কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়নকে রিজার্ভ বলে। রপ্তানী আয়, রেমিট্যান্স, প্রবাসী আয়, ঋণ এবং অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া বৈদেশিক মুদ্রা থেকে আমদানী ব্যয়, বিদেশে শিক্ষা ব্যয়, চিকিৎসা ব্যয়, ভ্রমণ ব্যয়, সুদ পরিশোধ ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে খরচ বাদ দিয়ে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে সঞ্চিত থাকে তাকে রিজার্ভ বলে। সহজ কথায় বলতে গেলে রিজার্ভ বা মজুত হচ্ছে দেশের আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা থেকে দেশের ব্যয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রা বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে তাকে বোঝায়।
একটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা দেশের মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি দেশে যত বেশি বৈদেশিক মুদ্রা থাকবে তত বেশি আস্থা থাকবে বিদেশিদের। অর্থনীতিবিদদের মতে বৈদেশিক মুদ্রার ভালো রিজার্ভ মানে দেশে আমদানি সক্ষমতা রয়েছে। তবে সাধারণভাবে বলা হয় একটি দেশে তিন মাসের আমদানি খরচের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা থাকা খুবই প্রয়োজন।
প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা সব দেশেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুত গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ এটি। বিদেশে কর্মরত জনশক্তির পাঠানো অর্থ বহুলভাবে পরিচিত রেমিট্যান্স হিসেবে। বিদেশি মুদ্রার বড় একটি চালান আসে রপ্তানি আয় থেকে বাংলাদেশে। গার্মেণ্টস শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ। শিল্প পণ্য ছাড়াও বাংলাদেশ সেবা পণ্যও রপ্তানী করে। এছাড়াও বিদেশি কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান যদি সরাসরি বিনিয়োগ করে কোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে বাংলাদেশে, সেটা থেকেও আয় করে বাংলাদেশ। যা রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ। তাই রিজার্ভ সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। যখন বৈদেশিক মুদ্রা আসে তখন এর বিপরীতে গ্রাহককে বাংলাদেশি মুদ্রা তথা টাকা সরবরাহ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব মুদ্রার মান ঠিক রাখতে ডলারের বিপরীতে দাম ঠিক করে দেয়। দেশের মুদ্রা যাতে অন্যান্য দেশের মুদ্রার তুলনায় দাম না হারায়। কোনও দেশের স্থানীয় মুদ্রার মান যদি খুব কমে যায় বা অবমূল্যায়িত হয় বা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে তাহলেও রিজার্ভের অর্থ জরুরি উৎস হিসেবে কাজ করে। এমন পরিস্থিতিতে রিজার্ভ কম থাকলে দেশের মধ্যে মুদ্রা সংকট দেখা দিতে পারে। দেশের রিজার্ভ কমে গেলে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার কারণে বেড়ে যায় ডলারের দাম এবং টাকার মান কমে যায়। বাংলাদেশের মত দেশে রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি করতে হয়। ফলে এক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার ভালো রিজার্ভ থাকা খুব দরকার।
বৈদেশিক মুদ্রার পর্যাপ্ত রিজার্ভ না থাকলে ঋণ নিতেও ঋণ পেতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। সরকার বিভিন্ন দেশ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার পর তা পরিশোধ করে থাকে বৈদেশিক মুদ্রায়। ফলে রিজার্ভ না থাকলে এই মূল্য পরিশোধেও অসুবিধা হয়। একটি দেশের আমদানি ব্যয় মূলত বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়।
করোনাকালীন সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত তখন বাংলাদেশ রিজার্ভের ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। ২০২১ সালের শেষের দিকে রিজার্ভের পরিমাণ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায় যা নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের জন্য মাইলফলক। বেশ কিছুদিন থেকে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। দেশে চলমান ডলার সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিদিনই ডলার সরবরাহ করছে।
বাংলানিউজের খবর অনুসারে চলতি নভেম্বর মাসের শুরুতে ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার থাকলেও ২১ নভেম্বর তা কমে ৩৪ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। যা দিয়ে সর্বোচ্চ ৪ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। ৭ নভেম্বর রিজার্ভ ছিল ৩৫ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। এরপর রিজার্ভ থেকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের ১৩৫ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়। পাশাপাশি আমদানি ব্যয় মেটাতে ১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার বিক্রি করা হয় রিজার্ভ থেকে। এর ফলে রিজার্ভ কমে ৩৪ দশমিক ২৮ বিলিয়নে নেমে এসেছে। অন্যদিকে রেমিট্যান্স আসার গতিও শ্লথ। চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১৮ দিনে প্রায় ১০৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ৪৮৯ কোটি ডলার বিক্রি করেছে ব্যাংকটি। গত অর্থবছরে বিক্রি করা হয়েছিল ৭৬২ কোটি ডলার। বিক্রয়কৃত ডলারের ৯০ শতাংশ খরচ হয় জ্বালানি ও সার আমদানিতে।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে অব্যাহত আলোচনার মধ্যে গত ১৪ নভেম্বর জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন।
রিজার্ভ খরচের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যখন করোনা শেষ হয়ে যায়, আমাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, ইন্ডাস্ট্রি তৈরির ক্ষেত্রে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, এমনকি চাষবাসের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কিনে নিয়ে আসা, সেগুলোর জন্য আমাদের ডলার খরচ করতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা যে ভ্যাকসিন কিনেছি, ভ্যাকসিন যখন রিসার্চ হচ্ছে, তখনি আমি ১২০০ কোটি টাকা জমা দিয়ে দিয়েছি যাতে যেটাই সফল হয়, আমি আগে নেবো। আমার দেশের মানুষকে বাঁচাবো।’
‘শুধু ভ্যাকসিন নিলেই তো হয় না। ভ্যাকসিন দিতে সিরিঞ্জ লাগে, অনেক কিছুই লাগে। প্রয়োজনে প্লেন পাঠিয়ে বিদেশ থেকে আমি জিনিসপত্র আনিয়েছি। তাতে টাকা খরচ হয়নি? টাকা তো খরচ করতে হয়েছে। এই টাকা ব্যবহার করেছি মানুষের কল্যাণে।’
‘করোনা যেতে পারেনি, শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম সারা বিশ্বে বেড়ে গেছে। আপনি চাল বলেন, গম বলেন, ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল, গ্যাস সব কিছু এমনভাবে বেড়ে গেছে, শুধু জিনিসের দাম যে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়ে গেছে তা নয়, তার সঙ্গে পরিবহন খরচও বেড়েছে’।
‘২০০ ডলারে যে গম কিনতাম, সেটা ৫০০ ডলারে কিনতে হয়। কিন্তু আমরা তো দেশের মানুষকে কষ্ট দিতে পারি না। সেই কারণে যতো দামই লাগুক, আমরা কিন্তু কিনে নিয়ে আসছি, মানুষকে দিচ্ছি। এক কোটি মানুষকে আমরা টিসিবির কার্ডের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে খাবার সরবরাহ করছি’।
আমদানি খরচ বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় দেশে ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। রিজার্ভ কমে গেলে অর্থাৎ বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে পড়লে অর্থনীতিতে তা মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন যথেষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ মজুত থাকার মানে হল দেশটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। কারণ বিশ্বায়নের কারণে একটি দেশের সাথে আরেকটি দেশের নানানভাবে লেনদেন করতে হয়। তাই বৈদেশিক মুদ্রার যোগান না থাকলে একটি দেশ চরম সংকটে পড়ে। এ জন্য রিজার্ভের ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রিজার্ভ সংকট শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর সব দেশ এখন রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ করছে। এমনকি যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ রিজার্ভ সংকটে পড়েছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যাভাব, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা এবং সম্ভাব্য মন্দা উত্তরণে উৎপাদন বৃদ্ধির আর কোনও বিকল্প নেই। অতি প্রয়োজনীয় ছাড়া সব ধরনের পণ্য আমদানি কমিয়ে আনতে হবে যাতে আমরা এই সমস্যা সফলভাবে পাড়ি দিতে পারি। সবাইকে অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়ে কিছু কিছু টাকা সঞ্চয় করতে হবে। সম্ভাব্য মন্দা মোকাবেলায় যাদের জমি আছে তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ জমিতে কিছু না কিছু যদি উৎপাদন করা যায়, তাহলে নিজেদের চাহিদা নিজেরাই পূরণ করতে পারবো। বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনার সময় যেভাবে আমরা সফলভাবে কাটিয়ে উঠতে পেরেছি বর্তমান সময়ও সেভাবে আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি, বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।