সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য সংকট থেকে আমরা বাঁচবো কীভাবে? এটাকে মুখ্য আলোচনায় রেখে আজকের এই লেখা। মাত্র কয়েক মাস আগে আমার একটা প্রবন্ধ আজাদীতে ছাপানো হয়েছিল- যার হেড লাইন ছিল বিশ্বে ‘দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস’। আজ মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ দিয়েও একই কথা শুনা যাচ্ছে। এই দুর্যোগ শুধু বাংলাদেশ একার নয়- এটা উন্নত, অনুন্নত, মধ্যম আয়ের দেশ সবারই সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুদ্রাস্ফীতি দিনদিন বাড়ছে, করোনা মহামারীর পর দুর্ভিক্ষের কারণ একটাই আর সেটা হল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেনকে পৃথিবীর শস্য ভাণ্ডার বলা হয়। সে দেশে ৯ মাস যাবত বৃহৎ শক্তি রাশিয়ার ধ্বংস যজ্ঞ চলতেছে। বিপুল পরিমাণ শস্যহানি হচ্ছে ও উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। রপ্তানীতেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তেল ও গ্যাস সমৃদ্ধ দেশ রাশিয়া রপ্তানী বহুলাংশে কমিয়ে দিয়েছে। পুরো ইউরোপ-রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। তেল সরবরাহকারী পাইপ লাইন মেরামতের নাম করে রাশিয়া ইউরোপে তেল সরবরাহ বন্ধ রেখেছে।
ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ভ্লাডিমি পুতিন ইউক্রেনের চারটা দখলকৃত ভূখণ্ডে সামরিক আইন জারী করেছে এবং যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। বৈদ্যুতিক স্থাপনা থেকে শুরু করে প্রধান প্রধান স্থাপনা ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিভীষিকাময় এযুদ্ধ শেষ হবার নয়। তাই বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ভাবছে বিশ্বময় দুর্যোগ আরও ঘনীভূত হবে এবং মানব বিপর্যয় ঘটবে। বিশ্ব অর্থনীতি মহা সংকটের দিকে যাচ্ছে। দরিদ্র দেশগুলিতে গ্যাস-তেলের মজুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। খাদ্য শস্যের অভাব-অনটন দিন দিন বাড়ছে। লক্ষ লক্ষ লোক চাকরি হারাচ্ছে। মানুষ বলতে গেলে দিশেহারা। তবে চিন্তা করতে গেলে তুলনামূলকভাবে আজ পর্যন্ত আমরা ভাল আছি। তবে সামনে থাকব কিনা সন্দেহ।
বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হলে কি হবে অবস্থাটাতো বৈশ্বিক। তাই এই প্রেক্ষাপটে আমাদের মহামান্য প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানিয়ে বলেছেন যে, কোনো কিছুর অপচয় থেকে দূরে থাকতে বিশেষ করে খাদ্যের যেটা আমাদের প্রাণ বাঁচায়, শক্তি যোগায়। তিনি দেশবাসীকে এও বলেছেন খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে। প্রত্যেকটি খালি জায়গায় ফসল ফলাতে। এমন কি খাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া খাবার সংরক্ষণ করে পরবর্তী বেলায় ব্যবহার করার জন্য। তিনি মজুদদারদের হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন ও তাদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছেন। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে বলেন তারা যেন দেশবাসীর কথা ভুলে না যায়। বিশ্ব খাদ্য দিবসে প্রধানমন্ত্রী এই কথাগুলো বলেছেন। একটু ভাবুনতো দেশের প্রতি, দেশের প্রতিটা মানুষের প্রতি কতটুকু মায়া, মমতা ও ভালোবাসাবোধ থাকলে এসব কথা বলা যায়! তিনি প্রতিটি কথায় দেশবাসীর সাহস যোগাচ্ছেন ও ধৈর্য্যধারণের কথা বলছেন। যারা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আছেন, কয়জনের এমন মমত্ববোধ আছে?
বেশিরভাগ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের জাহির করার জন্য, জনগণকে দেখানোর জন্য কাজ করে থাকেন। সাথে সাথে নিজের স্বার্থহাসিল ও লুটপাটে ব্যস্ত থাকেন। দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্নীতিপরায়ণ লোক কখনো মানুষের উপকার করতে পারে না। ভোগীলোক কখনও সেবক হতে পারে না। একমাত্র ত্যাগীরাই জনগণের প্রকৃত সেবক হতে পারে। নিরপেক্ষ, নির্দলীয়ভাবে চিন্তা করলে বলা যায় মহামান্য প্রধানমন্ত্রীর উক্ত কথাগুলি খুবই মর্মস্পর্শী। অপচয়, প্রয়োজনহীন ও লোক দেখানো অযথা অর্থব্যয়, জাকজমকপূর্ণ বিলাস বহুল জীবন-যাপনে বেশি অর্থব্যয় না করা এবং সংযমী হওয়া ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। কোরআন শরীফে উল্লেখ আছে আল্লাহ মিতকব্যয়ীদের পছন্দ করে আর অপচয়কারীকে ঘৃণা করে। তিনি দেশবাসীকে কৃচ্ছতা সাধনের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। এক সমীক্ষায় জার্মান অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নমন্ত্রী ‘সভেনজা শুলজে’ সতর্ক করে বলেছেন বিশ্বে দুর্ভিক্ষ ভয়বহতা রূপ নিতে পারে। জাতিসংঘ খাদ্যসংস্থা জানিয়েছে ৩০ কোটির অধিক মানুষ অনাহারে ভুগছে এবং এটা দিন দিন বাড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে খাবারের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যেতে পারে। রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের প্রায় ১২ শতাংশ খাদ্য ও ৩০ শতাংশ গম রপ্তানী করে। জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দরিদ্র দেশগুলিতে অপুষ্টি-অনাহার বাড়বে। মুদ্রাস্ফিতী বাড়তে থাকায় কোটি কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজার ও ত্রাহি অবস্থা। তাই আমাদের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি গার্মেন্টস সেক্টরে এর প্রভাব পড়বে। তাই বিদ্যুৎ ঘাটতি কমিয়ে এই শিল্পকে চালু রাখতে হবে। ‘সেন্টার ফর পলিসি’ প্রতিবেদনে বলেছেন বর্তমান বাজারে ৪ জনের একটা পরিবার চলতে গেলে মাসে ২২ হাজার টাকা লাগে। যদি মাছ মাংস বাদ দেন তবে ৯৫০০ টাকা লাগে। বৈশ্বিক সংকট আস্তে আস্তে ঘনীভূত হচ্ছে। ধাক্কা লেগেছে মানুষের জীবন জীবিকায়।
কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী কৃষি, উৎপাদন ও কৃষকদের বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। সরকার প্রদত্ত প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদন বাড়াতে বলছেন। কতটুকু দেশপ্রেম থাকলে প্রবাসে এক কোটির উপর কর্মরত বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমাদের যারা বিদেশে চাকরি করেন, উপার্জন করেন তারা নিজের দেশ, গ্রাম ও মাটিকে যেন ভুলে না যায়’। যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বে যে দুর্ভিক্ষের আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেশবাসীকে সাহস ও উৎসাহ দেওয়ার জন্য তিনি বলেন সবার প্রচেষ্টায় সম্মিলিতভাবে এই দুর্যোগ মোকাবেলায় আমরা সক্ষম হবো- ইনশাল্লাহ। বর্তমান বিদ্যুতের ক্রাইসিস চলতেছে। আমরা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হই। মিতব্যয়ীদের উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- আমাদের পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ (ভারত) যেখানে বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার মানুষের যাতায়াত আছে।
সেখানে সকালে বাজারে গেলে একটা জিনিষ খেয়াল করলে দেখা যায় বাজারের থলে হাতে একজন ভদ্রলোক তরকারীওয়ালা ও মাছ মাংস ওয়ালাকে বলছে, ‘আমাকে দুইশ পটল, একশ উচ্চে, দেড়শ মিষ্টি কুমড়ো দাও’। বিক্রেতা তার চাহিদা অনুযায়ী দিল, মাছ ওয়ালাকে বলল ২৫০ শ বেলেমাছ, এমনকি ২০০শ ইলিশ মাছ দিতে। মাছওয়ালা কুটে সরবরাহ করল। অর্থাৎ ক্রেতা তার প্রয়োজনমত বাজার করল। স্বাদের ইলিশ মাছও একটু করে খেল। কিন্তু আমাদের দেশে এটাকে ঠাট্টা ও উপহাস করে। এই রকম ক্রয় বিক্রয় যদি আমাদের দেশে হতো দিন মজুর, রিকশাওয়ালারা তাদের মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারতো। তাতে শুধু বড়লোকেরা খাবে গরীবেরা খাবে না এই দীর্ঘনিঃশ্বাসটা আসতো না। বাংলাদেশের একজন মহান ব্যক্তির উক্তি ‘কেহ খাবে কেহ খাবো তা হবে না তা হবে না’।
সুতরাং অপচয় রোধ করুন। আমরা বাঙালিরা বেশি অপচয় করি। খাওয়া পাতের বাইরে পড়ে যায়। দাওয়াতে পাশের টেবিলে দেখুন- খাবে এটুকু কিন্তু পাতে নিয়েছে অনেকগুলো। পরে খেতে না পেরে ফেলে উঠে গেল। এটা খুবই অনুচিত। ছোট বেলা থেকে অভিভাবকদের শিক্ষা দেওয়া উচিত অযথা কোনো কিছু নষ্ট না করতে। পরিশেষে বলব চলুন প্রধানমন্ত্রীর আহবানে সাড়া দিয়ে সম্মিলিতভাবে দেশটাকে আসন্ন দুর্ভিক্ষের-দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করি।
লেখক: প্রাক্তন চীফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।