আমাদের এখানে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সবাইকে নিদেনপক্ষে মাস্টার্স করতে হবে। নাহলে মান থাকে না। অমুক পারলে তমুক কেন পারবে না। সবাই উচ্চশিক্ষিত হবার প্রতিযোগিতায় মত্ত। কিন্তু সে উচ্চশিক্ষার মান অনুযায়ী দেশে উচ্চমানের কর্মসংস্থান আছে কিনা বা তৈরি হচ্ছে কিনা সেটি পরের ব্যাপার। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে সরকারি-বেসরকারি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিবিএ, এমবিএ, অনার্স, মাস্টার্স এর ছড়াছড়ি। মান নিয়ে কোন মাথাব্যথা নাই। অন্যদিকে কাজের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আমাদের সমাজে ব্যাপক শ্রেণিবৈষম্য রয়েছে। ওটা ছোটলোকের কাজ, ওটা নিচুজাতের কাজ। এটা করা যাবে না। ওটা করা যাবে না। এত বড় পাস দিয়ে এ কাজ কীভাবে করব। এমএ পাস করে কেরানি কীভাবে হব? ব্যবসাকে আমরা বলি দোকানদারি! বিবিএ এমবিএ করে সহকারী হব কীভাবে। সমাজ কী বলবে, লোকজন কী ভাববে! তাই আমাদের হিসাবটাও মিলে না। সরকারি চাকরিতে কয়েক লক্ষ পদ খালি। আবার লক্ষ লক্ষ ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত বেকার।
বিবিএসের জরিপ তথ্য অনুযায়ী, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রতি তিনজনের দুজনই কমপক্ষে মাধ্যমিক ডিগ্রিধারী। শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা করলে দেখা যায়, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬ লাখ ৬৫ হাজার নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা কমপক্ষে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও পছন্দমতো কাজ পাচ্ছেন না। আর মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাস এমন নারী-পুরুষের সংখ্যা সাড়ে ৩৭ লাখ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৬৬ লাখ মানুষকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। অথচ তাঁরা স্থায়ী চাকরি বা কাজের জন্য উপযোগী। কিন্তু নিজেদের পছন্দমতো কাজ পাচ্ছেন না কিংবা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে কাজ করতে পারছেন না। তবে ভালো কাজ পেলে করবেন। তাই পরোক্ষভাবে তাঁদের বেকার বলা চলে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কেউ এখন পুরোপুরি বেকার, কেউবা টিউশনি কিংবা খণ্ডকালীন কাজ করেন। আবার অনেক শিক্ষিত নারী-পুরুষ আছেন, যাঁরা কাজের উপযোগী হলেও কোনো কাজ করেন না। তাঁদের মধ্যে শিক্ষিত গৃহিণীই বেশি। সংসারের নানা চাপে কিংবা অন্য কোনো কারণে তাঁরা হয়তো আপাতত কাজ করছেন না।
অর্থনীতির ভাষায়, এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে কর্ম-উপযোগী সম্ভাবনাময় শ্রমশক্তি বলা হয়। এই জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থনীতিতে উপযুক্ত কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। ফলে সম্ভাবনাময় জনশক্তির অপচয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে, কর্মক্ষম বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে বেকার, খণ্ডকালীন কর্মজীবী এবং সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী-এ তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার কম কাজ করেন, এমন ব্যক্তিদের খণ্ডকালীন কর্মজীবী হিসেবে ধরা হয়েছে। জরিপ অনুযায়ী, খণ্ডকালীন কাজ করেন ১৪ লাখ ৬৫ হাজার জন। মূলত টিউশনি, খণ্ডকালীন বিক্রয় প্রতিনিধি, ফাস্ট ফুডের দোকানের বিক্রয়কর্মী, কল সেন্টারের কর্মী হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কাজ করেন তাঁরা। পছন্দের কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে তাঁরা এসব খণ্ডকালীন কাজের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন। তাই নিজেদের এ কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন তাঁরা। অন্যদিকে কোনো ধরনের কাজ খুঁজেও না পেয়ে পুরোপুরি বেকার রয়েছেন এমন নারী-পুরুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। তাঁরা সপ্তাহে এক ঘণ্টা কাজ করারও সুযোগ পাননি। এ বেকার শ্রেণিতে নারী ও পুরুষ প্রায় সমান সমান।
বাংলাদেশ ক্রমশ উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের দিকে হাঁটছে। তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। এটি উন্নয়নের প্রাথমিক ভিত্তি। এর অংশ হিসেবে প্রচুর কল-কারখানা হবে, অবকাঠামো হবে, সুরম্য মার্কেট, শপিং মল হবে, হোটেল-মোটেল হাসপাতাল-বিনোদনকেন্দ্র হবে। প্রচুর কায়িক শ্রমনির্ভর বা ক্লারিক্যাল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। কিন্তু আমাদের কর্মের শ্রেণি-বিভাজিত দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার লোকজন এসব মানের কাজ করতে আগ্রহী নয়। তারা চায় এক্সিকিউটিভ ধরনের চাকরি। সেটি হয়তো পাওয়া যাবে, তবে দেশ উন্নত রাষ্ট্রের মহাসড়কে উঠে গেলে তখন। এখন চলবে কনস্ট্রাকশন, তখন লাগবে মেইনটেন্যান্স।
আসলে আমাদের দেশে কাজের চাহিদা আছে, কিন্তু স্ব স্ব ক্ষেত্রে দক্ষ লোক নেই। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে এক ধরনের ফারাক আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যেসব কাজের চাহিদা আছে, সেসব ক্ষেত্রে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে।