শারীরিক, শ্রবণ, বাক্, বুদ্ধি ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের একটি অংশ জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী। অপর অংশ দুর্ঘটনার কারণে মানসিকভাবে প্রতিবন্ধিত্বের শিকার হয়। গর্ভাবস্থায় মায়ের দৈহিক কোনো ঘাটতি, পুষ্টিহীনতা বা অসুস্থতা, জন্মের পর বেড়ে ওঠার সময় অপুষ্টি, রোগাক্রান্ত হওয়া, সড়ক দুর্ঘটনা প্রভৃতিসহ পিতামাতার অমনোযোগ, অযত্ন ও অবহেলার কারণে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, যে সকল শিশুর দৈহিক, মানসিক ত্রুটির কারণে নির্দিষ্ট মাত্রায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অক্ষম, তাদের প্রতিবন্ধী বলে। অর্থাৎ যেসকল শিশুদের দৈহিক বা মানসিক দিক থেকে স্বাভাবিক বা গড় শিশুদের বিচারে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, তাদের বলে প্রতিবন্ধী।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সমাজে প্রতিবন্ধী মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, স্বাভাবিক ও সম্মানজনক জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের মানবিক মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে মানুষকে কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্বসচেতন হওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। একজন প্রতিবন্ধী সমাজে সুস্থ–সুন্দরভাবে বিকশিত হয়, যদি দেশের অবকাঠামো ভালো হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫, ১৭, ২০ এবং ২৯ অনুচ্ছেদে অন্যান্য নাগরিকদের সাথে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমসুযোগ ও অধিকার প্রদান করা হয়েছে। তাই প্রতিবন্ধীদের সকল ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
প্রতিবন্ধীরা শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থসামাজিক অক্ষমতা বা অসুবিধার কারণে স্বাভাবিক ও স্বাবলম্বী জীবনযাপন করতে পারে না। প্রতিবন্ধীদের সীমাহীন দুঃখ–দুর্দশা উপলব্ধি করতে পারেন সেসব সংবেদনশীল মানুষ, যাঁরা অন্যের দুঃখ–বেদনাকে সহমর্মিতার দৃষ্টিতে দেখেন। এ জন্য প্রতিবন্ধীদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা, দয়া–মায়া, সেবা–যত্ন, সুযোগ–সুবিধা ও সাহায্য–সহৃদয়তার হাত সমপ্রসারিত করা সবার অবশ্য কর্তব্য। মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম মৌলিক অধিকারগুলো তাদেরও ন্যায্যপ্রাপ্য। তাই প্রতিবন্ধীদের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা প্রদর্শন ও সহানুভূতিশীল হওয়া অত্যাবশ্যক।
একজন মানুষ হিসেবে প্রতিবন্ধীদের নিশ্চয়ই স্বাভাবিক চলাফেরা করার অধিকার আছে এবং সবারই প্রতিবন্ধীদের অধিকারের প্রতি বিশেষভাবে নজর দেওয়ার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের বৈষম্য ও দুঃখ–কষ্টের সীমা থাকে না। তাই প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা, পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান ও বিনোদন লাভের পূর্ণ অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয়, তাদের মধ্যে রয়েছে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন অনন্য প্রতিভা। শারীরিক বা যেকোনো প্রতিবন্ধিতা অক্ষমতা নয়, বরং ভিন্ন ধরনের সক্ষমতা। সুযোগ পেলে প্রতিবন্ধীরাও দক্ষতা ও পারদর্শিতার মাধ্যমে অনেক কিছু করতে পারে। প্রতিবন্ধীদের মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারলে এরা মানবসম্পদে পরিণত হবে। সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমে দক্ষতা গড়ে তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা যায়। সমাজের সব থেকে প্রান্তিক অংশ অসহায় প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষা হচ্ছে কি না, তা সবারই দেখা উচিত। মানবাধিকার, উপযুক্ত পরিচর্যা, অনুকূল পরিবেশ, আর্থিক সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমবেদনা পেলে তারা দেশ ও জাতি গঠনে যোগ্য অংশীদার হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন উন্নয়নে প্রতিবন্ধীদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধিত্ব ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সম্পর্কে সমাজে এখনও কিছু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। প্রতিবন্ধীরা তাদের মেধা ও যোগ্যতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের শিক্ষার হার বাড়লেও বেকারত্ব সেই অর্থে কমছে না। অনেক পরিবারে তাদের বোঝা হিসেবে দেখা হয়। প্রতিবন্ধী শিশুরা বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে খুব দক্ষ হয়ে থাকে। তাই তাদের প্রতিবন্ধী হিসেবে চিহ্নিত না করেও বিশেষ শিশু’ হিসেবে দেখা উচিত।
প্রতিবন্ধীরা দেশের সম্পদ, তাদের করুণা নয় ভালোবাসতে হবে। প্রতিবন্ধীদের সবচেয়ে বেশি সুবিধা দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। চাকরিতে কোটা সংরক্ষিত রয়েছে। তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। আইসিটি বিভাগ ৩ হাজার প্রতিবন্ধীর প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করেছেন। বিবেক প্রতিবন্ধীদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে।
মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক প্রতিবন্ধীই এই সমাজের অন্তর্ভুক্ত। তারা অন্য কোনো গ্রহের অন্য কোনো জীব নয়– একথা সবার প্রথমে আমাদের মাথায় রাখতে হবে। অনেক প্রতিবন্ধী আছে যারা মানসিকভাবে দুর্বল হলেও শারীরিক দিক থেকে বেশি সক্ষম। তাদের সেই সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের বেঁচে থাকার আশ্বাস যোগাতে হবে। তাদের পাশে থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রতিটি মানুষের একান্ত কর্তব্য।