আলীনা ইসলাম আয়াত। বয়স মাত্র চার বছর ১১ মাস। ১৯ বছর বয়সী আবির আলী নামে এক তরুণের বীভৎসতার শিকার হয়ে তাকে অকালেই জীবন দিতে হয়। নগরীর ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডের নয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানা ও সাহিদা আক্তার তামান্না দম্পতির মেয়ে আয়াত। আবির আলী সোহেল রানার মালিকানাধীন তিন তলা ভবনের নিচতলার ভাড়াটিয়া আজহারুল ইসলামের ছেলে। আবিরের জন্ম বেড়ে ওঠা সবই ওই বাসায়। একইভাবে আয়াতের মা-বাবার বিয়ে থেকে শুরু করে আয়াতের জন্ম, ধীরে ধীরে বড় হওয়া-সবকিছুই আবিরের চোখের সামনে ঘটেছে। সেই সুবাদে উভয় পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। আয়াত তাকে ‘চাচ্চু’ বলে সম্বোধন করত। কে জানত সেই চাচ্চুর হাতেই খণ্ড খণ্ড হতে হবে আয়াতকে? সিসিটিভি ফুটেজ দেখে গত বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আবিরকে শনাক্ত করে। গ্রেপ্তার করার আগে পর্যন্ত আয়াতের পরিবার ভুল করেও সন্দেহ করেনি আবিরকে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় আবির ছিল শান্ত, স্থির যাতে কেউ সন্দেহ না করে। তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা ছিল না। তার দেওয়া স্বীকারোক্তিতে শিউরে ওঠেন ১৫ নভেম্বর থেকে আয়াতের নিখোঁজ এবং হত্যার রহস্য উদঘাটনে কাজ করা পিবিআই টিমের সদস্যরাও।
ক্রাইম সিরিয়ালে আসক্ত আবির : আবির জানায়, কৈশোরকাল থেকেই টেলিভিশনে তার পছন্দের সিরিয়াল ছিল ‘ক্রাইম পেট্রল’ ও ‘সিআইডি’। একেকটি কাহিনী সে দেখতো আর নিজের মতো করে ভাবতো। অপহরণটা কিংবা খুনটা কীভাবে হলো, কীভাবে অপরাধীরা পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপনে ছিল, পুলিশ কীভাবে আসামির খোঁজ পায়-ইত্যাদি নানা বিষয় তার কিশোর মাথায় ঘুরপাক করতো সবসময়। কখনো সে নিজেকেই ভাবতো সিরিয়ালের অপরাধী, কখনো ভাবতো তদন্ত কর্মকর্তা। একসময় তার ইচ্ছে হলো বাস্তবে তা প্রয়োগ করার। নিজেকে অপহরণকারীর চরিত্রে বসিয়ে পরিকল্পনা করলো, শিশু আয়াতের চাইতে সহজ টার্গেটতো আর হতে পারে না। দুটো পরিবারের সুসম্পর্কের কারণে সন্দেহের তীর তার দিকে তাক করা হবে না, পাশাপাশি আয়াতের বাবার থেকে মুক্তিপণও আদায় করা যাবে। ১৫ নভেম্বর নিজের দক্ষতা প্রমাণের দিন ধার্য করলো আবির, যেদিন দেখলো আয়াত মাদরাসার মাঠে সাথীদের সাথে খেলছিল।
আবিরের কোলে ওঠাই কাল হলো : আয়াত স্থানীয় তালীমূল কোরআন নূরানী মাদরাসার হেফজখানার ছাত্রী ছিল। ১৫ নভেম্বর বিকেলে আছরের নামাজের পর সে আরবি পড়তে যায়। সেদিনও সে ঘর থেকে বের হয় সাড়ে তিনটার দিকে একই উদ্দেশ্যে। তার আগে কিছুক্ষণ মাঠে খেলা করছিল মাদরাসার মাঠে। আবির আলী মাদরাসার মাঠ থেকে তাকে কোলে নিয়ে আদর করে। আয়াতকে বাসার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে আয়াত জানায় সে আরবি পড়তে যাবে। কোল থেকে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করে। না পেরে চিৎকার করতে থাকে। আবির দ্রুত তাকে নিয়ে বাসায় ঢুকে যায়। কিন্তু আয়াতের চিৎকার থামছিল না কিছুতেই। ভয় পেয়ে আয়াতের কণ্ঠ নালী সজোরে চেপে ধরে আবির। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আয়াত। আবির বুঝতে পারে, আয়াত মারা গেছে। সময় লেগেছে মাত্র দশ থেকে পনের মিনিট। আবির বলে, এরপর দুটি বড় ব্যাগের মধ্যে একটিতে লেপ-কম্বল এবং আরেকটিতে লাশ ঢুকিয়ে বাইরে বের হই। কেউ সন্দেহ করেনি। রিকশায় উঠে পকেটবাজারে আমাদের (মায়ের বাসা) বাসায় চলে যাই। সেখানে বাথরুমের ওপর তাকের ভেতরে বস্তাসহ লাশ ঢুকিয়ে রাখি। আয়াত নিখোঁজের রহস্য উদঘাটনে গঠিত পিবিআই টিমের পরিদর্শক (মেট্রো) ইলিয়াস খান বলেন, আবির যখন দুটি বস্তা নিয়ে বাসায় ঢুকছিল, তখন তার মা ও বোন বাসায় ছিল। যেহেতু মাঝে মাঝে আবির তার বাবার বাসা থেকে বিভিন্ন মালামাল আনত, সেটা ভেবে তাদের মধ্যে কোনো সন্দেহ হয়নি। কিছুক্ষণ পর আবিরের মা ও বোন দোতলায় গিয়ে প্রতিবেশিদের সঙ্গে আড্ডায় বসেন। আবিরও সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করে। এরপর আবার নয়ারহাট এলাকায় বাবার বাসায় যায়। ততক্ষণে আয়াতকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। আবির নিজেও আয়াতকে খুঁজতে থাকে! নয়ারহাট থেকে সন্ধ্যার পর আবির আবার পকেটবাজার এলাকায় চলে আসে। সেখানে একটি দোকান থেকে একটি এন্টিকাটার, পলিব্যাগ ও কচটেপ কিনে রাত ৯টার দিকে বাসায় যায়।
দোকান থেকে এসব পণ্য কেনার ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে জানিয়ে পিবিআই পরিদর্শক মর্জিনা আক্তার বলেন, বাসায় ফিরে আবির তার মা ও বোনকে আয়াত নিখোঁজের তথ্য দিয়ে তার পরিবারের সদস্যদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নয়ারহাট পাঠায়। খালি বাসায় সুযোগ বুঝে ব্যাগ থেকে লাশ বের করে বাথরুমে নিয়ে যায়। প্রথমে এন্টি কাটার দিয়ে কাটার চেষ্টা করে। না পেরে ঘরের বটি দিয়ে লাশ ছয় টুকরা করে। আবিরের তথ্যমতে, লাশ বের করে মাথা থেকে গলা পর্যন্ত এক খণ্ড, দুই হাত দুই খণ্ড, গলার নিচ থেকে উরু পর্যন্ত একখণ্ড এবং দুই পা দুই খণ্ড করে কেটে ফেলে। বাথরুমের ফ্লোরে থাকা রক্ত পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলে। এন্টিকাটার ও বটি আবিরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আমরা উদ্ধার করেছি।
প্রতিক্রিয়াহীন নিশ্চিন্তের ঘুম : পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, রাত ১০টার দিকে দাদা মনজুর আলম নাতনি আয়াতকে খুঁজতে পকেটবাজারে আবিরদের বাসায় যায়। তখন আবির বাসায় ছিল। সে মনজুরের সঙ্গে থেকে ওই এলাকায় কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজিও করে। পরে মনজুর বাসায় চলে গেলে আবির তার বাসায় ফিরে যায়। রাতে তার মা ও বোন বাসায় ফিরে। বাসায় ঢুকে তারা কিছুই বুঝতে পারেনি। রাতে ভাত খেয়ে তিনজন ঘুমিয়ে পড়ে। বাথরুমের তাকের ওপর তখন শিশু আয়াত পড়ে আছে খণ্ডবিখণ্ড হয়ে।
পিবিআইয়ের এসপি (মেট্রো) নাইমা সুলতানা বলেন, লাশের খণ্ডগুলো থেকে যাতে রক্ত বের না হয়, সেজন্য কচটেপে মুড়িয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে আবারও ভালোভাবে কচটেপে মোড়ানো হয়। ব্যাগের ওপরে পারফিউম ছিটিয়ে দেয়। রুম স্প্রে করে পুরো বাসায়। বাথরুমের রক্ত ভালোভাবে পরিষ্কার করে নিজেও গোসল করে।
সাগরে ভাসিয়ে দেয়ার কৌশল: পিবিআইকে আবির জানায়, সিরিয়ালে সে দেখেছে, পুলিশ যেকোনো ভাবেই লাশ উদ্ধার করে অপরাধীর কাছে পৌঁছে যায়। একমাত্র সাগরে ভাসিয়ে দিলেই তাদের কষ্ট হয়। সেই ভাবনা থেকেই ১৬ নভেম্বর ভোরে মা-বোনের অজ্ঞাতে তিনটি লাশের খণ্ড নিয়ে বাসা থেকে হেঁটে আউটার রিং রোড সংলগ্ন বে-টার্মিনাল এলাকায় যায়। তখন সাগরে ভাটার টান ছিল। সে দ্রুত গলার নিচ থেকে উরু পর্যন্ত একটি ব্যাগে এবং দুইটি পা আলাদা দুইটি ব্যাগে ভরে সাগরে ফেলে দেয় এবং সেগুলো পানির টানে নেমে যায়। এরপর রাত ৯টায় বাকি মাথা ও দুই হাত নিয়ে যায় আলী রোডের শেষ প্রান্তে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায়। সেখানে একটি খালের স্লুইচগেটের মুখে বাকি তিন খণ্ডের তিনটি প্যাকেট ফেলে দেয়। পানির স্রোতে সেগুলো খাল দিয়ে সাগরে চলে যায়। একই স্থানে আবির আয়াতের হিজাব, ওড়নাসহ পোশাক একটি প্যাকেটে ভরে ফেলে দেয়। গতকাল দুপুরে আবিরকে নিয়ে লাশ ভাসানোর স্থানগুলোতে যায় পিবিআই টিম। সে কোথায়, কখন, কিভাবে লাশের খণ্ডগুলো ফেলেছে তার বিস্তারিত বিবরণ পিবিআই কর্মকর্তাদের দেয়।
পরিকল্পনা বাস্তবায়ন: পিবিআই পরিদর্শক ইলিয়াস খান বলেন, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আবির তার মায়ের সেলাই মেশিন বিক্রি করে কিছু টাকা সংগ্রহ করেছিল। ৩০০ টাকা দিয়ে একটি মোবাইল কিনেছিল। রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটি বাংলালিংকের সীম নিজের কাছে রেখেছিল আয়াতের বাবাকে ফোন করে মুক্তিপণ দাবির জন্য। আয়াতকে ঘরে নেয়ার পর যখন সেই সীম মোবাইলে ঢুকিয়ে ফোন করতে গেল, তখন দেখা গেল সেটি ব্লক করা। এ অবস্থায় আয়াতকে ছেড়ে দিলে সে সবকিছু জানিয়ে দেবে। আবার তাকে রাখবে কোথায়- এই চিন্তা থেকেই মেরে ফেলে। খুনের পর মুক্তিপণ দাবি করা যাবে ভেবেছিল। কিন্তু পরিচিত কারও মোবাইল থেকে ফোন করে মুক্তিপণ দাবি করলে যে ধরা পড়ে যাবে, এটা সে বোঝে। সহজে তাকে শনাক্ত করা যাবে, এমন কোনো কাজ সে করেনি।
এদিকে ঘটনার পর আবির তার বন্ধু হাসিবকে জানিয়েছিল, আয়াতকে খুন করে সে লাশ কেটে সাগরে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু হাসিব বিষয়টি গোপন রাখায় তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পিবিআই।
আবির আলীকে সন্দেহের কারণ : পিবিআই এসপি (মেট্রো) নাইমা সুলতানা জানান, আয়াতের দাদা ইপিজেড থানায় দায়ের হওয়া একটি নিখোঁজ জিডি নিয়ে তাদের কাছে সহযোগিতা চান। তাৎক্ষণিক একটি টিম গঠন করা হয়। ১৮ নভেম্বর থেকে তদন্তে নামেন ওই টিমের সদস্যরা। তবে তিনদিন ধরে এলাকায় গিয়ে এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।
২১ নভেম্বর পিবিআই পরিদর্শক মর্জিনা আক্তারের নেতৃত্বে একটি টিম আয়াতের বাসায় যায়। বাসার সামনে রাস্তায় খেলছিল আয়াতের সাথীরা। মর্জিনা তাদের কাছে আয়াতের বিষয়ে জানতে চান। তারা জানায়, ১৫ নভেম্বর বিকেলে আয়াতকে তারা আবিরের কোলে দেখেছে। সেটাকেই সূত্র হিসেবে ধরে আবিরের পরিচয় উদঘাটন করা হয়। তার বাবা ও মায়ের আলাদা বাসা শনাক্ত করা হয়। আয়াতের বাসার আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়।
পিবিআই কর্মকর্তা মর্জিনা আক্তার বলেন, কৌশলগত কারণে আবির পালিয়ে যায়নি। আমরা আবিরকে জিজ্ঞেস করি যে, তুমি বাচ্চা কোলে নিয়েছ, এই বাচ্চা গেল কোথায় ? সে জবাব দেয়, আমি আদর করে নামিয়ে দিয়েছি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখি, ১৫ নভেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে দুইটা ব্যাগ নিয়ে আবির তার বাবার বাসা থেকে বের হচ্ছে। একটা কালো ব্যাগ একটু বড় ছিল। তার বাসায় গিয়ে লেপ-কম্বলের ব্যাগটি পাওয়া গেলেও কালো ব্যাগটি পাওয়া যায়নি। তখনই আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করি যে, আবিরের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। আমরা আটক করে তাকে আমাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি এবং একপর্যায়ে সে ঘটনা স্বীকার করে।
কেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ?: পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আবিরের বাবা আজহারুল ইসলাম এবং মা আলো বেগমের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়।
আলো বেগম ছেলে আয়াত ও মেয়ে আঁখি আক্তারকে নিয়ে ইপিজেড থানার আকমল আলী রোডের পকেটবাজার এলাকায় আলাদা বাসা নেন। বাবার বাসা থেকে বিভিন্নসময় সে মায়ের বাসায় যেত। বাবা-মায়ের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর তারা অর্থকষ্টে পড়ে। মা ও আবির দু’জনই পোশাক কারখানায় চাকরি করত। হঠাৎ দুজনের চাকরি চলে যায়। টাকার জন্য আয়াতকে জিম্মি করে কিংবা খুন করে তার বাবার কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের কৌশল নিয়েছিল। নাইমা সুলতানা বলেন, আবিরের এই দাবি সত্যি কি না সেটা আরও খতিয়ে দেখা হবে।