিও বাংলাদেশ সরকারের নীতিতে নারীদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেওয়া, গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করা এবং প্রশাসনিক কাজের নেতৃত্বদানের দায়িত্ব দেওয়া ইত্যাদির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, তারপরেও এক্ষেত্রে নারীরা ছিলেন অগ্রগামী। কলকাতায় মুক্তযুদ্ধকালীন সরকারের প্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর পরিচালনায় গোবরা ক্যাম্পে ৩০০ তরুণীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। গোবরা ক্যাম্পে নারীদের তিন রকম প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো- সিভিল ডিফেন্স, নার্সিং এবং অস্ত্রচালনা ও গেরিলা আক্রমণ। যদিও অস্ত্রচালনা শেখার পরও তাঁদেরকে সম্মুখসমরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি, তারপরও স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী, যেমন – ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, কাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা, আলেয়া বেগম। বরিশালের করুণা বেগম ছিলেন অকুতোভয় মুক্তিসেনা। আলমতাজ বেগম ছবি গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ১৮ নভেম্বর ২০১২ জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য মতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ২০৩ জন নারী অংশ নিয়েছিলেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দিনাজপুরে ২১ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৫ জন, যশোর ও গোপালগঞ্জে ৯ জন, সুনামগঞ্জ ও পঞ্চগড়ে ৮ জন, সিলেট ও বরিশালে ৭ জন নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
নারী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন তিনজন- ১৯৭২ সালে ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম; এরপর ১৯৭৩ সালে তারামন বিবি ও ১৯৯৭ সালে খেতাব পেয়েছেন কাঁকন বিবি। তারামন বিবি ও কাঁকন বিবি ২০১৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন এবং দীর্ঘদিন তাঁরা দুজনই ছিলেন বিস্মৃতির আড়ালে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসর রাজাকার, আল-বদরের দ্বারা ধর্ষিত ও অত্যাচারিত হয়েছেন প্রায় তিন লাখ নারী। আবার এই নারীরাই অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে বিপুল বিক্রমে লড়াইও করেছেন। তবু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে দেখা যায় ১৯৭১ সালে এবং পরবর্তী সময়ে প্রায় দুই দশকজুড়ে এদেশে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও পরিচয় তেমনভাবে আলোচিত হয়নি। যে কারণে একজন বিথীকা বিশ্বাস বা শিশির কণা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সৈন্যদের গানবোট গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দিলেও যুদ্ধ-পরবর্তীকালে তাঁরা যথাযোগ্য বীরের মহিমায় অভিষিক্ত হননি। উপরন্তু তাঁদের ভাগ্যে জুটেছিল সামাজিক লাঞ্ছনা। যুদ্ধ শেষে এই বিথীকা বিশ্বাস ও শিশির কণাকে তাঁদের পরিবার ও সমাজ গ্রহণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী। যুদ্ধের পর তাঁরও স্বামীগৃহে ঠাঁই মেলেনি। যুদ্ধ-পরবর্তী সমগ্র বাংলাদেশে এমন উদাহরণ অসংখ্য।
আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মায়েদের, স্ত্রীদের আত্মত্যাগের কথাও বলা দরকার। শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমাম, শহীদ আজাদের মা সাফিয়া বেগমের মতো সব মা-ই মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। অসংখ্য নারী স্বামীকে হারাবার সমূহ সম্ভাবনার কথা জেনেও তাদেরকে যুদ্ধে যেতে বাধা দেননি। তাঁদের এই ত্যাগও ইতিহাসের উজ্জ্বল অংশ।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। পথে-প্রান্তরে অলিগলিতে গান গেয়ে তাঁরা অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ব্যয় করেছেন। এমনকি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুক্তাঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে গান শুনিয়ে তাঁদের উদ্দীপনা জুগিয়েছেন শিল্পীরা।
আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসংখ্য নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা দিয়েছেন।
মূলত এভাবেই নানামুখী ভূমিকা নিয়ে নারীরা বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে ছিলেন অদম্য। তাঁরা ক্যাম্পে ক্যাম্পে রান্নার কাজ করেছেন, অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রহরী হিসেবেও কাজ করেছেন। আবার পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের অবস্থান সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা, অস্ত্র এগিয়ে দেওয়া অথবা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা ও চিকিৎসা করা, তাঁদের জন্য ওষুধ, খাবার এবং কাপড় সংগ্রহ করা- রক্ত ঝরা একাত্তরে নারীদের এই সক্রিয় কর্মকাণ্ডই ছিল তাঁদের মুক্তিযুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নারীদের এই বহুমাত্রিক ভূমিকা ও আত্মত্যাগ বুঝতে ও মূল্যায়ন করতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান – সব ধর্মের নারীই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কেবল বাঙালি নয়, সর্বাত্মকভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আদিবাসী নারীরাও। যুদ্ধকালে যেসব নারী ধর্ষিত হয়েছেন, তাঁদের ও তাঁদের গর্ভজাত যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনের প্রয়োজন ছিল, স্বামীহারা বিধবাদের দরকার ছিল আশ্রয়। এসবই তখন বড় করে দেখা হয়েছে। পাশাপাশি ১৯৭১-এর নারী নির্যাতনকে বীরত্বের মহিমা দিয়ে মহিমান্বিত করার জন্য তাঁদেরকে ‘বীরাঙ্গনা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের সর্বত্র যে বিপুল সংখ্যক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, নিগৃহীত হয়েছেন, তা কেবল তাঁরা নারী বলেই। পুরুষেরা যখন সংগ্রামরত ছিলেন পাকিস্তানি সৈনিকদের পরাস্ত করে স্বদেশকে মুক্ত করার জন্য, নারীকে তখন দেশমুক্তির পাশাপাশি নিজের অস্তিত্ব, মর্যাদা ও সম্ভ্রম রক্ষার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। নারীদের জন্য এটা এক ভিন্ন ধরনের যুদ্ধ, তাঁর শরীরের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ; আর সেটা বুঝতে সময় লেগেছে রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সবারই। বলার অপেক্ষা রাখে না, মুক্তিযুদ্ধকালে নারীর আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত সনাতন ও পশ্চাৎপদ। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া অদম্য অকুতোভয় মহিলা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান সার্বিকভাবে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সারাদেশে একযোগে ৬৫৪ জন মহিলা বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সরকারের পক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।
কেবল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নয়, বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যাবে, যে কোনো অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও মুক্তকামী মানুষের সংগ্রামে, যুদ্ধে নারীর অবদান কোনো অংশেই কম নয়। বাংলাদেশের সুদীর্ঘ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সকল বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম জানাচ্ছি। সকল বীর শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক: উপপরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর.বান্দরবান পার্বত্য জেলা