মাথাপিছু আয় শব্দটি মোট জনসংখ্যার সাথে সম্পর্কিত। নির্দিষ্ট সময়ের মোট উৎপাদনের পরিমাণকে আর্থিকভাবে প্রকাশ করা হলে এ সময়ের মোট আয় পাওয়া যায়। এখানে উৎপাদন বলতে পণ্য ও সেবার উৎপাদনকে বুঝানো হয়। আবার মোট জাতীয় আয়ের পরিমাণকে মোট জনসংখ্যা দ্বারা ভাগ করা হলে নির্দিষ্ট সময়ের একটি অর্থনীতির মাথাপিছু জাতীয় আয় পাওয়া যায়। প্রত্যেক দেশের প্রধান উদ্দেশ্য হলো মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা। এ কারণে প্রত্যেক দেশ নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য ও সেবার উৎপাদনকে বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করে। এর ফলে অর্থনীতি দুইভাবে লাভবান হয়। প্রথমতঃ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য শিল্প কারখানা স্থাপনের ফলে বস্তুগত পণ্যের উৎপাদন বাড়ে এবং একই সাথে কর্মসংস্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
আবার সেবা খাতে যদি প্রকল্প হাতে নেয়া হয় তবে সেবা খাতের উৎপাদন বাড়ে এবং সে ক্ষেত্রেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। শিল্পখাতের উৎপাদিত পণ্যকে যদি রপ্তানি করা যায় তবে সেইক্ষেত্রে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যায়। অবশ্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্য একটি পথও খোলা আছে। যেসব দেশে প্রচুর জনশক্তি রয়েছে এবং উদ্বৃত্ত জনশক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না, সেই সব জনশক্তি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা যায়।
এর ফলে মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মোট কথায় মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধির জন্য উৎপাদন ও আয়ের পরিমাণকে বৃদ্ধি করতে হবে। অবশ্য জাতীয় আয় বৃদ্ধির আরো একটি পথ খোলা আছে। যদি উৎপাদন বা সেবার ক্রমবর্ধমান গতিকে ঠিক রেখে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতাকে হ্রাস করা যায় তবে সে ক্ষেত্রেও মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়। আবার মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাওয়া ও দারিদ্র্য হ্রাস পাওয়া এক কথা নয়। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জাতীয় আয় যদি বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যা নিঃশেষ করে দেয় তবে সেক্ষেত্রেও জাতীয় আয় বৃদ্ধি পাবে না। তাছাড়া দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি যদি চলমান থাকে তবে সেইক্ষেত্রে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জাতীয় আয়ের সমবন্টন হয় না। এজন্য দারিদ্র্যের পরিমাণও হ্রাস পায় না।
অতএব বলা যায়, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে তখনই দারিদ্র্যের পরিমাণ হ্রাস পাবে, যদি জাতীয় আয়ের সমবন্টন হয়। বাংলাদেশের চলমান দুর্নীতিকে স্বীকার করে নেয়ার পরও এ দেশে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বাড়ছে এবং দারিদ্র্যের পরিমাণ অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। যদিও করোনা পরিস্থিতিতে এবং বিশ্ব অর্থনীতির মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের দারিদ্র্যের পরিমাণ হ্রাস পাওয়ার গতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতির পরও পাঁচটি সূচকের কারণে বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু আয় ক্রমাগত বাড়ছে। এ সূচকগুলো হয়- শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, বিদ্যুতায়নে প্রযুক্তির বিস্তার, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং বিনিয়োগ। এসব সূচক বাংলাদেশের মানুষদের আয় বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষায় গতি প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। ফলে এসব সূচকের কারণে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের মানুষ ও পরিবারের আয় বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সুযোগ-সুবিধা মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাড়িয়ে দেয়। এগুলো মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। জনগণের আয় বাড়িয়ে দেয়। যে সব দেশ এই প্রেরণার উৎসগুলো যত বেশি দিন ধরে রাখতে পারবে, তারা ততই বেশি লাভবান হবে। অর্থনীতিতে আকস্মিক আঘাত এলে উন্নয়নের গতি কমে যায়। যেমন- বর্তমান সময়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে আকস্মিক আঘাত আসার কারণে সমগ্র বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট চলছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের চেয়ে আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল প্রায় অর্ধেক। অথচ মাথাপিছু আয়ে সেই পাকিস্তানকে অনেক আগেই আমরা ছাড়িয়ে গেছি। এখন পাকিস্তানের চেয়ে আমাদের মাথাপিছু আয় ৩০ শতাংশ বেশি।
উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় প্রতিটি দেশের নিজস্ব সংস্কৃতির ভূমিকা আছে। সংস্কৃতি উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষায় প্রেরণা দেয়। বাংলাদেশে এমন কিছু নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষায় প্রেরণা দিয়েছে। যেমন- নারীর কর্মসংস্থান, নারী শিক্ষা, শিশুমৃত্যু হ্রাস- এসবই সমন্বিতভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। আবার উন্নয়নে বাধা দেয় খেলাপি ঋণ। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো অর্থাৎ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো জনগণের নিকট থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়গুলো সংগ্রহ করে আমানত রাখে। আবার সঞ্চয়কারীদের মুনাফা (সুদ) দিতে হয় বলে ব্যাংকগুলো আমানতের একটি অংশ বিনিয়োগকারীদেরকে ঋণ হিসেবে প্রদান করে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগকারীরা গ্রহণকৃত এসব ঋণগুলোকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। গৃহণকৃত ঋণের একটি অংশ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলেও বৃহৎ একটি অংশ বিদেশে পাচার করে দেয়। সেখানে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে বিদেশে পাঁড়ি দেয়। হয়ে যায় ঋণখেলাপী। এ রকম সুযোগ সন্ধানী বিনিয়োগকারী বা ঋণ গ্রহীতার পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও কোন কোন ব্যাংক নীতিমালার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ছদ্মবেশি বিনিয়োগকারীদের ক্রমাগত ঋণ দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ সালে সরকার ঘোষণা করেছিল যে, খেলাপি ঋণ আর বাড়বে না। এর পূর্বে অর্থাৎ ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা। শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বিডিবিএল ও বেসিক-এ ছয় ব্যাংকের, ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। পরবর্তীতে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ৯ শতাংশ সরল সুদে ১০ বছর মেয়াদে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিলে ২০২০ সালে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমে এসে তা দাঁড়ায় ৪৩ হাজার ২৫৫ কোটি টাকায়। তবে ২০২১ সালে তা আবার বেড়ে হয় ৫০ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। ২০২২ সালের জুনে তা আরো বেড়ে হয় ৫৫ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা।
২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রমালিকানাধীন ছয় ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ খেলাপি হয়েছে জনতা ব্যাংকে। এ ব্যাংকের মোট ঋণের ২৫ শতাংশই খেলাপি, যার পরিমাণ ১৭ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। আর সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হয় ১২ হাজার ১২৬ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ১৮ শতাংশ। অগ্রণী ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ ১০ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা যার ১৭ শতাংশই খেলাপি। রূপালী ব্যাংকে ঋণের পরিমাণ হয় ৬ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা যার ১৭ শতাংশই খেলাপি। বিডিবিএল এর ঋণের পরিমাণ হয় ৭৬৮ কোটি টাকা যার ৩৬ শতাংশই হয় খেলাপি। মোট ঋণের মধ্যে খেলাপির হার সবচেয়ে বেশি বেসিক ব্যাংকে।
মোট খেলাপি ঋণের ৬ থেকে ৭ শতাংশ অর্থ আদায় করতে বিডিবিএল ছাড়া পাঁচ ব্যাংকের সঙ্গেই সমঝোতা স্মারক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ জনতা ব্যাংকের হলেও খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে সবচেয়ে পিছিয়ে এ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে করা ব্যাংকটির সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ২০২২ সালে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায় করতে হবে ১ হাজার ২৪০ কোটি টাকা। অথচ ছয় মাসে ব্যাংকটি আদায় করতে পেরেছে মাত্র ৮ শতাংশ বা ১০৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে সমঝোতা স্মারক অনুসারে, সোনালী ব্যাংক ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ১৬৫ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ১ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২৪৮ কোটি, রূপালী ব্যাংক ৬৭০ কোটি টাকার মধ্যে ১১৭ কোটি, বেসিক ব্যাংক ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে ১৪৬ কোটি এবং বিডিবিএল ৯৮ কোটি টাকার মধ্যে ১৬ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সাথে সাথে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরপক্ষে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের পরিমাণও আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি খেলাপি ঋণের টাকা প্রকৃতপক্ষে এ দেশের অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহৃত হতো তবে মাথাপিছু জাতীয় আয়ের পরিমাণ আরো অধিক হতো। এখন খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনাই বাংলাদেশ ব্যাংকের বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক : কলামিস্ট; পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি।