সমন্বয়হীনতা ও বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা

রেজাউল করিম স্বপন | সোমবার , ১৯ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ

মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে জ্ঞান অর্জনের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষা গ্রহণ করে পরীক্ষা পাসের জন্য, জ্ঞান লাভের জন্য নয়। তাই দেশে শিক্ষার্থী পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় পরীক্ষার্থী। শিক্ষা বাংলাদেশে সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণ পরিষদে বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ থেকে তা কার্যকর করা হয়। এতে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য ঘোষিত চারটি মূলনীতি হলো সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম নিরপেক্ষতা। সমাজতন্ত্র বলতে সব ধরনের শোষণ বৈষম্য বঞ্চনা ও দুর্নীতিহীন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাকে বুঝানো হয়েছে।

যেখানে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব হবে মানুষের মৌলিক অধিকার অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পূরণ করা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে বিগত ৫০ বছরে সরকার বেশ কয়েকটি শিক্ষা কমিশন ও কমিটি গঠন করেন। সেই কমিশন ও কমিটিগুলো শিক্ষাকে সুচারুভাবে পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদান করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সর্ব প্রথম ড. কুদরাত-এ-খুদাকে প্রধান করে একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রধানের নামানুসারে যা কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন নামে পরিচিত।

এরপর ১৯৭৬ সালে একটি জাতীয় কারিকুলাম ও সিলেবাস প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৮৩ সালে মজিদ খান শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৮৭ সালে মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এরপর শিক্ষা খাতের অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার শনাক্ত করতে ড. এম আব্দুল বারীর নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয় ২০০১ সালে। কমিটি ২০০২ সালে তার প্রতিবেদন জমা দেয় এবং বেশ কয়েকটি বিষয়ে হস্তক্ষেপের পরামর্শ দেয়। যা পরে ২০০৩ সালের শিক্ষা কমিশন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে বিবেচিত হয়েছিল।

এরপর জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০ হালনাগাদ করার জন্য বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ষোল সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি কুদরত-ই-খুদা কমিশনের রিপোর্ট ১৯৭৪, শামসুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৯৭ ও জাতীয় শিক্ষা নীতির আলোকে নতুন শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করে এবং ২০০৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর খসড়াটি আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কাছে পেশ করে। কমিশনের সুপারিশগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে স্নাতক শিক্ষা তিন স্তর থেকে দুই স্তরে সংশোধন করা। শিক্ষার সমস্ত ধারার অধীনে কিছু বিষয়াবলীর বাধ্যতামূলক অন্তর্ভুক্তি।

শিক্ষাকে আরও প্রয়োগ ভিত্তিক করে তোলা এবং একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করা। নীতিমালাটিতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাড়ানো। অষ্টম শ্রেণির শেষ পর্যায়ে চূড়ান্ত প্রাথমিক স্তরের পরীক্ষা ও ফলাফলের ভিত্তিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বৃত্তি প্রদানের প্রস্তাব। নতুন নীতিতে সুপারিশ করা হয়েছে, মাধ্যমিক স্তরের পড়াশোনা চার শিক্ষা বর্ষ অর্থাৎ নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমপ্রসারিত হবে এবং দশম শ্রেণির শেষে সরকারি পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। চূড়ান্ত মাধ্যমিক স্তরের পরীক্ষা দ্বাদশ শ্রেণির শেষে অনুষ্ঠিত হবে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রমের বিভিন্ন ধারায় (ইংলিশ মিডিয়াম বাংলা মিডিয়াম ও মাদ্রাসা শিক্ষা) বাংলা, গণিত, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশের অধ্যয়ন, প্রকৃতি ও পরিবেশ, সামাজিক গবেষণা, তথ্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানসহ কয়েকটি মৌলিক বিষয় বাধ্যতামূলক করা হবে। নীতিমালাটিতে সকল মাধ্যমিক স্তরের প্রতিষ্ঠানে কিছু প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রবর্তন করারও আহ্বান জানানো হয়েছে। বাধ্যতামূলক বিষয়গুলির মধ্যে তথ্য প্রযুক্তি এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করে মাদ্রাসা শিক্ষার পুনর্গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। কমিটি বেসরকারি শিক্ষক কমিশন গঠনেরও সুপারিশ করেছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় সুপারিশ দেওয়ার এক যুগ পার হলেও এখনো তা কার্যকর করা হয়নি। প্রশ্ন হলো যদি যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে দেশের সেরা শিক্ষাবিদদের দিয়ে কমিশন করার প্রয়োজনীয়তাটি কোথায়?

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেজন্য ঐসব দেশে সব শিশুর জন্য সমন্বিত প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। সে সব দেশে সব শিশুকে একই ক্যারিকুলামে একই সিলেবাসে শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম হলো বাংলাদেশ। এখানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা মিডিয়ামে ন্যাশনাল ক্যারিকুলামে শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্ডারগার্টেনে ইংলিশ মিডিয়ামে ন্যাশনাল ক্যারিকুলামের পাশাপাশি ব্রিটিশ ও ক্যামব্রিজ ক্যারিকুলামে শিক্ষা দেওয়া হয়।

মাদ্রাসার মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসায় মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে ও কওমি মাদ্রাসায় তাদের নিজস্ব ক্যারিকুলামে শিক্ষা দেওয়া হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেজি স্কুল ইংলিশ মিডিয়াম ও আলিয়া মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা শিক্ষার্থীরা পাস করে দেশের মুল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় আসার সুযোগ থাকলেও কওমি মাদ্রাসায় লেখাপড়া করা শিক্ষার্থীরা মূল ধারায় আসার কোনও সুযোগ নেই। অথচ দেশের জনগোষ্ঠীর একটা বৃহৎ অংশের শিক্ষা জীবন শুরু হয় কওমি মাদ্রাসায়। মার্চ ২০২২ এ প্রকাশিত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের করা ২০২১ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারীর তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮৯১টি। যার মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৫৬৬টি, বাকী ৫৩ হাজার ৩২৫টি বেসরকারি স্কুল ও কিন্ডার গার্টেন। মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২০ হাজার ২৯৪টি। এমপিওভুক্ত আলিয়া মাদ্রাসা ৫৫৭টি, ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ৪ হাজার ৩১২টি। সরকারি, বেসরকারি স্কুল ও কেজি স্কুলে বাংলা ইতিহাস ভূগোল গনিত ইংরেজি সাধারণ বিজ্ঞান ধর্ম পড়ানো হয়। এর বাইরে মাদ্রাসাগুলোয় আরবিতে বিভিন্ন বিষয় পড়িয়ে থাকে।

তবে সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও আমরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত ধারার মধ্যে সমন্বিত একটি ক্যারিকুলাম প্রণয়ন করতে পারিনি । কেউ যদি তার সন্তানকে শিক্ষা জীবনের শুরুতে বাংলা মিডিয়ামে শিক্ষা দিতে চান, তবে তার জন্য মান সম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও ব্যবস্থা নেই। যা বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅ্যান্থোপোসিন যুগে দাঁড়িয়ে জলবায়ু ভাবনা
পরবর্তী নিবন্ধনা ফেরার দেশে অনন্য সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব প্রফেসর তপনজ্যোতি বড়ুয়া