(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
উন্মুক্ত আকাশের নিচে পিকনিকের আমেজে খাবার খাচ্ছিলাম আমরা। ফ্রাইড চিকেনসহ ফাস্টফুড বিক্রি করে এমন একটি দোকান (কেএফসি টাইপ) থেকে বার্গার, চিকেন ফ্রাই এবং ফেঞ্চ ফ্রাই নিয়েছি আমরা। অর্ডার করার সময় এত বেশি খাবার না নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম কায়সার ভাইকে, কিন্তু তিনি শুনেননি। বলেছিলেন, এখন টুকটাক কিছু খেয়ে নিই, বাসায় গিয়ে ডিনার করবো। কিন্তু টুকটাকের নমুনা যদি এই-ই হয় তাহলে ভালোভাবে নেয়া কাকে বলে কে জানে! তাছাড়া এত খাবারে সমৃদ্ধ টুকটাক সারার পর ডিনারে যে কী থাকবে কে জানে!!
আমরা চারজনের একটি টেবিলে বসেছি, মুখোমুখি। কায়সার ভাই এবং জুবায়ের একপাশে, আমি বিপরীত পাশে। আমাদের মাঝখানে টেবিলে খাবার। আমাদের ধারে কাছে আরো অনেকেই আছেন। কারো টেবিলে খাবার আছে। কেউ কেউ খাচ্ছেন, আবার কেউবা খাবারের অপেক্ষা করছেন। তবে সবাই মেতে আছেন গল্পে।
আমরাও গল্প করছিলাম। কত ধরনের গল্প যে করছি!! এটি বুঝি জায়গার গুন! এমন মোহনীয় জায়গায় গল্প বুঝি আপসে-আপ ঢালপালা ছড়ায়। অবশ্য এখানে গল্প এবং খাওয়া দাওয়া ছাড়া আর তো কিছু করারও নেই, থাকেও না। আমাদের মন-প্রাণ জুড়ে রোমাঞ্চের ছড়াছড়ি চলছিল। রোমাঞ্চের দারুণ এক প্রভাব কাজ করছিল অন্তরে। মাথার উপর চাঁদ না থাকলেও ‘উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ডে’র আলোচ্ছটা এমন মোহনীয় এক পরিবেশ তৈরি করেছে যে মনে হচ্ছিল ভর জ্যোৎস্নায় ভাসছি আমরা।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সবসময়ই আমার প্রিয় খাবারের একটি। বার্গার কিংবা চিকেন ফ্রাইর চেয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বেশি পছন্দ করি আমি। মোলায়েম সসের ছোঁয়ায় আধো-আলতো কামড়ে আলুর স্লাইসগুলোর এক একটি কেমন যেন অমৃত হয়ে উঠে! নানারকমের সস রয়েছে। তবে আমি ‘হট’ শব্দটি চীনা তরুণীকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাই মেয়েটি এমন তীব্র ঝাল মরিচের সস সরবরাহ করেছে যে মুখে দেয়ার সাথে সাথে যতটুকু যাচ্ছে খবর করে দিচ্ছে! এখানে একটু বলে রাখা ভালো যে, চীনা মরিচের ঝাল অনেক। মনে হয় এরা প্রচুর ঝাল খায়, কিংবা পছন্দ করে। আমি চীনে এসেছি পর্যন্ত এত বেশি ঝাল খাচ্ছি যে যখন তখন নাকে মুখে পানি চলে আসছে। তবে ব্যক্তিগত জীবনে আমি যেহেতু ঝাল পছন্দ করি তাই চীনের নানা স্থানে খাবারের পর্বটি আমার কাছে বেশ উপভোগ্য হয়েছে। ঠিক যেন সোনায় সোহাগা!! আমার সাথে লায়ন ফজলে করিম ভাই যখন ঝালের ছোটে প্লেট থেকে হাত তুলে নিয়েছেন তখন দিব্যি আমি খেয়ে গেছি। আমাদের লায়ন বিজয় শেখর দাশ দাদাকেও দেখলাম বেশ ঝাল খেতে। আনন্দের সাথে ঝাল খাওয়ার মাঝেও আনন্দ আছে!!
চীনের শেনজেনের উইন্ডো অব দ্যা ওয়ার্ল্ডের সামনের উন্মুক্ত চত্বরে কফিতে চুমুক দিচ্ছিলাম আমি। কায়সার ভাই এবং জুবায়ের কফি নিলেন না। চিকেন ফ্রাই, বার্গার এবং ফ্রেঞ্চ ফ্রাইর সাথে নাকি কফি যায় না। তারা বরফে ডোবানো কোল্ড ড্রিংকস নিলেন। আমি ধুমায়িত কফি। তারা কোল্ড ড্রিংকসে আর আমি কফিতে চুমুক দিতে দিতে আশপাশ দেখছিলাম। আমাদের ধারে কাছে বহু নারী পুরুষ কলকল করছে। তাদের প্রেমের স্টাইলও অনেকটা ইউরোপীয়। চীনারা পণ্যের মান রক্ষায় তারা ইউরোপীয় স্টান্ডার্ডের বহু নিচে থাকলেও প্রেমের ক্ষেত্রে মনে হয় ইউরোপের ধারেকাছে পৌঁছে গেছে। এমন বাঁধভাঙ্গা প্রেম যে তাকানো যায় না, চোখ নামিয়ে নিতে হয়। কত রকমারি আয়োজনে যে এরা সময়কে উপভোগ করে। খাবার যা খাচ্ছে তার থেকে সময়কে ঢের বেশি উপভোগ করছে তারা। এক মগ কফি নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে হাতে হাত নিয়ে বসে থাকতেও দেখলাম অল্পবয়সী এক যুগলকে। চোখে মুখে কথা বলছিল তারা। হয় নতুন বিয়ে করেছে, অথবা নতুন প্রেম! চীনা প্রেম!!
চীনে যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং করার সুযোগ নেই। রাস্তার পাশে খালি জায়গা অনেক, কিন্তু একটিও গাড়ি পার্কিং করা নেই। ঠেলা রিক্সা ভ্যান কিংবা টেক্সির জটলার কথাতো চিন্তাও করা যায় না। আমাদেরকে গেটে নামিয়ে দিয়ে চালক কোথায় গিয়ে যে গাড়ি রেখেছেন তা আমরা জানিনা। আমাদের নামিয়ে দেয়ার সময় বলেছিল যে, দেখা শেষ হলে তাকে ফোন করলে আবার গেট থেকে আমাদের তুলে নেবে। কায়সার ভাই তাকে ফোন করলেন। পাঁচ মিনিট সময় লাগবে বলে ফোনে জানালো চালক। পাঁচ মিনিটের দূরুত্বে চলে গেছেন তিনি! পার্কিং এরিয়া কী অনেক দূরে!! কায়সার ভাই বললেন, কিছুটা দূরে হয়তো হবে। তবে পার্কিং থেকে কার্ড পাঞ্চ করে পেমেন্ট দিয়ে বের হয়ে আসতে কিছুটা সময়তো লাগেই! আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমাদের দেশে যেখানে সেখানে চীনারা গাড়ি রেখে এখানে ওখানে চলে যায়। অথচ নিজের দেশে একদম সোজা। অপরদিকে আমরা বিদেশে গেলে চকলেটের খোসাও হাতে নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁটি, সোজা হয়ে চলি। আর নিজের দেশে পুরোটাই উল্টা!!
পাঁচ মিনিটের মধ্যে হাজির হলেন চালক। কায়সার ভাই আমাকে ফ্রন্ট সিটে বসিয়ে দিলেন, চালকের পাশে। বললেন, দেখতে সুবিধা হবে। আসার সময় একপাশ দেখেছেন, এখন অন্যপাশ। চালক আমাকে বেল্ট বেঁধে ফেলার ইশারা দিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি বেল্ট লাগানো শেষ না করা পর্যন্ত তিনি গিয়ার লাগালেন না।
ছুটছে আমাদের গাড়ি। চীনের প্রযুক্তির রাজধানীখ্যাত শেনজেন থেকে অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র গুয়াংজুর দিকে ছুটছি আমরা। বিশাল চওড়া রাস্তা, ছয় লেনের। স্পিডমিটারের দিকে চোখ দিলাম। ১২০ এ ছুটছে আমাদের গাড়ি। এমন গতিতে গাড়ি আমরাও চালাই। কিন্তু এখানে মনে হচ্ছে একটু অন্যরকম। গাড়ির কোন শব্দ নেই, কোন নড়াছড়া নেই। শরীরে কোন খবর নেই। কেবলই ছুটে চলছি। গতিকে ঠিক এভাবে উপভোগ করার ভাগ্য আমাদের হয়না। এমন মসৃন রাস্তা আমাদের পুরোদেশে একটিও নেই। এমনকি চীনারা আমাদের যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বানিয়েছে সেটিও এমন মসৃন নয়। আবারো আমার মনে হলো, এরা নিজের দেশে একদম সোজা, যত গোলমাল আমাদের দেশে!
কথাটি বলতে জোবায়ের ভাই বেশ শব্দ করে হাসলেন। বললেন, আমাদের ওখানে কেন গোলমাল করে তা বুঝি আপনি জানেন না! তিনি একটি গল্প বলতে শুরু করলেন। বেশ রসিয়ে রসিয়ে। বললেন, জানেন তো, চীনকে বিশ্বের মেগা কারখানা বলা হয়। অর্থাৎ চীন পুরো বিশ্বের কারখানা। আপনি যাই বানাতে চান তা এখানে বানানো সম্ভব। চীনা শিল্পপতিরা আপনাকে তা বানিয়ে দেবে। আপনি শুধু নমুনা এবং টাকা দেবেন। কায়সার ভাই বললেন, একশ’ ডলারে চীন যে পণ্যটি ইউরোপীয়ান স্টান্ডার্ডে বানায়, ঠিক একই পণ্য দশ ডলারেও আপনাকে বানিয়ে দেবে। আরো কমে বানাতে বললেও না করবে না। চীন নিজেদের বাজারের জন্য এক ধরনের পণ্য বানায়, অন্যদের জন্য অন্য ধাঁচের। বিশ্ববাজারের জন্য একই পণ্য অসংখ্য ক্যাটাগরিতে বানায়। ইউরোপ আমেরিকায় চীনের যে পণ্য যায় তা আমাদের বাংলাদেশে যায় না। আবার বাংলাদেশে যা যায় তা ইউরোপ আমেরিকায় পাঠানো হয় না। তিনি এই বলে গল্প শেষ করলেন যে, চীন বিশ্বের দেশে দেশে রাস্তা বানায়, ব্রিজ বানায়, বন্দর বানায়, বিমানবন্দর বানায়। এগুলোও একই স্টাইল। যে দেশ যেমন, যে দেশ যেমন অর্ডার দেয় সেই দেশে তারা তেমন করে কাজ করে দেয়। অবশ্য হাসতে হাসতে এটুকুও বলে দিলেন যে, কত পারসেন্ট কমিশন দিতে হচ্ছে তার উপর রাস্তার মান নির্ভর করে! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।