জীবনভেলা

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ৭ নভেম্বর, ২০২২ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

জাহাজে ইমার্জেন্সির জন্য লাইফবোট থাকে, এছাড়াও লাইফর‌্যাফট, লাইফবয়, লাইফজ্যাকেটও থাকে। আসলে, জাহাজের প্রায় সকল ইমার্জেন্সিতেই প্রথমেই আমরা লাইফজ্যাকেটটা পড়ে নেই; তারপরে ইমার্জেন্সী অনুযায়ী আমাদের যার যার নির্ধারিত ইমার্জেন্সি-স্টেশানের দিকে দৌড়ে যাই। প্রত্যেকের কেবিনেই লাইফজ্যাকেট থাকে। আরো অনেকগুলো থাকে জাহাজের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়-ইঞ্জিনরুমে, ব্রিজে। যেসমস্ত জায়গায় আমরা অবসর সময় কাটাই- মেসরুম, আড্ডা মারার কমনরুম (বা জাহাজী ভাষায়-স্মোকরুম)। কারণ ইমার্জেন্সি তো আর বলে কয়ে আসবে না; অথবা টাইম-শিডিউল দিয়ে আসবে না। কখন কোনদিক দিয়ে কীভাবে আসে কেউই জানে না। খাওয়ার সময়েও হতে পারে, বা ঘুমানোর সময়ে অথবা ডিউটির সময়ে। তাই সবক্ষেত্রেই রেডি থাকতে হবে।

জাহাজে লাইফবোট আর লাইফর‌্যাফট থাকে বাইরের খোলা ডেকে। ভিতরে রাখলে তো চলবে না। লাইফবোট অনেক ভারী আর বড়সড়; সেটাকে বেঁধেছেদে রাখা হয়। কিন্তু লাইফর‌্যাফট তো হাল্কা-পাতলা, সেগুলো তো ঝড়-বাতাসে সহজেই উড়ে যাবে। সেজন্য সেগুলোও বাঁধা থাকে। আসলে লাইফর‌্যাফট অনেকটা চুপসানো, ভাঁজ করা বেলুনের মত। সুন্দর করে ভাঁজ করে করে ক্যাপসুলের মত দুইটা শক্ত ফাইবারগ্লাসের খোলের মধ্যে ভরা থাকে। তারপর, সেটাকে স্ট্র্যাপ দিয়ে ডেকে বাঁধা থাকে। যখন প্রয়োজন পড়ে, তখন স্ট্র্যাপ থেকে খুলে পানিতে ছুড়ে মারা হয়। একটা দড়ি সেখান থেকে বের হয়ে থাকে। পানিতে পড়ার পরে, সেই দড়িটাকে একটা হ্যাঁচকা টান দিলে খোলস দুইটা খুলে যায়, আর ভিতরের দুইটা গ্যাস-সিলিন্ডার অটোমেটিক্যালি খুলে গিয়ে বেলুনের মত লাইফর‌্যাফটকে ফুলিয়ে দেয়। এখানে আরো একটা অটোমেটিক ব্যাপার আছে বলি-মনে করুন, খুবই দ্রুত জাহাজ ডুবে গেছে, কেউই লাইফর‌্যাফট ছুড়তে পারে নাই। সকলেই প্রাণ বাঁচাতে তাড়াহুড়া করেই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছে। এখন জাহাজ যত পানির গভীরে ডুবতে থাকবে পানির প্রেশার ততই বাড়তে থাকবে, সেই উচ্চচাপকে কাজে লাগিয়ে লাইফর‌্যাফট রিলিজ করা হয়। লাইফর‌্যাফট যেই স্ট্র্যাপ দিয়ে জাহাজের সঙ্গে লাগানো থাকে, সেখানে একটা চেইনের লিঙ্ক থাকে (বলা হয় weak-link)। সেই লিঙ্কটা পানির ভিতরে একটা নির্দিষ্ট প্রেশারে এসে পানির চাপে নিজের থেকেই ভেঙ্গে যাবে; এবং লাইফর‌্যাফটটা অটোমেটিক্যালি রিলিজ হয়ে ভুশ্‌শ্‌ করে ভেসে উঠবে (hydrostatic pressure)। মানুষ লাইফর‌্যাফট ছুড়ে যেই হ্যাঁচকা টান দেয়; সেই কাজটা গভীর পানির হাইড্রোস্ট্যাটিক প্রেসারই করে দিবে। এর ফলে, যারা কোনো কিছু ছাড়াই পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলো, তারা লাইফর‌্যাফটটা পেয়ে যাবে জীবন বাঁচানোর জন্য।

লাইফবোটে ইঞ্জিন থাকে, কিন্তু লাইফর‌্যাফটে কোনো ইঞ্জিন থাকে না। এটা ভেসে থাকে আর একে বৈঠা দিয়ে চালাতে হয়। SOLAS-এর লিস্ট ধরে প্রয়োজনীয় যা কিছু ইমার্জেন্সিতে লাগতে পারে তার সাপ্লাই লাইফর‌্যাফটেও থাকে- বৈঠা, কম্পাস, খাওয়ার-পানি, শুকনা টিনের খাওয়ার (প্রটিন-বিস্কিট), ফার্স্ট-এইড বক্স, লাল/কমলা রঙের স্মোক-ফ্লেয়ার, প্যারাস্যুট-ফ্লেয়ার, পাইরোটেকনিক-ফায়ারওয়ার্ক্সের মতই আতসবাজি, টর্চ-লাইট, আয়না (সূর্যের আলো দিয়ে সিগ্ন্যাল দেওয়ার জন্যে), হুইস্যল। এগুলো দিয়ে উদ্ধারকারী জাহাজ বা প্লেন বা হেলিকপ্টারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। আর থাকে মাছ-ধরার যন্ত্রপাতি, বৃষ্টির পানি ধরার ব্যবস্থা, পানি সেচ করার সিস্টেম ইত্যাদি প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই।

ছাদওয়ালা লাইফর‌্যাফটের ছাদে এমন করে একটা সিস্টেম করে দিয়েছে যে, বৃষ্টির পানি সেখানে জমা হবে; এরপরে একটা নলের সাহায্যে ভিতর থেকে সেটা বোতলে ভরে নেওয়া যাবে। মানুষ খাওয়ার ছাড়া বেশ কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারবে; কিন্তু পানি ছাড়া বাঁচবে কম। পানির অভাবে খুব শীঘ্রই মানুষ মারা যায়। আর সেই সময়ে (বা আসলে যে কোন সময়ই) সমুদ্রের লোনা পানি খাওয়া উচিত না। এতে উল্টা ক্ষতিই বেশী হবে। আমরা প্রায় সকলেই স্যামুয়েল কোলরিজের সেই বিখ্যাত কবিতা ‘দা রাইম অফ দা এনশিয়েন্ট মেরিনার’-এর সেই কয়েকটা লাইন খুবই শুনি- ‘water, water, everywhere, nor a drop to drink’। এই কথাগুলোর গুরুত্ব যে কতটুকু, সেটা সমুদ্রের মাঝে বিপদে পড়লেই টের পাওয়া যায়। অনেক অনেক মানুষ, লবনাক্ত পানি খেয়ে শরীরে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে মারা গিয়েছে। অবশ্য লোনা পানির একটা উপকারিতাকে কাজে লাগানো হয়ে থাকে এই সমস্ত ক্ষেত্রে। অনেক লাইফর‌্যাফটে/জ্যাকেটে ছোট্ট একটা লাইট লাগানো থাকে, যেইটা লোনা পানির সংস্পর্শে আসলেই জ্বলে উঠবে। তাহলে উদ্ধারকারীদের পক্ষে দূর থেকে দেখতে হয়তো সহজ হতেও পারে।

আর একটা ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়- Hypothermia; সমুদ্রে প্রায় সব জায়গাতেই পানির তাপমাত্রা বেশ ঠান্ডা। বেশীক্ষণ পানিতে থাকলে শরীরের তাপমাত্রা কমে গিয়ে সবকিছু অচল হয়ে মৃত্যু হতে পারে। সেজন্যে, লাইফবোটে এবং লাইফর‌্যাফটে ইমার্জেন্সিতে যাওয়ার সময়ে যতটুকু সম্ভব গরম কাপড় গায়ে চড়ানো যায়, ততই ভালো।

লাইফবোটের সাপ্লাই নিয়মিত চেক করি আমরা মেরিনাররাই, জাহাজের উপরে। কিন্তু লাইফর‌্যাফটের ব্যাপারে কিছুই করা যাবে না। এগুলো ফাইবারগ্লাস খোলসের মাঝে থাকে, আর সেই খোলস খুললেই গ্যাস সিলিন্ডারের অটোম্যাটিক বেলুন (বা লাইফর‌্যাফট) ফুলানো শুরু হয়ে যাবে। একবার তা হলে, জাহাজে বসে সেটাকে আবার খোলসে ভরা যাবে না। তাই কয়েক বছর পরপর পুরা জিনিসটাকেই অরিজিন্যাল ম্যানুফ্যাকচারার কাছে পাঠিয়ে নতুন করিয়ে আনা হয়। জাহাজের ডেকে কখনোই লাইফর‌্যাফট খুলা (inflate) যাবে না।

লাইফবোট/র‌্যাফট-এর সাপ্লাইয়ের কথা উঠলেই আমার মনে একটা খুবই হাসির ঘটনা মনে পড়ে। মেরিন একাডেমীতে আমাদের ট্রেনিং-এর সময়ে আমরা লাইফবোট ও র‌্যাফট নিয়ে অনেক প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাস করেছিলাম। কীভাবে পানিতে নামাতে হবে, কীভাবে দড়ি-কাছি ছেড়ে দিতে হবে, পানি থেকে লাইফর‌্যাফটে উঠা, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তারই অংশ হিসাবে লাইফবোটের সব সাপ্লাই দেখানো হলো। ক্লাসের কয়েকজনের দৃষ্টি পড়লো ফুড-রেশনের উপরে- বিদেশী প্রোটিন বিস্কিট, আর শুকনা প্রোটিন-বার ইত্যাদি। কয়েকজন মিলে বেশ কয়েকটা টিন গায়েব করে, ক্লাসের শেষে সেগুলো অল্প-স্বল্প টেস্ট করে দেখলো। খুব বেশী যে মজার তা না; কিন্তু নিয়ম ভেঙ্গে একটা কিছু করা গেছে, তাতেই তারা খুশী। তার থেকেও চরম হলো তাদের মধ্যে একজন লোভ সামলাতে না পেরে, স্বাদ লাগুক না লাগুক বাকি সবগুলো টিন একাই খালি করে ফেললো। আর এরপরের দুইদিন সেই বেচারাকে খালি ঘন ঘন বাথরুমের দিকেই দৌড় দিতে হচ্ছিলো। একবারে অতগুলো প্রোটিন-বার বিস্কিট সেই বেচারার পেট আর সহ্য করতে পারে নাই। তবে একটা কথা মনে রাখবেন, ইমার্জেন্সির সময়ে নিশ্চয়ই কেউই অত গোগ্রাসে সবকিছু খাবে না। কিন্তু তার থেকেও জরুরী হলো লাইফবোট বা র‌্যাফটে বাথরুম নাই। সবকিছু উন্মুক্ত সেখানে। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করুন- কাউকেই যেন কখনই সত্যিসত্যি ইমার্জেন্সির কারণে লাইফবোটে বা লাইফর‌্যাফটে যেতে না হয়। যদি যেতে হয়, তার মানে নিশ্চয়ই তার চরম বিপদ। আল্লাহ্‌ যেন সবাইকে হেফাজত করেন।

টলিডো, ওহাইও, ২০২২
refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেয়েটি প্রযোজনাসূত্রে দু’একটি কথা
পরবর্তী নিবন্ধমোপলেস চট্টগ্রামের আলোচনা সভা