কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া, ভাটির দেশের মাটির ছবি।
হাওরের মানুষের জীবন দেখার ভানে ধানের ছবি। আমরা যারা ভাত খাই এটা তাদের ছবি, যাদের সন্তানেরা বড় হয় এই স্বপ্ন নিয়ে যে, শাক-লতা-পাতা তরকারি যাই হোক ভাতের হবে না, এটা তাদের ছবি। এই সিনেমা যারা শুধু শুনতে পায় তাদের সিনেমা, যারা শুধু দেখতে পায় তাদের সিনেমা।
সিনেমাতে প্রচুর তথ্য আছে, সংলাপ আছে। শুরু থেকেই পরিচালক সংলাপকে তার অন্যতম টুলস হিসেবে ব্যবহার করেছেন। একই সুখ-দুঃখকেও বারবার বলেছেন, যেন একবার বলে শুধু দায় সারেননি। কথা গুলো বলার জন্যই যেন ভালো একটা উপলক্ষ তৈরি করেছেন। অথচ কোন সংলাপ না শুনলেও শুধু সিনেমার ভিজুয়াল দেখলেও আপনি একধরনের পূর্ণতা অনুভব করবেন। তথ্যচিত্রের তথ্য এবং গল্পচিত্রের গাঁথুিনর অভূতপূর্ব মেলবন্ধন এই সিনেমা।
যে জমিতে ছোট্ট বীজটা আনন্দে বেড়ে উঠে, কুড়া পক্ষী সংসার পাতে, সোনালি ধানে ছেয়ে যায় প্রান্তর, সেই জমিতে যেন ভেঙে পড়ে গোটা নীল আসমান। একরাতেই নেমে আসে উত্তাল জলরাশি, উড়াল দেয় কুড়া পক্ষী। কিন্তু মানুষের তো আর ডানা নাই, তারা টিকে থাকার সংগ্রাম করে, অপেক্ষা করে পরের বছর তাদের সুখ ফিরে আসবে, কুড়া পক্ষী ফিরে আসবে, গোলা ভরে উঠবে ধানে। দু’বেলা ভাত খাবে পেট ভরে। তরকারি যাই হোক ভাতের অভাব হবে না তাদের।
জমির ধান গিলে খায় যে পানি, স্বামী-সন্তান, আপনজন টেনে নিয়ে যায় যে পানি, সে পানি তাদের নয়, সে পানির মাছ তাদের নয়। আল্লাহ দিয়েছে পানি-মাছ, রাজা বন্টন করে দিয়েছে তা উজির-নাজির, তাবেদারদের মাঝে।
চারপাশের জলরাশি, মাঝখানে তাদের ছোট্ট আঁটি। ঢেউয়ের ধাক্কা-ধাক্কি যেন প্রতি মুহূর্তে ঠেলে ভাসিয়ে নিতে চায় তাদের ভাঙ্গা বেড়া, ছোট্ট কুটির, ঘটি-বাটি, নিয়ে গেলে তো নিয়ে যাবে আঙ্গিনাটুকুও রাখবে না কোনো স্মৃতিচিহ্ন। জীবন যেখানে সংগ্রামে লিপ্ত সেখানে যেন সবাই আপন। আত্মীয়তাই যেখানে শক্তি। যেখানে যে কাউকে ভাই ভাবা যায়, মা ভাবা যায়, বাবা ভাবা যায়।
গল্পের বাহক চরিত্র সুলতান, তার মা নেই। গল্পের প্রধান নারী চরিত্র রুকুর মা, তার স্বামী নেই। একজনের দরকার মায়ের আঁচলের আশ্রয়। অন্যজনের দরকার সংসার টিকিয়ে রাখার শক্তি, সামর্থ্য, যোগান। চরিত্রগুলো কেউ কারো রক্তসম্পর্কীয় নয়, কিন্তু সবাই একে অপরের পরিপূরক আত্মীয়। নারী-পুরুষ সম্পর্কে পরপুরুষ সংক্রান্ত ধারণা আড়ষ্ট করে না। তারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে, ফসল ফলায়, একই দাওয়ায় বসে ভাত খায়। তাদের ঘরে বেড়া ভাঙ্গা কিন্তু চোখের আব্রু নয়। তারা সম্পর্কের প্রয়োজনে কাছে আসে, দূরে যেতে চায়।
অভিনয় যারা করেছে তাদের হয়তো আমরা অনেকে একটু কম চিনি, খুব জনপ্রিয় কোন অভিনেতা নেই। কিন্তু কম চেনাই যেন ওদেরকে আরও বেশি হাওড়ের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সবাই সাবলীল অভিনয় করেছে। শিশুশিল্পী হিসেবে যাদের দেখেছি তাদের পর্যন্ত ছোট ছোট ডিটেইলগুলো ছিল সাবলীল।
এই সিনেমা ভুল ধরার সিনেমা নয়, এই সিনেমা ভুল কীভাবে আরও মানবীয় করে তোলে সেটা অনুভবের সিনেমা। এরকম সিনেমা এখন কেউ বানায় না, এত পরিশ্রম কেউ করে না। এত গভীরে কেউ যায় না। এত জলে কেউ নামে না। এই সিনেমার ব্যবসায়িক ব্যর্থতা বাংলা সিনেমার ব্যর্থতার ইতিহাসকে দীর্ঘায়িত করবে।
সর্বসাকুল্যে চট্টগ্রামের একটি হল ও স্টার সিনেপ্লেক্স-এ দিনে দুটি শো-তে প্রদর্শিত হচ্ছে। চট্টগ্রামে দ্বিতীয় দিন আমরা সন্ধ্যা ছয়টার শো-তে মাত্র পনের থেকে বিশজন শো দেখেছি। অথচ ক’দিন আগে হাওয়ার শো দেখার জন্য লাইন ধরে অগ্রিম টিকেট কেটেছি। আমাদের সাথে চলচ্চিত্রকার ও লেখক শৈবাল চৌধূরীও দেখেছেন। তিনি নায়ক রাজ রাজ্জাকের বরাত দিয়ে বলছিলেন যে, আমাদের দেশে একসময় যে পরিমাণ সিনেমা হল ছিল তাতে একটা সিনেমা শুধু সারাদেশ ঘুরে আসলেই দ্বিগুণ টাকা উঠে আসতো। আজ সেখানে কমতে কমতে এমন সংখ্যায় এসে ঠেকেছে যে আমরা হলের সংখ্যা গুনতেই চাই না যেন গুণলে আরো কিছু সংখ্যা কমে যাবে। সুগন্ধা সিনেমার মালিক শাহাদাত ভাই বলছিলেন যে তাদের সিনেমা প্যালেসের যে সিনেমা হল সেটা বন্ধ করে দেবেন। যদিও এখনো তিনি ঝুমুর সিনেমা হলকে সুগন্ধা নামে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। অথচ আমরাই যেন আমাদের বিনোদনের সুযোগ এবং জায়গাগুলোকে অবহেলা করে যাচ্ছি। জীবনের প্রয়োজনে আমরা গ্রাম ছেড়ে শহরে থাকি, তবুও গ্রামের বাড়িতে আমরা যাতায়াত রক্ষা করি যেন নিজের ঘরটাই পর হয়ে না যায়। সেখানে দর্শক না গেলে সিনেমা হলটাই বা কেন দর্শকের থাকবে? সিনেমা হল হয়ে যাবে কমিউনিটি হল কিংবা শপিং মল।
‘কুড়া পক্ষির শূন্যে উড়া’ খেটে খাওয়া মানুষের সিনেমা ভাগ্যান্বেষী ভাসমান মানুষের সিনেমা। কিন্তু দুঃখ, তারা জানলোই না তাদের কথা নিয়ে তাদের জন্য নির্মিত হয়েছে ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া।’