
যুদ্ধ ক্ষেত্রে বাঙালি নারীর ভূমিকা বিরল। তাই তালিকাও ছোট। তবে সশস্ত্র প্রতিরোধ ও প্রতিবাদে বাঙালি নারীর অভিজ্ঞতা বৈচিত্র্যময়।বিধূভূষণ ভট্রাচার্যের ‘বঙ্গ বীরাঙ্গনা রায়বাঘিনী গ্রন্থের ভূমিকায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, দক্ষিণ রাঢ়, ভুরশুট ও নিকটবর্তী পরগনাগুলোকে নিয়ে যে রাজ্য ছিলো তা ধ্বংস হয়ে যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে ভাগে। এই বংশের রাণী ভবশংকরী উড়িষ্যার পাঠানদের সঙ্গে যুদ্ধ করে রাজ্য রক্ষা করেছিলেন।
মোঘল সম্রাট আকবর এজন্য তাঁকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘রায় রায়বাঘিনী’। অনেক বীর নারীর পরিচয় পাওয়া যায় বাঙলার লোকজ উপাখ্যানে। ইংরেজ শাসনামলের প্রথম দিকে বাঙলায় দু’পর্যায়ে সংগঠিত হয়েছিল চুযাড় বিদ্রোহ। নারী সংগ্রামীদের অংশগ্রহণ ও স্পষ্ট ও প্রবল ছিল উভয় বিদ্রোহে। একপর্যায়ে নারী বিদ্রোহীদের তত্পরতায় প্রায় উদভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলো স্থানীয় প্রশাসন।এই বিদ্রোহের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ইংরেজদের হাতে বন্দি নারীদের কাছ থেকে কোন তথ্য বের করতে পারেনি। তাঁদের এই ব্যর্থতার কথা প্রকাশ পেয়েছিল তত্কালীন বাঁকুড়া জেলার ইংরেজ জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের লেখা এক চিঠিতে(১৭৭৪). তিতুমীরের নেতৃত্বে নীল বিদ্রোহ বাঙালি কৃষক সমাজের এক গৌরবময় অধ্যায়।এ বিদ্রোহে এগিয়ে এলেন তিতুমীরের সাহসী মা এবং এক ঝাঁক নারী। উনিশ শতকের ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম নেত্রী ছিলেন দেবী চৌধুরানী।
তেভাগা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, যুদ্ধংদেহী গ্রামীন নারীরা পুরুষতান্রিক সমাজের আবহে থেকেও নিজেরা যুথবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলেছিলেন “নারী বাহিনী। ব্রিটিশ শাসনামলে তেভাগা আন্দোলন ছাড়াও আমরা জানি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নানাভাবে নারীরা সংগঠিত হয়েছেন। তবে একজন প্রথম নারী শহীদ প্রীতিলতান ওয়াদ্দেদার ছাড়াও অনেক নারী বিশেষত তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের নাম ইতিহাসের পাতায় উঠে আসেনি। তারা রয়ে গেছেন অন্ধকারে।
এরপথ ধরেই ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন বাংলাদেশ! সেখানে প্রথমে এলো শুধু মাত্র যুদ্ধে নির্যাতিত নারীর কথা। শুধু একটা বাক্য! দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে!!! অথচ নারীরা যে সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কাজ করেছেন তা ইতিহাসের অন্তরালে অনেক অনেক দিন। পরবর্তী তে আমরা জেনেছি নারীর বিভিন্নমুখী অবদানের কথা। ………………….
একাত্তরের ২৫ মার্চের কালো রাতে বুকে মাইন বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়েন পাকিস্তানি প্যাটন ট্যাংকের সামনে। এতে এটি ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি শহীদ হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলে তিনি বীর কিন্তু শহীদ বলা হয়নি। স্বাধীনতা অর্জনের পরে সশস্ত্র নারী মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে উদাসীনতা ছিলো অনেকে জানতোওনা। পরিচয় একটাই নারীর সম্ভ্রম হারানোর বিনিময়ে। ধীরে ধীরে একজন শিরিন বানু মিতিলা নিজের উদ্যোগে ওপারে গিয়ে পুরুষের বেশে তাদের সাথে থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার আগে পরাধীন দেশের অসহযোগ আন্দোলনে রাস্তায় ব্যারিকেডে অংশ নেন। সিরাজগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা মনিকা মতিন, ভালোভাবে বন্দুক চালানো না শিখলেও ক্যাম্পের পাহাড়ায় থেকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাবধান করে দিতেন। ১১ নাম্বার সেক্টরে হামিদুর রহমানের সাথে কাজ করেছেন বগুড়ার ফেরদৌস আরা ডলি। তাঁর আক্ষেপ –আমরা বন্দুক, এল এম জি, স্টেনগান ধরেছি। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রান্না করেছি।
কিন্তু ইতিহাসের পাতায় আমরা উপেক্ষিত। স্বাধীনতার প্রায় আটাশ বছর পরে চারজনের বীর প্রতীক খেতাবে, একজন ক্যাপ্টেন সিতারা। আর অন্যদের একজন তারামন বিবি। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি ভিক্ষে করে জীবন নির্বাহ করেছেন। কাঁকন বিবি ছিলেন খাসিয়া পরিবারের মেয়ে। রাষ্ট্র তাঁকে সম্মানিত করেনি, করেছে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকা ১৯৯৮ সালে। তিনি ছিলেন এক সাহসী যোদ্ধা, একসময়ে হানাদারদের হাতে বন্দি হলেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ১৯৯৯ সালে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি কতৃক সম্মানিত হন দুই সাহসী মুক্তিযোদ্ধা মেহেরুন্নিসা মীরা ও হালিমা খাতুন।
বরিশালের শাহানা পারভীন শোভাও এক অসাধারণ সাহসী মুক্তিযোদ্ধা। তাঁকেও পুরস্কৃত করে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকা ১৯৯৯ সালে। পাবনা জেলার সাথিয়া ভানুনেছা বেগম মাঠ পর্যায়ে যুদ্ধ করলেও মিডিয়ার আড়ালে। এভাবে তেভাগার পালিয়া বামোনী, বিমলাজি, দুখুমথ্ বিবি হাজারো সশস্ত্র নারী মুক্তিযোদ্ধার নাম ইতিহাসের পাতায় কিছুটা হলেও এসেছে ব্যাক্তিগত গবেষণায়। নারী বাহিনী ও গঠন করেছিলেন মেজর জলিল যাদের বেশির ভাগ তৃণমূল পর্যায়ের।
গভীর আক্ষেপ ও বেদনায় বলতে হয় এরা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রেখেও কেউ তাদেরকে সম্মানিত করেনি বরং অনেকের পরিবার, সমাজ যেমন, তেমনি রাষ্ট্র ও এগিয়ে আসেনি। তাঁরা শুধু সহায়ক শক্তি হিসেবে পরিগনিত ইতিহাসের পাতায়। এমনি ভাবে অবহেলিত কিন্তু সশস্ত্র নারী যোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী ইতিহাসের পাতায় অবহেলিত থেকে গেল।
লেখক : সাহিত্যিক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ, চট্টগ্রাম।









