দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৩ নভেম্বর, ২০২২ at ৮:৩৫ পূর্বাহ্ণ

গতরাতে লালসবুজ নুডুলস বার থেকে নিয়ে আসা ডিনার শেষে বেঁচে যাওয়া ঝোল নুডুলসের অবশিষ্টাংশ এইমাত্র পিতাপুত্রের যৌথ উদ্যোগে গরম হতেই মহা উৎসাহে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল দীপ্র।

খাবারের ব্যাপারে নিতান্ত বৈরাগী স্বভাবের দীপ্রর এই বাসি নুডুলসের প্রতি হঠাৎ এরকম আগ্রহের কি হেতু, তা ঠিক ধরতে পারলাম না। আজ সন্ধ্যায় অ্যাপল স্টোর থেকে তার কুলবয় হওয়ার জন্য অতি প্রয়োজনীয় বিটস হেডফোনের সম্ভাব্য প্রাপ্তিযোগের আনন্দেই কি তবে তার এই উত্তেজনা? যেমন ওর এই একই বয়সে উত্তেজনায় কোনও কোনও রাতে ঘুম হতো না আমারও, যখন খোঁজ পেতাম কারো কাছে আছে কোনও নতুন দেশের ডাক টিকিট, এবং দ্রুত ঐ টিকিটের কাছে না পৌঁছাতে পারলে হাতছাড়া হয়ে যাবে তা।
নাকি ওর এই উত্তেজনার কারণ হল নুডুলস গরম করার আপাত কোনো সমাধান না থাকার পর আমি যে সমাধান দিলাম সেটি নিজ হাতে প্রয়োগ করতে পারার আনন্দে? ঐ সমাধানটি গতরাতে আমার মুখ থেকে শোনার পর, ও যেরকম আশ্চর্য হয়েছিল, তাতে মনে হচ্ছিল যে বিশাল কিছু একটা বুঝি আবিষ্কার করে ফেলেছে তার পিতা! হতে পারে এর যে কোনোটাই তার এই অতি আগ্রহের কারণ। আবার এও হতে পারে যে ঐ দুটোর সম্মিলনেই অবতারণা হয়েছে ওর ভেতরে এই উত্তেজনার।

‘কি মনু নুডুলস খাচ্ছো? কেমন লাগছে এটা খেতে এখন?’ বাইরে বেরিয়ে পড়ার জন্য মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে চায়ের চামচ দিয়ে হাপুস হুপুস করে দীপ্রকে নুডুলস খেতে দেখে হেলেন জিজ্ঞাসা করতেই ‘ইয়াম্মি’। বলেই আবারো নুডুলসেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো দীপ্র। যদিও বাচ্চাদের মর্জি বোঝাই ভার, তারপরও সাতসকালেই ওর এই আগ্রহ ও উত্তেজনা দেখে ফের বড়ই ভাল লাগল। কারণ মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় এই ডিজিটাল যুগের বাচ্চারা, শিশুকালে আমরা যেমন অতি তুচ্ছ কিছু পেলেও মহা আনন্দিত হতাম, অবাক হতাম সামান্য কারণে ওরা তা হয় না মোটেও।

নিজের ছোটবেলায় সকালবেলা সপ্তাহের ৬ দিনের রুটিন করা রুটির বদলে, রোববারে ডালডা দিয়ে ভাজা আম্মার মচমচে পরোটা পাতে উঠায় যে আনন্দ হতো, সে আনন্দেরই ঝিলিক দেখছি মনে হল পুত্রের চোখে মুখে। শুধু মহার্ঘ পরোটার কথাই কেন বলছি, কোনো দিন রুটিনের বাইরে গিয়ে স্বাস্থ্যগত কারণে আব্বা কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত পান্তাভাত বা অতি কালেভদ্রে বাসিপোলাও বা খিচুড়ি পেলেও তো মহাআনন্দিত হতাম। বহুদিন পর যেন সেই আনন্দেরই ছিটেফোঁটা দেখতে পাচ্ছি এখন এই রুমের ভেতর। আচ্ছা পান্তাভাত বা বাসিপোলাও বা খিচুড়ির মতোই কি উপাদেয় নাকি এই বাসি নুডুলস? চায়নিজরাও কি ঐরকম আনন্দে বাসি নুডুলস খায়, যেমন আনন্দে বাঙালি খায় পান্তা? এ চিন্তার সাথেসাথেই এসময় বাসি খাবার নিয়ে আব্বা যে তুমুল স্বাস্থ্যগত সাবধানতা পালন করতেন তা মনে পড়তেই, পুত্রের স্বাস্থ্য নিয়ে নিজ মনে শংকা উঁকি দিতেই দীপ্র, দীপ্র বাবা, থাক আর খেয়ো না, ঐ বাসি নুডুলস। এমনিতেই সারাদিন আছে আমাদের প্রচুর ঘোরাঘুরি। এ খেয়ে যদি আবার তোমার পেট খারাপ হয়, তাহলে তো হবে মহাঝঞ্ঝাট! হৈ চৈ করে এ কথা বলে উঠতেই খাওয়া থামিয়ে চমকে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ও বলল, ‘এগুলো তো ফ্রিজে ছিল। বাসি হবে কেন? তারপর তো গরমও করেছ। আমি তো প্রায় শেষ করে ফেলেছি। চামচটা ছোট তাই ঝোলটা খেতে পারছি না, তবে নুডুলস তো প্রায় শেষ। খুব তো বেশি ছিল না নুডুলস ঝোলই বেশি ছিল’ আসলেই তো! আজকাল ঘরে ঘরে রিফ্রেজেরাটর ঢুকে যাওয়াতে আমাদের জীবনে আগেকার মতো খাবারের বাসি হয়ে যাওয়ার ফুরসৎ কোথায়? এতো দেখছি টেকনলজির জয়জয়াকারের কারণে আমাদের জীবনাচরণের সংস্কৃতি বদলে যাওয়ার আরেক নমুনা, হয়ে আসছে যা সেই শিল্পবিপ্লবের শুরু থেকেই। আমাদের ভাষা থেকে তো দেখছি এখন এই বাসি শব্দটাই প্রথমে নিজে বাসি হয়ে গিয়ে, পরে এক্কেবারে বাতিল হয়ে যাবার যোগাড় হয়েছে!
খাবারের বাসি হওয়া নিয়ে নিজের এই নতুন অভিজ্ঞান হওয়ার পরও পুত্রের পেট খারাপ হবার আশংকাটা খচ খচ করতেই থাকল। কিন্তু এখন তো আর করার কিছু নাই। ও তো বলছে যে ঝোলই আছে বাকি শুধু। নুডুলস করেছে ও সব হাপুস হুপুস সাবাড়, এরই মধ্যে। ঠিক আছে, তাহলে নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভাল ভেবে, বললাম ঠিক আছে, বাদ দাও। ঝোল আর খেতে হবে না। আর হেলেন ওকে নিয়ে তোরা দুজন আয় ঐ রুমে নাস্তা করতে। এই ফাঁকে আমি শেইভ করে মুখ হাত ধুয়ে রেডি হয়ে নিচ্ছি। বলেই ধরলাম হাঁটা।

ভেবেছিলাম রুমে ফিরেই দখল নেব বাথরুমের, কিন্তু হল না তা, কারণ অভ্র নিয়ে নিয়েছে দখল ওটার। মায়ের তাড়ায় নির্ঘাত ওকে করতে হয়েছে তা। অতএব ফের জানালার দিকে এগুতে গিয়ে দেখি এরই মধ্যে যাকে বলে বাসি বিছানা, সেটিকে একটু ফিটফাট করতে ব্যস্ত লাজু। বিছানার পায়ের দিকটায় ভাঁজ করে রাখা আছে দু পুত্রের জন্য সুটকেস থেকে বের করা ধোপদুরস্ত কাপড় চোপড়, বিশেষত অন্তর্বাস সমূহ ও এখানকার হিমের কথা আন্দাজ করে কেনা, উলেন থার্মাল, ফুলহাতা উলেন সুয়েটার এসব। বোঝা গেল অচিরেই একটা খটমট লাগবে বড় পুত্রের সাথে, কারণ তার ধারনা মতে তো সে বাইরে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত, কিন্তু মা তো তার সে কথা মানবে না। মাতা পুত্রদের এসব ব্যাপারে আমার নাক গলানো উচিৎ হবে না মোটেই, এ সিদ্ধান্ত নিয়ে পর্দা সরিয়ে জানালার কাঁচে ফের নাক ঠেসে ধরে ডানে বায়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরের হাবভাব বুঝতে চেষ্টা করলাম।

নাহ এখনও খোলতাই হয়নি বেইজিঙয়ের মুখ। ভাবছি বৃষ্টি শুরু হয় না তো আবার! তা যদি হয় তবে তো গ্রেটওয়াল ভ্রমণটাই মাটি হয়ে গিয়ে তীরে এসে ডুবে যাবে তরী! মহাচীনের মহাদেয়ালের পাদদেশে পৌঁছে তাতে যদি পা ই না রাখতে পারি, তা হলে তো এ ভ্রমণের ষোল আনাই মিছে হয়ে যাবে। যতোই স্টোন ফরেস্টের মতো আচানক জংগল, তিয়েন আন মেন স্কয়ারের মতো বিখ্যাত জায়গা দেখি না কেন, কিম্বা দেখি না কেন শত হাজার বছরের গল্প চুপচাপ ধারণ করে থাকা চায়নার বিশাল মিউজিয়ম, তার সবই হয়ে যাবে গরল ভেল। মনে মনে তাই বললাম হে বৃষ্টি, বুদ্ধ না কুনফুসিয়াস না খোদ মাওয়ের দোহাই লাগে আজকের দিনে আর মহাদুর্ভোগ হয়ে নেমো না আকাশ ছেড়ে।
‘মা, বাবা, আমি কি একটু ঐ রুমে যেতে পারি’। অভ্রের এই আবেদনে সম্বিৎ ফিরতেই ওর প্রশ্নের জবাবে চোখের ইঙ্গিতে ওর মায়ের দিকে নির্দেশ করে, এগিয়ে গেলাম বাথরুমের দখল নিতে।

দিনের শুরুতেই অফিসে যাওয়ার পথে ঢাকাই জ্যাম পড়ে মেজাজের তিরিক্ষি হয়ে উঠা এড়ানোর জন্য বহুকাল হল সকাল সকাল অফিসে রওয়ানা দেবার অভ্যাস করার সাথে, দ্রুত শেইভ করা ও প্রাতঃক্রিয়াদি সম্পন্ন করার যে অভ্যাস রপ্ত করেছিলাম, সেটির বরাতে খুব দ্রুতই বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি ইতিমধ্যে ওইরুম হাজির হয়েছে এইরুমে। গতরাতে কিনে আনা রেডিমেইড ব্রেকফাস্ট তো আগেই রেডি করা ছিল টেবিলে। কিন্তু কেউই ওসবের সদ্ব্যবহার করছে না। সোফায় বসে বরং দুপুত্র নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত ফিসফাস কোনো গোপন আলাপে! হেলেন আর লাজুর দৃষ্টি ঠায় নিবদ্ধ টিভির পর্দায়, যদিও জানি না এরই মধ্যে চায়নিজ ভাষা কতোটুকু আয়ত্ত করেছে ওরা। কেন তাদের এই গভীর মনোযোগ টিভির পর্দায় এই সকালে!

বাজে ক’টা এখন? এই চল চল নাস্তা করে নেই সবাই। সাড়ে আটটার দিকে আমাদের গাড়ি চলে আসবে কিন্তু। এর মধ্যে নাস্তা শেষ করার পর বাথরুমে হাজিরা দেবার দরকার পড়লে সেটাও সেরে নিতে হবে। সারাদিন পথে পথে ঘুরবো তো, জানি না তো এখানকার পাবলিক টয়লেটগুলোর কী অবস্থা বলে তাড়া দিতেই ‘আমার খাওয়া লাগবে না। আমি তো খেয়ে ফেলেছি’। দীপ্র জানাতেই ‘না না তা হবে না। ঐ নুডুলস তো খুব একটা বেশি ছিল না। শুধুই ঝোলেই ভর্তি ছিল তা। নাও, নাও এই রুটি আর কলাটা খাও’।

বলেছি না, আগেই ঠিক করেছিলাম যে মাতাপুত্রের কুরুক্ষেত্র বিষয়ক ব্যাপারে নাক গলাব না এই সকালে। সেই সূত্র মেনে এই মুহূর্তের এই বিতর্ক বিসম্বাদের ব্যাপারে এক্কেবারে স্পিক্টি নট হয়ে, কলা সহযোগে কমলার জেলির পুর দেয়া বনরুটি চিবুতে চিবুতে, ভাবনা এলো, নাহ অন্যবেলার খাবার যখন যাই খেয়ে থাকি না কেন, প্রতিদিনের সকালের এই নাস্তাটা যুৎ হচ্ছে না। ‘আচ্ছা বাবা, আমরা কি একদিন এই হোটেলের বুফেতে ব্রেকফাস্ট করতে পারি’? নিজের উপরোক্ত চিন্তার পিঠাপিঠি ছোটপুত্রের এই আবদার কানে যেতেই ভাবলাম, আরে এ তো দেখছি পিতাপুত্রের দারুণ টেলিপ্যাথি
সাথে সাথেই তাই মহানন্দে ঘোষণা দিলাম, ঠিক আছে। হবে আগামীকাল তা।
লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপৃথিবীর সব মা’কে সালাম
পরবর্তী নিবন্ধপঠন দক্ষতা ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষা