অনেদিন পর কামাল বাড়ি ফিরছে। সে ঢাকায় একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করে। ছ’মাস পর সে বাড়ি ফিরছে। তাদের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা গ্রামে। মাটিরাঙ্গা বাজারে নেমে কামাল দুই কেজি মিষ্টি কিনল। গ্রামের অনেকের সাথেই দেখা। সবাইকে সালাম করলো কামাল। কামাল লক্ষ্য করলো এই ছয় মাসে গ্রামের মানুষজন কেমন জানি হয়ে গেছে। গ্রামের চেহারাও পাল্টে গেছে। মিষ্টি হাতে নিয়ে কামাল একটা ব্যানে চড়ে বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছে। তাদের গ্রাম মাটিরাঙ্গার একদম ভেতরে পাহাড়ের উপর। এলাকার মহাজন বাইশটি ভ্যানগাড়ি বানিয়েছে। আর সুনামগঞ্জ থেকে বাইশজন মানুষকে এখানে এনে কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ভ্যান চালকের সাথে কামালের কথা হলো অল্প। বেশি কথা বলার অভ্যাস নেই বোধহয় লোকটির। তাই কামালের চুপ হয়ে যেতে হলো। অর্ধেক পথ না যেতেই দেখা হয়ে গেলো গলাকাটা জামালের সাথে। ভ্যান থামিয়ে তার সাথে কোলাকুলি করলো কামাল। দু’জনেই ভ্যানে উঠে বসলো। জামালের মুখটা আগের চাইতে অনেক ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। কামাল ভাবছে, ছয়মাসে সবাই কত পরিবর্তন হয়ে গেছে।
জামালকে গলাকাটা জামাল বলার কারণটা কিন্তু খারাপ নয়। সে গলা কাটে না। তার গলায় একটা কাটা দাগ আছে। ছোট বেলায় ডাংগুলি খেলতে গিয়ে গলায় লেগে কেটে গিয়েছিলো। এরপর থেকেই তার নাম গলাকাটা জামাল হয়ে গেছে। গলাকাটা জামাল ডাকার পেছনে আরও একটি কারণ আছে। সেটা হচ্ছে এলাকায় তিনটা জামাল আছে। একটা গলাকাটা জামাল, একটা ভণ্ড জামাল, আর একটা কালো জামাল। কালো জামালের গায়ের রং কালো বলেই এটা ডাকা হয়। আর ভন্ড জামালকে অতিরিক্ত ভন্ডামি করার কারণে এই নাম দেওয়া হয়েছে। যদিও তার সামনে ভন্ড জামাল বললেই সে রেগে যায়। পেছনেই বলে সবাই। আর মূলত চেনার জন্যই এসব নাম।
যাই হোক অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা। ভ্যানে চড়ে বেশ কিছুক্ষণ দুই বন্ধু কথা বলছে। জামাল অবশ্য কমই কথা বলেছে। বেশিরভাগ কামালই কথা বলেছে। ঢাকা-শহরের জীবনযাপন সম্পর্কে কামাল জামালকে বলছে। কথা বলতে বলতে একসময় গ্রামে প্রবেশ করার আগেই জামাল একটা কবরস্থানের সামনে নেমে গিয়েছে। তাকে কামাল জিজ্ঞেস করলো কই যাবি?
সে বললো, আমার একটা কাজ আছে। তুই যা। তোর সাথে আবার দেখা করবো আমি।
কামাল আর কথা বাড়ালো না। তার মুখ দেখে এমনিতেই কামালের ভালো লাগেনি। পরে কামাল সবকিছু জিজ্ঞেস করে নেবে। বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে কামাল। মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে কামাল পাহাড়ের উপর সরু রাস্তায় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করে তার মিষ্টির প্যাকেটটার ওজন কম কম লাগছে। দুই কেজি মিষ্টির ওজন কখনও এতো কম হতে পারে না। যাই হোক ওই দোকান থেকে আরকিছু কামাল কিনবে না এটাই ঠিক করলো। বাড়ি গিয়ে কামাল তার মাকে জড়িয়ে ধরলো। সবাই তার কাছে আসলো। জড়িয়ে ধরে আদর করছে মা বাবা। চাচা-চাচিরাও এসেছে অনেকদিন পর কামালকে দেখতে।
এতোক্ষণ পর কামাল ফিরে পেলো আসল আমেজ। সবাইকে দেখে তারও ভীষণ ভালো লাগছে। কামাল মায়ের হাতে মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে বললো, সবাইকে মিষ্টি দাও মা।
কামালের মা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে খোলামাত্রই এক ভিন্ন দৃশ্য দেখলো। অবাক হয়ে কামালকে ডাকছে, কামাল কামাল।
কামাল বললো, কি হয়েছে মা?
কামালের মা বললো, মাত্র তিনটা মিষ্টি আনলি তুই?
কামাল মনে মনে ভাবছে এতোকম মিষ্টি কখনও দিতে পারে না। তাছাড়া কামালের সামনেই তো দোকানদার অনেকগুলো মিষ্টি প্যাকেটে ঢুকিয়েছে। এতোক্ষণে কামালের সন্দেহ হচ্ছে জামালের প্রতি। সে খায়নি তো! কিন্তু এতোগুলো মিষ্টি খাওয়ার সময় কামাল একটুও টের পেলো না, এটা কীভাবে হয়।
কামালের চিন্তিত মুখ দেখে তাঁর মা বললো, কি হয়েছে?
কামাল বলছে, মা মিষ্টি আমি দুই কেজি নিয়েছি। কিন্তু এতোগুলো মিষ্টি কই যাবে?
আসার সময় আমি আর জামাল এসেছি। সে তো এতোগুলো মিষ্টি খাবে না।
কামালের মা জিজ্ঞেস করলো কোন জামাল?
কামাল বললো, গলাকাটা জামাল।
পুরো বাড়ির সবাই তখন অবাক। কেউ আবার হকচকিয়ে গেছে। কারও কারও মুখে ভয়ের ছাপও দেখা যাচ্ছে। কারও কোনো সাড়াশব্দ নেই।
কামাল জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে? কেউ কিছু বলছো না যে?
তার ছোট ভাই কামরান বললো, ভাইয়া জামাল ভাই তো চার মাস আগে মারা গেছে।
এই কথা শুনে কামাল হকচকিয়ে গেলো।
সবাই কামালের কথা পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও বিষয়টা নিয়ে চিন্তায় পড়েছে।
গলাকাটা জামাল সবসময় মিষ্টি খেতো। তাই তার সন্দেহটা বেশিই। তাছাড়া কামাল নিজে তার সাথে কথা বলেছে। নিজের চোখকে তো অবিশ্বাস করা যায় না।
কামাল তার ছোট ভাইকে নিয়ে জামালের কবরের দিকে গিয়েছে। আসার সময় জামাল যেখানে নেমেছে সেখানেই তার কবর। কবর দেখে কামাল ভয়ের চেয়ে বেশি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। জামালের কবর জিয়ারত করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল কামাল। আর আসার সময় জামালের মৃত্যু সম্পর্কে ছোটভাই থেকে সবকিছু শুনলো।
পরেরদিন সন্ধ্যায় কামাল আবার জামালের দেখা পায়। এবার দেখা হয় পুকুর ঘাটে। কামাল জামালকে দেখে এবার প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। জামাল সেটা দেখেই বুঝতে পারে।
জামাল বললো, ভয় পেয়েছিস কামাল?
কামাল বললো, ভয় কেন পাবো? তুই মৃত ব্যাক্তি। মৃত ব্যক্তিকে ভয় পাওয়ার কি আছে!
জামাল বিকট শব্দে হাসছে। জামাল বললো, তুই আমার বন্ধু। তুই কখন ভয় পাস আর কখন আনন্দ পাস এসব আমার চেয়ে ভালো কেউ বুঝে না।
কামাল বললো, কেন এসেছিস আমার কাছে? আমি তোর কি ক্ষতি করেছি?
জামাল বললো, তুই আমার ক্ষতি করবি কেন? আমি এসেছি তোকে কিছু বলার জন্য।
কামাল বললো, আমি কিছু শুনতে চাই না। দয়া করে তুই চলে যা। আমি কালকেই ঢাকা চলে যাবো।
জামাল বললো, আমি বেঁচে থাকতে তুই আমার অনেক উপকার করেছিস। মৃত্যুর পর একটি উপকার কি করতে পারবি না?
জামালের কথা শুনে কামাল একটু ইমোশনাল হয়ে উঠেছে। বললো, তোর কি উপকার করতে পারবো আমি?
জামাল বললো, আমি কীভাবে মারা গেছি জানিস?
কামাল বললো, হ্যাঁ। তুই ফাঁসি খেয়ে আত্মহত্য করেছিস।
জামাল বললো, না। সবাই এটা জানে। কিন্তু এটা সত্য নয়। আমি আত্মহত্য করিনি। আমাকে খুন করা হয়েছে।
কামাল অবাক হয়ে গেলো। বললো কে খুন করেছে?
জামাল বললো, আমার বউ আর তার প্রেমিক সাদেক।
কামাল বললো, রহিম সাওদাগরের ছেলে সাদেক?
জামাল বললো, হ্যাঁ। ওরা আমাকে হাত পা বেঁধে গলায় ফাঁস দিয়ে তারপর ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে দিয়েছে। আমার ঘরের আশেপাশে কোনো মানুষ না থাকায় এটা কেউ দেখেওনি, জানেও না।
কামাল বললো, আমি কি উপকার করতে পারি তোর?
জামাল বললো, আজকে আমি তোকে সবকিছু বলতে পেরেছি। আমি এখন মুক্ত। আর কখনও তোর সামনে আসবো না। তুই আমার খুনের বিচারটা করবি। এটা বলে জামাল চলে যাচ্ছে।
কামালের ইচ্ছে করছে ডাক দিতে। জামাল… বলে জোরে চিৎকার দিতে। কিন্তু পারলো না। সে হঠাৎ অন্ধকারে মিশে গেলো। আর দেখলো না কামাল।
এই ঘটনার পর মাঝখানে দুই বছর কেটে গেলো। আজ দুই বছর পর কামালের মুখে হাসি। জামাল হত্যাকাণ্ডে তার স্ত্রী এবং সাদেকের ফাঁসির রায় হয়েছে। কামালের মন বলছে আজ সন্ধ্যায় জামাল আসবে। তাই সন্ধ্যার পর থেকেই পুকুর পাড়ে বসে ছিলো কামাল।