ভূগোলের গোল

ডাঃ কিউ এম অহিদুল আলম | মঙ্গলবার , ৮ নভেম্বর, ২০২২ at ৯:৪৯ পূর্বাহ্ণ

ধেয়ে আসছে মন্দা বিশ্বব্যাপী

বাংলাদেশের মানুষ মোকাবেলা করেনি হেন কোন প্রাকৃতিক বা অর্থনৈতিক দুর্যোগ নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে গর্কি, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি। অর্থনৈতিক দুর্যোগ বলতে হয় বিশ্বযুদ্ধের পর রেশনিং প্রথা যে চালু হয়েছিল তার চাউল, আটা খেয়েছে এদেশের বেশীরভাগ মানুষ। নতুন প্রজন্ম দেখেছে উত্তর বঙ্গের মংগা। এখন সব শ্রেণির মানুষের দিকে ধেয়ে আসছে ‘মন্দা’। মন্দার পদধ্বনি বিশ্বব্যাপী।

মন্দাকে ইংরাজীতে Recession বলে। অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা বা দুর্ব্যবস্থাপনার কারণে বিচ্ছিন্নভাবে কোন দেশ মন্দার কবলে পড়তে পারে। সময় অতিক্রান্ত হলে আবার সেদেশে অর্থনীতির সুবাতাস আসতেও পারে। কিন্তু দুই বৎসরের করোনা সংক্রমণ এবং তার পরবর্তী রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ গোটা পৃথিবীকে এক দুঃসময়ের অর্থনীতির কবলে ফেলে দিয়েছে। মন্দার গূঢ় চরিত্র বিশ্লেষণ করবে অর্থনীতিবিদরা। আমাদের জন্য দেশের মোট আয় সংকুচিত হয়ে আম জনতার ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়াকেই মন্দা বলা হয়।

দেশে মন্দা আছে কিনা জানতে কয়েকটা ম্যাক্রোইনমিক সূচকের দিকে তাকাতে হবে। (১) শিল্প উৎপাদন কেমন? (২) স্থানীয় বাণিজ্য ও আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য কেমন হচ্ছে (৩) মূলধন প্রবাহ (flow) কেমন? (৪) জ্বালানী খরচ কেমন? ৫) বেকারত্বের অবস্থা (৬)বিনিয়োগের অবস্থা (৭) গড় পড়তা Consumption দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১ এবং ২০০৯ সালে বিশ্বের অনেক দেশে উপরোক্ত সূচকগুলোর নিরীখে মন্দা ছিল বলে ধরা হয়। আমরা এবং গোটা বিশ্ব কি এখন মন্দা বা রিচেশনে এ আছি? ২৮ শে সেপ্টেম্বর ২০২২ জেনেভায় ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম এর ১০ অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ৭ জনেরই বক্তব্য হচ্ছে ২০২২ সালের বাকী সময় থেকে পুরো ২০২৩ সালেও বিশ্বের বহুদেশে মন্দা অর্থনীতি বিরাজ করবে। বক্তব্য দান সময়কালে বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে ৫৪টি দেশে মন্দা চলছে।

তুর্কী বংশোদ্ভুত মার্কিন অর্থনীতিবিদ রৌবিনী S&P ৫০০ সূচক ব্যবহার করে বলেছেন যে ভারতে ২০২৩ সালে মন্দা চলবে, প্রশ্ন হচ্ছে ভারত এখনো ভাল প্রবৃদ্ধির দেশ। কিন্তু মন্দা হবে কীভাবে? প্রবৃদ্ধির হিসাব অর্থনীতিবিদদের কাছে এখন গুরুত্বহীন। ভারতেরই অর্থনীতিবিদ কুনাল কুন্ড কেজা ভারতে মন্দা হবে তা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে। প্রবৃদ্ধি বেশী থাকলেও ভোক্তার চাহিদা কম কারণ real wage (প্রকৃত বেতন/ আয়) রেকর্ড সর্বনিম্ন। চাহিদা কমে যাওয়ায় উৎপাদনও কমে যাবে। উৎপাদন কমে গেলে বেকারত্ব বাড়বে। অর্থাৎ এটা একটা অশুভ বৃত্ত। জে পি মর্গান্ত গোল্ডম্যান স্যাখ প্রভৃতি অর্থনীতি সমীক্ষার প্রতিষ্ঠান এর মতে পুরা ইউরোপ ইতিমধ্যেই মন্দার কবলে পড়ে গেছে। চীন এর প্রবৃদ্ধি ২০২১ সালের ৮.১% থেকে কমে ৩.২% এ চলে এসেছে।

১৯৮১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান মূল্যস্ফীতি সম্বন্ধে দারুণ এক উক্তি করেছেন। রিগান বলেছেন- মূল্যস্ফীতি ছিনতাই এর মত হিংস্র, সশস্ত্র ডাকাতের মত ভয়ংকর, খুনীর মত আত্মঘাতী। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি আম জনতার সহসীমার বাইরে চলে গেছে। মিশরের রাজধানী কায়রোতে ২০০৯ সালের খাদ্য সংকটের সময় রুটি কিনতে ঠেলাঠেলিতে মানুষ মারা গিয়েছিল-সেই দৃশ্য আমাদের স্মৃতি দেখে এখনো যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তন, ইউক্রেন যুদ্ধ খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ দুটোতেই বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। তাই বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট ২০০৯ সাল থেকেও তীব্র হতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট বোঝার উপায় দুইটা। প্রথমটা হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের বুঝার অর্থনীতি। এটা বুঝতে হলে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আনু মুহান্দ, এম আকাশ প্রমুখ ঢাকার অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন পড়া ও শোনা প্রয়োজন। এটা পত্র পত্রিকা পাঠ করলে বোঝা যায় আরেকটা হচ্ছে আমজনতার পকেটের অর্থনীতি। এটা বোঝার উপায় হল গ্রাম বাংলার হাটবাজার আর মসজিদ, মন্দিরের দান-বাক্স। গ্রামের হাটবাজারে অধিকাংশ ক্রেতাই হিসেব করে চলেছে। এক কেজির স্থলে ৮০০ গ্রাম, আধা কেজির স্থলে ৪০০ গ্রাম কিনছে।

দেশের অর্থনীতি বুঝতে মসজিদের দান বাক্সের অবস্থা আমি প্রথম বুঝতে পারি ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময়। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতি স্থানভেদে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া বা দক্ষিণ আফ্রিকা নির্ভর। আমার এলাকা মধ্যপ্রাচ্য নির্ভর অর্থনীতি। গত দুই বছর মসজিদের দান-বাক্সের অবস্থা ভাল নয়। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের থেকে আসা অর্থে সংকট হচ্ছে। এই অর্থ প্রবাহের উপর গ্রামের শিক্ষা, ক্ষুদ্র শিল্প, রাজমিস্ত্রী, ফার্নিচার মিস্ত্রি, লোহার ওয়ার্কশপ, চা দোকান সব কিছু নির্ভর করে।
এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির তাত্ত্বিক দিকটা দেখা যাক। সরকার একদিকে প্রণোদনা দিয়েছে বিশাল অংকের, আবার বিনিয়োগকারীরা কম সুদে ঋণও নিয়েছে। এসব ঋণের বড় অংশ উৎপাদনে বিনিয়োগ না হয়ে খেলাপী ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে। ফলে বিনিয়োগের স্থবিরতায় কর্মসৃষ্টি পর্যাপ্ত হয়নি। বিপুল শিক্ষিত বেকার মন্দার দুর্ভাগ্যজনক উৎপাদন। শিল্প থেকে রাজস্ব না বাড়ায় সরকার রাজস্বনীতির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এ কারণে আবার আমদানী নিয়ন্ত্রণ, সাশ্রয়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করায় অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে। প্রবাসী আয় নির্ভর অর্থনীতি হওয়ায় রিজার্ভেও চাপ আসে। সরকার আইএমএফ থেকে ঋণ চাইলে ওরা যদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ভর্তুকী কমানোর শর্ত দেয় এবং জ্বালানীর মূল্য বেড়ে যায় তবে জীবনযাত্রার মান ও ক্রয় ক্ষমতা সংকটে পড়বে। আর্থিক খাতে সংস্কার যদি আম-জনতার স্বার্থের দিকে চেয়ে হয় তবে প্রভাবশালী মহলের স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে। শুধু নীতি নির্ধারকদের পরামর্শ দিয়ে এই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা কঠিন হবে। অর্থনীতিবিদ রাজনীতিবিদ ও গ্রাম-বাংলার ভোক্তাদের সম্মিলিত সম্পৃক্ততাই অর্থনীতিকে মন্দা থেকে রেহাই করতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট, চিকিৎসক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুরের আকাশে শুকতারা
পরবর্তী নিবন্ধখেরসনে চূড়ান্ত লড়াইয়ের আগে রাশিয়া লুটপাট চালাচ্ছে: ইউক্রেন