আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ২০২২ : সকল প্রতিবন্ধিকতা চোখে দেখা যায় না

ডা. মাহমুদ এ. চৌধুরী আরজু | শুক্রবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ

আগামীকাল ৩রা ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ৪৭/৩ এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক এই দিবসটি পালিত হয়। এ দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছেপ্রতিবন্ধীর বিষয়ে সবাইকে অনুধাবণ করতে হবে এবং তা হবে মর্যাদার সাথে। এদের অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। কোন ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়ন করা যাবে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবছর ৩রা ডিসেম্বর নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের সকল সদস্য এবং দেশের সকল সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এই দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান করে থাকে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন২০১৩’ তে সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে কোনও কারণে ঘটিত দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ীভাবে কোনও ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত বা ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা বা প্রতিকূলতা এবং উক্ত ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত ও পরিবেশগত বাধার পারস্পরিক প্রভাব, যাহার কারণে উক্ত ব্যক্তি সমতার ভিত্তিতে সমাজে পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই সংজ্ঞা প্রতিবন্ধী শিশুর বেলায়ও প্রযোজ্য। প্রতিবন্ধীর ধরন: শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্থতা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতায় হতে পারে। মানসিক আঘাতও প্রতিবন্ধিকতার বড় কারণ। বাংলাদেশ সরকার চারটি নিউরোডেপলাপমেন্টাল ডিসঅর্ডারকে প্রতিবন্ধিকতার হিসাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। এগুলো হচ্ছে অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রম ও মেন্টাল ডিসঅর্ডার। এজন্য সরকার নানা কর্মসূচীও গ্রহণ করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা ও অটিজম সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারপার্সন সাইমা ওয়াজেদ হোসেনের নেতৃত্বে এ ব্যাপারে দেশে ব্যাপক কাজ হচ্ছে এবং অচিরে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

করোনা পরিস্থিতিতে এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয়– ‘অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য রূপান্তরমূলক সমাধান: একটি সহজগম্য এবং ন্যায়সঙ্গত বিশ্বের জ্বালানিতে উদ্বাবনের ভূমিকা’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের জনসংখ্যার ১৫% শতাংশ লোক অর্থাৎ ১ বিলিয়ন লোক কোনও না কোনোভাবে প্রতিবন্ধীতা নিয়ে বসবাস করছে। এর মধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন লোক মানষিক বা স্নায়ু রোগে ভুগছে এবং এদের দুইতৃতীয়াংশ লোক তাদের এ সমস্যার জন্য ডাক্তার বা স্বাস্থ্য কর্মীর কাছে আসে না। কারণ এতে সামাজিক বা লোকের কাছে হেয় হবার সম্ভবনা আছে বলে মনে করে। তাছাড়া প্রতিবন্ধী লোকেরা নানা কুসংস্কার বা বঞ্চনার স্বীকারও হয়ে থাকে। এ সমস্ত প্রতিবন্ধী লোকেরা বেশির ক্ষেত্রে চিকিৎসার পরিবর্তে অপচিকিৎসা করে থাকে। যা তার সমস্যাকে আরো ভয়াবহ বা মারাত্নক করে ফেলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৬৬ মিলিয়ন লোক মস্তিস্কের আঘাত জনিত কারণে নানা ধরনের পঙ্গুত্ব বরণ করছে। প্রতি ১৬ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু অটিজম আক্রান্ত। কিছু কিছু প্রতিবন্ধীকতা আছে যা স্বাভাবিকভাবে চোখে পড়ে না। কেউ বা কিছু অনুমান করতে পারে না যে তার মধ্যে কোন কোন ভাবে স্বীমাবদ্ধতা আছে। এর মধ্যে সাধারণত আচরণগত সমস্যা অন্যতম। যেমন কিছু শিশু অতিমাত্রায় চঞ্চল, কথা বলার সমস্যা, লেখার সমস্যা। এগুলোর কারণ সাধারণত নির্ণয় করা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যার জন্য জীন গঠিত সমস্যাকে দায়ী করা হয়। অনেক সময় মস্তিস্কের জন্মগত ক্রটির কারণে শিশুর শারিরীক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে সিটিস্ক্যান ও এমআরআই আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করেছে। অনেক শিশু ডাউন সিনড্রম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অধিক বয়সে কোনও নারী সন্তান জন্ম দিলে কিছু চেহারাগত, দৈহিকগত বা অঙ্গের সমস্যা নিয়ে শিশুটি জন্মগ্রহণ করে। এখানেও জীন সমস্যাকে দায়ী করা হয়।

কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে যেমনমানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি, দুর্বলতা এমনকি দীর্ঘ মেয়াদী ব্যথা একজন মানুষকে প্রতিবন্ধকতার মাঝে ফেলতে পারে। উদাহরণ স্বরূপএডিএইচডি -(অতি চঞ্চলতা), ডিসপ্র্যাক্সিয়া – (হাঁটা বা চলার ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যতা), ডিসলেক্সিয়া– (পড়ার অসুবিধা), ডিসক্যালকুলিয়া– (গণিতে অক্ষমতা), ডিসগ্রাফিয়া– (লেখার ক্ষেত্রে সমস্যা) ট্যুরেটের সিনড্রোম– ( হাত বা পা অস্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করে, মাঝে মাঝে মাথা নাড়ানো, অপ্রয়োজনে গলা পরিষ্কার করা)

এ সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে ‘নিউরোডাইভার্সিটি’ বলা হয়। যা শিশুর বিকাশে বিশেষ করে বুদ্ধি বিকাশের অন্তরায় হয়। তবে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছে যারা নিজ গুণে বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করেছে। এমনকি অলিম্পিক পদ প্রাপ্ত হয়েছে। আমাদের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা শিশু বান্ধব করা উচিত। এমনকি অভ্যর্থনা ডেস্কে কর্মরত ব্যক্তি একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা শিশু আসলে তাকে দেখে বুঝতে হবে যে এই ব্যক্তি বা শিশুর কোনও না কোনও প্রতিবন্ধকতা আছে তাকে সম্মানের সাথে তার কার্যাদি করার সুযোগ করে দিতে হবে। চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালে অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কার্যক্রম চালু আছে। আপনারা পূর্বের ন্যায় চিকিৎসা বা থেরাপিস্টদের সাহায্য নিতে পারেন। প্রয়োজনে টেলিফোনে যোগাযোগ করেও আপনার শিশুর সমস্যার সমাধান করতে পারেন। পরিশেষে, আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে প্রতিবন্ধী সকল শিশুর জন্য বাসযোগ্য একটি পৃথিবী হোক। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রফেসর, পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধশীতকাল এবং বিয়ে উৎসব
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা