হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেন করদাতারা

চসিকের গৃহকর আপিল শুনানিতে অংশ নিলেন মেয়র

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

প্রস্তাবিত পৌরকর (হোল্ডিং ট্যাক্স ও রেইট) নিয়ে করদাতাদের অভিযোগ শুনে তাৎক্ষণিক এর সমাধান দিয়েছেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন করদাতারা। গতকাল অনুষ্ঠিত রাজস্ব সার্কেল-২ এর আওতাভুক্ত গৃহকরের আপিল শুনানিতে অংশ নিয়েই করদাতাদের অভিযোগ শুনেন মেয়র। এসময় তিনি করদাতাদের দাবি অনুযায়ী ‘সহনীয়’ হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্য করেন। এতে খুশি হয়ে আপিলকারীদের বাড়ি ফিরতে দেখা গেছে। এর আগে তাদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান রাজস্ব বিভাগের কর্মীরা।

জানা গেছে, বহাদ্দারহাটের একটি কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত শুনানিতে রাজস্ব সার্কেল-২ এর আওতাভুক্ত চান্দগাঁও, পূর্ব ষোলোশহর ও মোহরা ওয়ার্ডের ১৪৭টি আপিল নিষ্পত্তি করা হয়। সকাল ১১টা থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই শুনানি চলে।

শুনানিতে অংশ নেয়া আপিলকারী শহীদ বলেন, পূর্বে দুই হাজার ৭০০ টাকা গৃহকর পরিশোধ করতাম। এসেসমেন্টে সেটা ৩৬ হাজার টাকা ধার্য্য করে। আপিল করেছিলাম। আজ (গতকাল) শুনানিতে সেটা পাঁচ হাজার টাকা করে দেয়। এতে আমি খুশি।

আরেক করদাতা বলেন, বছরে ৮৪২ টাকা ট্যাক্স দিতাম। সেটা বৃদ্ধি করে করা হয় ২৫ হাজার টাকা। আপিলে মেয়র মহোদয় সেটা আড়াই হাজার টাকা করে দেন এজন্য মেয়র মহোদয়কে অসংখ্য ধন্যবাদ।

লায়লা বেগম নামে এক করদাতা বলেন, চান্দগাঁওয়ের দর্জি পাড়ায় একতলা ভবন রয়েছে। আমার বাড়ির গৃহকর ছিল দুই হাজার ৪০ টাকা। সেটা বৃদ্ধি করে সিটি কর্পোরেশন ধার্য্য করে ২০ হাজার টাকা। এখন আপিলে সেটা তিন হাজার ৭৪০ টাকা করা হয়।

লাললা বেগম জানান, তার স্বামী মারা গেছে অসুখে। বাবার করে দেয়া বাড়িতে দুই সন্তান নিয়ে থাকেন। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আরেক মেয়ে কলেজে ও ছেলে বিদ্যালয়ে পড়ে। তার নিজস্ব কোনো আয় নেই। ভাইদের আর্থিক সহায়তায় সংসার চালান। তাই প্রস্তাবিত গৃহকর আরেকটু কমিয়ে দিলে ভাল হত।

চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ নুরুল আলম জানান, দোতলা ভবনের জন্য আগে ৫ হাজার ১০০ টাকা গৃহকর দিতেন। এসেসেমেন্টে সেটা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। আপিলের পর সেটা ১০ হাজার ২০০ টাকা গৃহকর নির্ধারণ করা হয়েছে।

চান্দগাঁওয়ের ফরিদার পাড়ার বাসিন্দা সৌরভ বড়ুয়া জানান, তাদের আধা পাকা তিনটি ঘর রয়েছে। সেগুলোর জন্য ৮৪২ টাকা গৃহকর দিতেন। কিন্তু তা বাড়িয়ে ধার্য্য করা হয় ২৫ হাজার টাকা। আপিলে তা আড়াই হাজার টাকা ধরা হয়েছে। এখন এটি সহনীয় হয়েছে। সেলিম এক আপিলকারী বলেন, আমি সন্তুষ্ট। এ জন্য মেয়র মহোদয়কে ধন্যবাদ জানাই। রফিক নামে আরেক করদাতা বলেন, সহনীয় পর্যায়ে করা হচ্ছে। সবাই খুশি হচ্ছেন।

উপস্থিত সাংবাদিকদের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, করদাতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই সহনীয় পর্যায়ে গৃহকর নির্ধারণ করছি। মানুষ সন্তুষ্ট হচ্ছে এবং বিভ্রান্ত্রিও দূরীভূত হচ্ছে। ট্যাক্স নিয়ে যে বিভ্রান্তি সেটা দূর করার জন্য, মানুষের মনে স্বস্তি এনে দেয়ার জন্য, ট্যাক্স নিয়ে আতংকিত না হওয়ার জন্য উদ্যোগটা গ্রহণ করেছি। তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে ৪১ ওয়ার্ডে এ শুনানির আয়োজন করব।

মেয়র আরো বলেন, সিটি কর্পোরেশন একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। নগরবাসীর গৃহকর থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব দিয়ে নাগরিক সেবা প্রদান করা হয়। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নতুন করে কর মূল্যায়ন বিধান থাকলেও বিগত ২০১১-১২ সালের কোন কর মূল্যায়ন করা হয়নি। ২০১৭ সালে গৃহকরের যে মূল্যায়ন হয়েছিল স্থাগিত রাখা হয়েছিল। চলতি বছর মন্ত্রণালয় থেকে স্থগিতকৃত কর মূল্যায়ন আবার সচল করার নির্দেশনা আসে। এই নির্দেশনা কার্যকর করতে গিয়ে দেখা যায় ২০১৭ সালের কর মূল্যায়ন যথেষ্ট অসঙ্গতি রয়েছে। এই অসঙ্গতিকে দূর করার জন্য সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আপিল বোর্ড গঠন করা হয়। আপিল করলে গৃহকরে যে অসঙ্গতি আছে তা দূর করা এবং করদাতাদের সহনীয় পর্যায়ে কর নির্ধারণ করার গুরুত্ব দেয়া হয়। বিষয়টিকে আরো সহজ করার জন্য কাউন্সিলর এবং আপিল বোর্ডেকে সঙ্গে নিয়ে করদাতাদের গণশুনানির ব্যবস্থা করা হয়।

প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও মেয়রের একান্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল হাসেমের সঞ্চালনায় শুনানিতে বক্তব্য রাখেন, আপিল বোর্ডের প্রধান কাউন্সিলর আবুল হাসনাত মো. বেলাল, এম আশরাফুল আলম, মো. কাজী নূরুল আমিন, মো. এছারারুল হক, রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ, কর কর্মকর্তা ও কর আদায়কারী এবং স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।

জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই চসিক মোট ১৭ শতাংশ পৌরকর আদায় করে থাকে। তার মধ্যে ৭ শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স (গৃহকর), ৩ শতাংশ বিদ্যুতায়ন রেইট এবং ৭ শতাংশ আর্বজনা অপসারণ রেইট রয়েছে।

এদিকে দি সিটি কর্পোরেশন ট্যাক্সেশান রুলস অ্যাক্ট ১৯৮৬ এর ২১ ধারা মতে, সিটি এলাকায় প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সকল প্রকার স্থাপনার পরিমাপ ও সংশ্লিষ্ট তথ্য সরেজমিন সংগ্রহ করে পৌরকর নির্ধারণ করা হয়। আইনটির আলোকে ২০১৬ সালে গৃহ ও ভূমির পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়ন (রি-এসেসমেন্ট) করে চসিক। এর মধ্যে ২০১৬ সালের ২০ মার্চ প্রথম দফায় নগরের ১১টি ওয়ার্ডে এসেসমেন্ট শুরু করে এবং একই বছরের ২০ জুন শেষ হয়। দ্বিতীয় দফায় একই বছরের ১৮ অক্টোবর বাকি ৩০টি ওয়ার্ডে এসেসমেন্ট শুরু করে এবং তা শেষ হয় ২০১৭ সালের ১৫ জানুয়ারি। পুর্নমূল্যায়ন শেষে তা ২০১৭ সালের ৩১ আগস্ট জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়।

তখন প্রস্তাবিত পৌরকের বিরুদ্ধে আপত্তি জানান ভবন মালিকরা। বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তারা মাঠে নামেন। এক্ষেত্রে ‘চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ’ ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে। এরপর একই বছরের ২৬ নভেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করেন মন্ত্রণালয়টির শীর্ষ কমর্তকর্তারা। এতে সারা দেশের গৃহকর কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় না আসা পর্যন্ত এসেসমেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্ত হয়। যা ১০ ডিসেম্বর চসিককে পত্র দিয়ে জানিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়। অবশ্য এর আগে মৌখিক নির্দেশনার প্রেক্ষিতে ২৭ নভেম্বর থেকে এসেসমেন্ট কার্যক্রম স্থগিত করেছিল চসিক। গত ২ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রস্তাব দেয় চসিক। এরপর ১৮ জানুয়ারি স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। অবশ্য বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার চার মাসের মাথায় ২০২০ সালের ৩ জুনও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল চসিক।

সর্বশেষ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের পর গত ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের এসেসমেন্ট’র আলোকে কর আদায়ে কর্যক্রম শুরু করে চসিক। গত ২৩ আগস্ট থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদ। ইতোমধ্যে মেয়রকে নিয়ে ‘কটুক্তি’ করার অভিযোগে দায়ের হওয়ায় মামলায় গ্রেপ্তার হন সংগঠনটির সভাপতি নুরুল আবছর। বর্তমানে কর্মসূচি অব্যাহত আছে চট্টগ্রাম করদাতা সুরক্ষা পরিষদের। এর মধ্যেই আপিল শুনানিতে অংশ নিয়ে মেয়র প্রশংসায় ভাসলেন করদাতাদের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআওয়ামী লীগ কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধচাপাতির কোপে কিশোরের পা হারানোর শঙ্কা