ছাতিমপুরে সন্ধ্যা নামত সন্ধ্যার একটু আগেই। গাঁয়ের আকাশটা যে ঘিরে রাখত দৈত্যের মত বড় বড় ছাতিমগাছ গুলো! তবে এরা গাছ কিনা সুগন্ধী জ্বিন তা কেউ ঠিকঠিক জানে না। গন্ধে পাগল হয়ে যেন অন্ধকার এসে পড়ত সময়ের আগে আগে। তেমনি গাঁয়ের লোকেরাও। ছাতিমের গন্ধে উঁচু ডালে বসে ভূতগুলো যখন চাঁদের আলো মাখত গায়ে এর আগেই লোকেরা ঘরে ফিরত। অবশ্য তেনাদের আর শরীর কি, কেউ কি দেখেছে কখনো? যদি কেউ দেখেও থাকে তারাও হয়ত উঁচু ডালে উঠে এখন আলো মাখছে। কেউ কেউ হয়ত আতর জ্বিনেদের দেখেও ঘরে ফিরেছে। কিন্তু তাদের শরীর থেকে সুবাস যায় নি। এদের মত কেউ কেউ বাজার করতে গেলে মাছমলেও ঘুরপাক খেত ছাতিমের সুগন্ধি। এইগন্ধের এক অদ্ভুত গুণ। কাছে এলে মনে হয় অনেক দূর থেকে আসছে গন্ধটা, কেউ তাই ঠাওর করতে পারে না। আলাউদ্দিন যখন অনেক ছোট সে নিজেই এমন ঘটনার সাক্ষী। তবে তা অনেকদিন আগের কথা। তার ছেলে রায়হান মিয়াকে সে এই কথা নিজ মুখেই বলেছে ঘুম পাড়ানোর সময়। তাও অনেক আগে। রায়হান এখন স্কুলে যায়, বন্ধুও হয়েছে দুই তিনজন। তারা যে পথটা দিয়ে ফেরে সেদিকটাতে আর কোন ছাতিম-টাতিম নাই। এমনকি তারা যে মাঠটাতে বিকেলে খেলে সেখানেও নাই। মেলা হয় বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরেই, ঈদ-পূজাতে। নদী পার হয়ে মেলা দেখতে যেতে হয়। কিন্তু কোথাওই আর আতর জ্বিনেদের তার চোখে পড়ে না। তাহলে কি তার আব্বা, তার বন্ধুদের আব্বারা তাদের সাথে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে?
রায়হান সাইকেলে চড়ে স্কুল থেকে ফিরতে-ফিরতে আলাউদ্দিন এর কাছে জানতে চায়। আলাউদ্দিন বলে, আলোমাখা ভূতের সংখ্যা বাইড়া গেসিল, লোকজনের গাও থেইকা বাসনা আইত। লোকে ভয় পাইয়া কাইট্টালসে সব। পুরানা রেলইস্টিশনে কয়ডা থাকতারে! রায়হান বায়না করেছিল নিয়ে যেতে, সাইকেলই তো আছে, কিন্তু সে নিয়ে যায়নি সেদিন আর। আলাউদ্দিন এর শৈশব কেটেছে আতর জ্বিনের ভয়ে। কিসের ভয় সে নিজেও জানে না। অইটাই তো একটা ভয়।
পরদিন বৃহস্পতিবার । হাফ স্কুল, ছুটির পর রায়হান বন্ধুদের সাথে দুপুর থাকতে থাকতে পুরানা রেলস্টেশনের পথ ধরে বাড়ি ফিরে, তার কাছে ভয়ের কিছুই লাগছিল না কিন্তু বাতাসটা কেমন চনমন করছিল শুধু। ম-ম গন্ধে কিসের জানি ফিশফাশ! রায়হান বুঝতে পাওে না এরাই কি তাহলে আতর জ্বিন? দশ বারোটা সবুজ দানব যেন দুইপাশে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তাটার। তাদের গায়ে সাদা-সাদা ফুটির মত ফুল, এটাকে ঠিক রাস্তাও বলা যায় না। রেললাইন। অচল, ঘাস উঠে ভরে গেছে। রায়হান আর তার বন্ধুদের ঠিক ভয় করে নাই অইদিন বিকেলে। কেমন জানি আদর লেগেছে মাথায়, চুলে, সুবাস যেন নাক দিয়ে ঢুকে সারা গায়ে হাত বুলাচ্ছিল,আম্মার মত। কিন্তু ছাতিমের নিচ দিয়ে আসার সময় বিকালটা কেমন হলুদ হয়ে যায় সেদিন। বন্ধুরাও বলেছে। রায়হান তার আম্মারে জিজ্ঞেস করে। শারমিন বলতে পারেনি হেমন্তের জন্যই না কি তারা আতর জ্বিন দেখে বাড়ি ফিরল দেখে! সেদিন বিকালে শারমিন একটা ভালই ভাতঘুম দিয়েছিল, বের হয়নি বাড়ি থেকে, তাই সে জানে না বিকাল হলুদ হবার কারণ।
তার কিছুদিন পরে সে তার আব্বার সাথে বাজারের জন্য বের হয় সকাল-সকাল। আলাউদ্দিন স’মিলে যায়। একটা নতুন আলমারি বানানোর আবদার করেছে শারমিন, তার জন্যেই ভাল কাঠের সন্ধানে আসা। স’মিলে ঢোকার পর থেকে রায়হান কি যেন গন্ধ পাচ্ছে। কিছুক্ষণ গেছে পরে সে গন্ধটা চিনতে পারে। গন্ধ ধরে-ধরে সে খুঁজতে-খুঁজতে স’মিলের পেছনের দিকে যায়। আলাউদ্দিন ও তার পিছন পিছন যায়। তারা প্রায় একসাথেই গন্ধটা পায়। যেন আতরের বিলে এসে পড়েছে তারা, সাঁতার কাটছে। তারা দেখে, কে-যেন শেষ কয়টা ছাতিমও কেটে ফেলে গেছে এখানে। আলাউদ্দিন এসে জিজ্ঞেস করে স’মিল এর একজনকে। সে খুব হড়বড় করে বলে, পুরান রেললাইন ঠিক করাইব। সরকারি লোকজনই কাটছে। আকাইম্মা গাছ। কামে তো আয়ে না। এক পারটির লগে মাহাজন আলাপ করছিল। হেরা কফিন বানানির লাইগ্গা কিনব। এডভান্স করছে। সবগুলাই কিইনা নিসে। কিন্তু ভয় অইল আলো-মাখানি ভুতগুলারে নিয়া। তিনারা কই যাইবাইন অইডাই সিন্তা। জানামতে আর কুনু ছাতিমই তো থাক্ল না ছাতিমপুরে। আলাউদ্দিন একটু ভয় পেল যেন!
রায়হান কেন জানি খুব চুপ হয়ে গেল। বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরে স্কুলে যায়। ফিরে আসে। বিকালে ঘুমায়। সন্ধ্যায় উঠে বুঝে না রাত না সকাল। অই রাতে সে পড়তেও বসে নাই। তার ছাতিম গাছগুলার জন্য পেট পুড়তেছিল। পরদিন স্কুলে যায়। টিফিন শেষ-এর ঘন্টা পড়ছে। কিন্তু এতক্ষণ ধরে কেন পড়ছে! রায়হান একবার ভাবে। তাদের স্কুলটা বেশ পুরানো। তার আব্বার থেকে শোনা যুদ্ধের ও আগের। তা প্রায় ৫০ ৬০ বছর হবেই। কিন্তু মাঠেরশেষে শিরিষ গাছের নিচে যে পায়খানাটা ওটা দেখতে আরো পুরানো। রায়হান প্রস্রাব করতে-করতে ভাবে এতক্ষণ ধরে তো ছুটির ঘন্টা পড়ে না, কিসের ঘন্টা এইটা! বের হওয়ার সময় রায়হানের নাকে মিষ্টি একটা গন্ধ আসে। আতর জ্বিনের গন্ধ এটা, ও বুঝতে পারে। কিন্তু ছাতিম গাছ তো স্কুলে নাই। সে খোঁজে। শিরিষ গাছের সাথেই আরেকটা গাছ দেখে সে। তার মনে হল এখানে তো আর কোন গাছ ছিল না। সে ভয় পায়। প্রায় দুই তালার মত লম্বা। এত বড় গাছ কবে হল! সে বুঝে উঠার আগেই দেখতে দেখতে আরো কয়েক হাত বাড়ল গাছটা, ভয় পেয়ে দৌড় দেয় সে। সবাই-ই মাঠে জড় হয়েছে। তখনো ঘন্টা দিচ্ছে রওশন খালা। কি হল উনার? তাল ঠিক রাখতে পারছেন না। ভয়ে উলটা পালটা হয়ে যাচ্ছে? হেডস্যার সবাইকে জড় হতে বলছেন মাইকে। সবাই জড় হলে স্যার বললেন, তোমরা সবাই এখনই বাড়ি চলে যাও। সারা গ্রাম থেকে খবর আসছে জায়গায়-জায়গায় ছাতিম গাছ দেখা যাচ্ছে, তিনারা তো আসলে সুগন্ধি জ্বিন। চোখের নিমিষেই বড় হচ্ছেন, থোকায় থোকায় ফুল দিচ্ছেন। আর এই আতর জ্বিনেদের গন্ধে অজ্ঞান হয়ে পড়ছে লোকজন। তোমরা নাকে ধরে একসাথে আলো থাকতে থাকতেই বাড়ির দিকে রওনা হও। তিনারা চাঁদের আলো গায়ে মাখেন। এই আলো অন্য কারো গায়ে লাগুক এইটা তাদের পছন্দ না।
সেদিন তারা দিনের আলোতেই বাড়ি ফিরতে পেরেছিল। পথে সত্য সত্যই আতর জ্বিনেদের দেখেও ছিল, তিনারা সবুজ ট্রেনের মত আকাশের দিকে রওনা দিয়েছেন। এত বাতাস তারা কোনদিন চোখে দেখে নাই, জ্বিনেরা যেন নাচতেছিল বাতাসে। বায়োস্কোপে চোখ রাখলে যেমন, সবকিছু তেমন লাগছিল রায়হানের কাছে- গত শুক্রবারই রহমান মন্ডল আসছিল স্কুলে, টিফিনের সময় বন্ধুরা মিলে বায়োস্কোপ দেখেছে তারা। থোকায়-থোকায় ছাতিমের সাদা ফুল তেমন করেই ফুটতে থাকে গাছে। গন্ধে গোটা গ্রামটাই থ মেরে ছিল, ছাতিমের ট্রেনগুলাই শুধু চলছিল, আকাশের দিকে। সবাই নাক ধরেই বাড়ি ফিরেছিল, গন্ধটা সহ্য করা যায়নি, ঘুম আসছিল। এক দুই জন যে গাছের নিচে মাঠে স্কুলের গেইটের পাশে পুকুর ঘাটে ঘুমিয়ে পড়েনি এমন নয়, কিন্তু তারা অজ্ঞান হয় নি। বাড়ি থেকে লোক গিয়ে কোলে করে নিয়ে এসেছে। তারা আস্তে আস্তে সজাগ হয়েছে। রায়হান তার বাসায় এসে দেখেছে উঠানেই দুইটা আতর জ্বিন উপরের দিকে উঠছে, তার গায়ে ফুটি ফুটি ফুল হুল ফুটাচ্ছে। রাতে সারা বাড়িতেই হয়ত সারা গাঁয়েই এমন শো শো বাতাস হয়েছে। পুরা গ্রামটা এক থোকা ছাতিম ফুলের মত দুলছে যেন, আর কি সুবাস, সে-রাতে তাদের সবার কত আরামের ঘুম হল। ঘুমের ভিতর আতর জ্বিনেরা দুলছিল। রায়হানের আর কিছুই মনে নাই।
অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠেছে রায়হান। এরপর আর ক্ষণে ক্ষণে ঘুম পায়নি। বায়োস্কপের মতো আর ফুল ও ফুটছে না ছাতিম গাছে। শান্ত এখন অনেক, তাদের নাক সয়ে গেছে গন্ধটা। আলাদা করা না গেলেও তাদের সবার শরীর থেকেই সুবাস আসছিল, পায়খানাতে বসেও রায়হান গন্ধ পায় আতর জ্বিনের, তা কি পেছনে থাকা ছাতিম গাছ থেকে না তার নিজের শরীর থেকেই আসছে বুঝতে পারে না রায়হান। ছাতিমের ডালগুলা যখন ঝাপটা মারে বাতাসে তারা এসে মাথায় বিলি কেটে কেটে কি জানি ফিশফিশ করে। রায়হান মন দিয়ে শুনে। কিছু কিছু সে বুঝতেও পারে। কিন্তু বলতে পারে না বন্ধুদের। তার আব্বা বা আম্মা রে সে বলতে চায় না। একটু ভয়-ই করে বলতে, সে ও কি আতর জ্বিন হয়ে যাচ্ছে তাহলে! কিন্তু রায়হান ভাবে, মামুনো ত হেইদিন কইলো! আতর জ্বিনডি অনেক বালা! কিরুম আদর কইরা কতা কয়, মনঅয় ঘুমায়া যাইতাসি, কি কয় কিচ্চু মনো থাহে না, খালি মনয় কেউ আমার সারা শইলো হাতায়া দিতাসিন স্বপ্নে, নানুর লাগান। আর যেইবা গন্ধ হয়, বাইরে বাই। রায়হান ভাবে, আমরা সবাইই কি তাইলে আতর জ্বিন অয়া যাইতাছি!