বহু জাতি-সমপ্রদায়ের ভারতবর্ষ ভাগ হয়েছিল ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের খড়গে। ভারতভাগের ভিত্তি-মূলে ছিল হিন্দু-মুসলিম দুই প্রধান সমপ্রদায়ের মধ্যকার সম্পর্ককে দ্বন্দ্বে পরিণত করার হীন রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বনে। দুই সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনায় শঠতার ধূলি দিয়ে। সমপ্রদায়কে চিহ্নিত করা হয়েছিল জাতিতে। জাতি আর সমপ্রদায় এক নয়। একই সমপ্রদায়ে বহু জাতির অবস্থান থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। অপর দিকে একই জাতিসত্তার মানুষের মধ্যে হরেক সমপ্রদায়ের মানুষ আছে-থাকবে, সেটাও অসত্য নয়। ভারত ভাগে জাতি নয়, দুই প্রধান সমপ্রদায়ের বিভক্তিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারায় এবং ব্রিটিশদের ইচ্ছাপূরণে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমপ্রদায়ের নিরঙ্কুশ ভোটে নিশ্চিত হয়ে যায় ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলার সম্পৃক্তির বিষয়টি। প্রায় দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে পৃথক ভূখণ্ড দুটি একই রাষ্ট্রের বৃত্তে এবং স্থায়ীভাবে অটুট থাকবে তেমনটি যেমন বিজ্ঞ রাজনীতিক হতে সর্বশেষ পূর্ব বাংলার প্রধান ব্রিটিশ কর্মকর্তাটিও বিশ্বাস করেননি। তেমনি আস্থা রাখতে পারেননি পাকিস্তান স্রষ্টা জিন্নাহ্ও। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পূর্ব-পশ্চিম দুই ভূখণ্ডকে কেবলমাত্র ধর্মীয় ঐক্যে স্থায়ীভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখা যাবে না। সাংস্কৃতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ রাখতেই জিন্নাহ উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিলেন।
ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জনের সহায়তায় ১৯০৬ সালে ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত হয় মুসলিম লীগ। অথচ মুসলিম লীগের একটি কেন্দ্রীয় সম্মেলনও অবিভক্ত বঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়নি। একমাত্র ধর্মীয় ঐক্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একই রাষ্ট্রের বৃত্তে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরের বছর ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ্ ঢাকায় এসে রেসকোর্স এবং কার্জন হলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দু এবং উর্দুই। অর্থাৎ উর্দু ভাষা বা সংস্কৃতির বলয়ে বাঙালি জাতিসত্তাকে বিলীন করা সম্ভব হলেই দুই অংশের অখণ্ড ঐক্য স্থায়ীকরণ সম্ভব হবে। বাঙালিকে উর্দু ভাষা-সংস্কৃতির বৃত্তে আবদ্ধ করা সম্ভব হলেই দুই হাজার মাইলের দূরত্বের বিচ্ছিন্নতার স্থায়ী অবসান ঘটবে। বাস্তবে সেটি হয়নি। একমাত্র ধর্মীয় বিভাজনে ভারতভাগে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম নিয়ে যাঁরা আগাম বার্তা দিয়েছিলেন, এবং সেটা পাকিস্তান সৃষ্টির বহু আগে। ১৯৪২ সালে জিন্নাহ্র উপলব্ধিরও পূর্বে কলকাতা এবং ঢাকায় পৃথক দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। ঢাকায় গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ।’ সভাপতি ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন। সম্পাদক তারই জ্ঞাতি ভাই সৈয়দ আলী আহসান। একই সময়ে কলকাতায় গড়ে ওঠে ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি।’ যার নেতৃত্বে ছিলেন মুজীবুর রহমান খাঁ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ হবিবুল্লাহ বাহার, আবুল মনসুর আহমদ, জহুর হোসেন চৌধুরী প্রমুখ বিশিষ্টজন। তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির মূলে ছিল বাঙালি মুসলমানদের বিভাজিত সাহিত্য-সংস্কৃতি চেতনা সৃষ্টি। যেটি বাঙালি নয়, বাঙালি মুসলমানদের বিভাজ্য সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রথম সংস্কৃতির বলয় নির্মাণের অপকৌশল। সম্পাদক সৈয়দ আলী আহসানের দৃষ্টিতে মোশাররফ হোসেন, মোজাম্মেল হক, রেয়াজউদ্দীন, কায়কোবাদ প্রমুখ সাহিত্যিকদের সাহিত্যে, ‘পূর্ণভাবে মুসলমান জাতির সংস্কৃতির ছবি ফুটে ওঠে না।’ সভাপতি ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের বক্তব্যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের বাহন বাংলা হবে এ প্রশ্ন বহু পূর্বেই চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হয়ে গেছে।…ভারতের সর্বজনীন ভাষা হিসেবে উর্দুর দাবি অগ্রাহ্য করা নিষপ্রয়োজন এবং সেই কারণে উর্দু শিক্ষার প্রসারও আমরা বাঞ্ছনীয় মনে করি।…পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মুসলমানের কাছে উর্দু বিদেশি ভাষার সমতুল্য। বাঙালি মুসলমানের ভাষা বাংলা, উর্দু নয়।’ কিন্তু তারা বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের যুগের বাংলা সাহিত্যকে মোটেও বাঙালি মুসলমানের সাহিত্য হিসেবে গণ্য করতেন না। এক্ষেত্রে ১৯২৫ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে লেখা প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ’র একটি চিঠি স্মরণীয়। ওই চিঠিতে ইব্রাহীম খাঁ নজরুলকে মুসলমানদের জন্য মুসলিম সাহিত্য রচনার অনুরোধ ও তাগিদ দিয়েছিলেন। কলকাতায় রেনেসাঁ সোসাইটির সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে প্রখ্যাত সাহিত্যিক, দৈনিক ইত্তেহাদ সম্পাদক আবুল মনসুর আহমদ স্পষ্টই বলেছিলেন, “পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি তা বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুবই উন্নত সাহিত্য। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্ব-সাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গিয়েছেন। তবুও এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্যে মুসলমানদের কোনো দান নেই। শুধু তাই নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ-সাহিত্যের কোনো দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ প্রাণ-প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে, এ সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়, এর স্পিরিটও মুসলমানি নয়, এর ভাষাও মুসলিমের ভাষা নয়। প্রথমত, এ সাহিত্যের স্পিরিটের কথাই ধরা যাক। এ সাহিত্য হিন্দু মনীষীর সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু-সংস্কৃতিকে বুনিয়াদ করে তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ঠিকই তাঁরা করেছেন। নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না-কিন্তু সত্য কথা এই যে, ঐ সাহিত্যকে মুসলমানেরা জাতীয় সাহিত্য মনে করে না।” এতে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বহুপূর্বেই ভাষা ও সাহিত্যের প্রশ্নে বাঙালি কতিপয় বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি পন্থার পক্ষে সাংস্কৃতিকভাবে সামপ্রদায়িক অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তখন থেকেই ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার শুরু হয়েছিল। এবং সেটা কতিপয় বাঙালি বুদ্ধিজীবীর তৎপরতায়। তাঁদের চিন্তাভাবনা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, আবহমানকালের অবিভাজ্য বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস সৃষ্টি তাঁদের ছিল না, তেমনি বাঙালি মুসলমানদের পৃথক সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে তাঁরা বিশ্বাস করতেন।
১৯৪৭ সালের ১৭ জুলাই হায়দারাবাদে মুসলিম লীগ রাজনীতিক চৌধুরী খালিকুজ্জামান এবং জুলাই মাসে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় পৃথক দুটি সমাবেশে জিন্নাহ্র ঘোষণার পূর্বেই উর্দুর পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন প্রভাবশালী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ। বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা বলে তা মুসলমানদের জগৎ পরিত্যজ্য এমন বক্তব্যও প্রকাশ্যে তাঁরা দিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেকে। ড. জিয়াউদ্দীনের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পক্ষে যাঁরা দৃঢ়তর অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের পথিকৃৎ প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক আবদুল হক। ১৯৪৭ সালের জুন থেকে আগস্ট মাসে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বেনামে ‘বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’, ‘উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে’, ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুল রহমান ১৯৪৯ সালে আরবি বর্ণমালায় বাংলা লেখার পক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে আবদুল হক ‘আরবি হরফে বাংলা’ নামক তীর্যক প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যেটি ২০ মার্চ ১৯৪৯ সালে দৈনিক ইত্তেহাদে প্রকাশিত হয়েছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বেই বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রচারণায় নেমেছিল পাকিস্তানপন্থি কতিপয় বুদ্ধিজীবী। তার সুফল যে তাঁরা অর্জন করতে পারেননি, সেটিও অসত্য নয়। বাঙালি মুসলমান তাঁর জাতীয়তাকে পরিত্যাগ করে সামপ্রদায়িক পরিচয়কে প্রধান করে তুলেছিল বলেই পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের একাংশে পরিণত হতে পেরেছিল। কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি মধ্যবিত্তদের বাংলাভাগের কাতারে তারা সামিল হয়েছিল। তবে বাংলাভাগে হিন্দু মহাসভা প্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নাম ইতিহাসে মীরজাফরের নামের পাশেই স্থান লাভ করে আছে। বাংলা ও বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির ক্রমাগত চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি পুনরায় জাতিসত্তার চেতনা ফিরে পায়; ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। লেখক, দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বদরুদ্দীন উমর যথার্থই বলেছিলেন, বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ‘বাঙালি মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন।’ কংগ্রেস রাজনীতিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদও ১৯৪৬ সালে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান না পাওয়া পর্যন্ত কোনো যুক্তি মুসলমানের কানে ঢুকবে না।’ তাঁর কথাটি সত্যে প্রমাণিত হতেও বেশি সময় লাগেনি। ১৯৪৬ সালের এপ্রিলে মাওলানা আজাদ সাংবাদিক সোরুস কাশ্মিরীকে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “কিন্তু এ দাবির (পাকিস্তান দাবি) আমি অন্তনির্হিত বিপদ দেখতে পাচ্ছি।…আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মি. জিন্নাহ্র দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে বঙ্গদেশ। তিনি জানেন না বঙ্গদেশ বাইরের কোনো নেতৃত্ব মেনে নেয় না। আজ কিংবা কাল তারা সে নেতৃত্ব অস্বীকার করবে। আমি মনে করি, পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বহু দিন একসঙ্গে থাকা মোটেই সম্ভব নয়। এই দুই ভূখণ্ডে ধর্ম ছাড়া আর কোনো বাঁধন নেই। আমরা মুসলমান-এই মর্মে কোথাও স্থায়ী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠে নি।” মাওলানা আজাদের কথা সেদিন দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষাক্ত হাওয়ায় কেউ কানে তোলেনি। মাওলানা আজাদের ন্যায় অনেকেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। আবদুল গাফফার খাঁ, হুমায়ুন কবীরসহ আরো অনেকে বলেছিলেন, দেশভাগ মুসলমানদের জন্য এক মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে। বারংবার সাবধানতার উচ্চারণও করেছিলেন। জিন্নাহ্ এঁদের ‘হিন্দুদের দালাল’ বলে গালাগাল দিয়েছেন। কিন্তু মাত্র ২৩ বছরের মধ্যেই তাদের ভবিষ্যদ্বাণী এবং জিন্নাহ্র দ্বিজাতিতত্ত্ব মিথ্যা-ভ্রান্ত বলেই প্রমাণিত হয়েছে। পাকিস্তান ভেঙে পৃথক রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ধর্মীয় ঐক্যের মাশুল আমরা পাকিস্তানি শাসনামল জুড়ে দিয়েছি। ভয়াবহ রূপে দিয়েছি একাত্তরে।
ধর্মীয় বন্ধনে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৃত্তে একাকার করা যে অসম্ভব। সেটা বাঙালি পাকিস্তানপন্থি বুদ্ধিজীবীরা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ধর্ম পরিবর্তন সহজ। যেটি মানুষের পক্ষে পরিবর্তন করা তাৎক্ষণিক ব্যাপার মাত্র। কিন্তু জাতীয়তা পরিবর্তন কেবল অসহজই নয়, অসম্ভবও। তাই জাতীয়তার ভিত্তি অধিক শক্তিশালী এবং স্থায়ীও বটে। বিজাতীয় সংস্কৃতির বলয়ে একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতিবান জাতির সংস্কৃতিকে সহজে পরাভূত করা যায় না। ধর্ম পরিবর্তন করা যায় সহজে, কিন্তু সংস্কৃতির বিনাশ ঘটানো যায় না। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বাংলা-বাঙালিকে যথার্থই চিনতে ও বুঝতে পেরেছিলেন বলেই দার্শনিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মন্তব্যটি করেছিলেন-‘বঙ্গদেশ বাইরের নেতৃত্ব মেনে নেয় না। ক্রমেই বহিরাগত নেতৃত্ব অস্বীকার করবে।’ বাঙালি জাতি নিজেদের জাতীয়তা রক্ষায় সর্বোচ্চ ত্যাগের ইতিহাস গড়েছে। যেটি বিশ্বে বিরল ঘটনা রূপেই প্রতীয়মান। বাঙালির শ্রেষ্ঠত্ব-বীরত্ব ইতিহাসের নানা ক্ষেত্রে প্রমাণিত। ধর্মের বাতাবরণে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা-অহংকার নির্মূল করা যায়নি এবং যাবে না। কেননা জাতীয়তাই আত্মপরিচয়ের একমাত্র মাপকাঠি।
লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক; নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত