‘মুক্তিযোদ্ধার স্বপ্ন: স্বাধীনতা, স্বাধীনতা দেখিলাম, ক্ষুধা দারিদ্র্যের মুক্তি দেখিলাম না। আমার চাওয়া পাওয়ার ইতি হইয়াছে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সনে। ৩১ টা বৎসর অতিক্রান্ত হইল কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হইল না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উজ্জ্বল সূর্যটি বর্তমানে রাহুগ্রাসে পতিত হইয়াছে। কিন্তু এও জানি যে রাহুর গলাটা কাটা এবং তার গলাধঃকরণকৃত সূর্যটি ওই কাঁটা গলার নিচের দিক দিয়ে আবার নিশ্চিতভাবে বাহির হয়ে আসিবে। এটা পরিবর্তনশীল ইতিহাস ও নতুন ইতিহাস নির্মাতা পরিবর্তনশীল জনগণের প্রতি গভীর বিশ্বাসপ্রসুত সত্য।’
কথাগুলো সংগৃহীত করা হয়েছে ২৭/০৯/২০০২ সালে চট্টগ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধা আমার বাবা বরুণ কান্তি চৌধুরীর ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা থেকে। তিনি ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন দেশ প্রেমিক, সৎ, তখনকার দিনের একজন সুশিক্ষিত মানুষ এবং সর্বোপরি একজন মানবিক মানুষ। এই মানুষটা কখনো নিজেকে প্রচার করেননি। করেননি কখনো নিজের ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ। দেশকে ভালোবেসে নীরবে চলে গেলেন ২০১১সালের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের ১৯ তারিখে।
এই মুক্তিযোদ্ধার জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়া থানার হাবিলাসদ্বীপ গ্রামে। চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। বাবা যখন প্রথম শ্রেণীতে পড়তেন তখনই উনার মা (আমার ঠাকুরমা) বসন্ত রোগে মারা যান। আমার ঠাকুমার মৃত্যুর দুই বছর পর আমার দাদুও মারা যান। বাবা তখন পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে পড়েন। বাবার বড় বোন তখন ঢাকাতে থাকতেন। উনি এরপর বাবাকে উনার সাথে ঢাকাতে নিয়ে গেলেন। এবং সেখানে সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
সেখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন । বাবার বড় বোনের হাজব্যান্ড ফুড ডিভিশনে সরকারী চাকরী করার কারণে বাবার বড় বোনকে (আমার বড় পিসি কে) দু’বছরের জন্য করাচী চলে যেতে হয়েছিল তাই বাবা নবম ও দশম শ্রেণী হাবিলাসদ্বীপ স্কুল থেকে পড়ে এসএসসি কুমিল্লা বোর্ড থেকে পাস করেন। পুনরায় এইচএসসি ঢাকা কলেজ থেকে পাস করেন। এইচ এস সি পাস করার পর পুনরায় চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ হইতে বিকম পাস করেন। এরপর বাবার খুব ইচ্ছে ছিল বিদেশে লেখাপড়া করার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে একজন স্পন্সর ও বাবার জুটে গিয়েছিল।
কদুরখীল গ্রামের বেনুভূষণ চৌধুরী লন্ডনে বাস করতেন ওইখানে তিনি ডাক্তারি করতেন। তিনি ভীষণ দয়ালু এবং সমাজসেবক ছিলেন। বাবা লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইসিএমএ তে ভর্তি হয়ে গিয়েছিলেন কিন্তু বাবার নিজের অবহেলার দরুন একটা গুরুত্বপূর্ণ ফরম সংগ্রহ না করায় বিদেশে যেতে পারেন নি। ১৯৬৯ সালে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ৬৯ এর গণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে ব্যাকসুর খালাস পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যেদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মিটিং হয়েছিল ঐদিন ওই ময়দানে বাবা উপস্থিত ছিলেন এবং শেখ মুজিবের ভাষণ শুনেছিলেন।
১৯৭১সালের ২৬ শে মার্চ থেকে বাংলাদেশে পাকসেনারা রাস্তায় নেমে পড়ে। নির্বিচারে গণহত্যা চলে। বাবা তখন যুবক এবং চট্টগ্রাম ও কমার্স কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়। চারদিকে পরিস্থিতি খারাপ দেখে বাবা নিজ গ্রাম হাবিলাসদ্বীপে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ।যাওয়ার পথে বোয়ালখালীর মিলিটারি ব্রিজের কাছে এক প্লাটুন মিলিটারির সম্মুখীন হয়েছিলেন। কোনরকম ভাগ্যক্রমে ঐদিন ওদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। শুনলেন ঐদিন শাকপুরার আট দশজন লোককে ওরা হত্যা করেছিল। বাড়ীতে যাবার পথে দেখে সেনের হাট এবং ব্যাংক পুড়িয়ে দিয়েছে মিলিটারিরা।
বাড়িতে এসে দেখে কেউ নাই সবাই করনখাইন গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। বাবা শহরে থাকাতে এসব জানতেন না। তখন যুবক ছেলে পেলেই তারা ধরে নিয়ে যেত বা মেরে ফেলত কারণ যুবকেরা মুক্তিবাহিনীতে যাচ্ছে।। তখন বুঝলেন গ্রামে আর থাকা যাবে না ভারতে চলে যেতে হবে। পাক বাহিনীরা রাতে চারদিক থেকে গ্রাম ঘিরে রাখে এবং সকালে যুবক ছেলেদের ধরে মেরে ফেলে। তখন মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ।বাবা ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।
বাবার চিন্তা চেতনায় শুধু মুক্তিযুদ্ধের জন্য ডাক আসছে। বাবার কথায়, ‘মৃত্যুকে বুকে বাঁধিয়া যুদ্ধে যাত্রা করিলাম, মৃত্যু অবশ্যই আসবে, কেউ তাহা রোধ করতে পারিবে না।’ বাবা নিজের দেশকে এতই ভালোবাসতেন যে নিজের বালিশের নিচে সব সময় জাতীয় পতাকা রেখে ঘুমাতেন। মৃত্যুর পর এই জাতীয় পতাকা জড়িয়েই উনার শেষকৃত্য হয়। এই বিজয়ের মাসে ২০১১ সালের ১৯ তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার দেশের প্রতি কি অগাধ ভালোবাসা তা নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার বাবাকে দেখে। বিজয়ের এই মাসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই সকল মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।