কল্যাণ মৈত্র স্মারক বক্তৃতামালার প্রথমটিতে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। যেমন-
১. ‘…থিয়েটার কি কেবলই বিভিন্ন চরিত্রের প্রকাশে নিয়োজিত কিছু অভিনেতার প্রদর্শভূমি?’
২. ‘…অথচ আমার সাহিত্যপাঠে আমি আবিষ্কার করেছি থিয়েটারের আরেকটি রূপ- তখনও যা আমি প্রত্যক্ষ করিনি, অথচ সম্ভাবনা বলে ভাবতেই পারি। থিয়েটারের সেই ‘সম্ভাব্য’ রূপের বীজস্বরূপ নিহিত থাকে একটা সুলিখিত নাটক, বা একটা ধারণা, ভাবনা বা কল্পনা যার রূপায়ণ ঘটবে ঘাতপ্রতিঘাতময় নাটকীয় কোনো উত্তরণে।’
৩. ‘…থিয়েটার কী? অভিনয়পটুতার গণতান্ত্রিক পরীক্ষাগার, না কি একটা পরিপূর্ণ শিল্পরূপ তথা শিল্পভাষা যা নানা স্তরে দর্শককে প্রাণিত করবে, ভাবিত করবে,মুগ্ধ করবে?’
এই প্রশ্নমালা মনে পড়েছিলো, গত ষোলো অক্টোবর চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে, নতুন নাট্যদল নাট্যহিত-এর প্রথম প্রযোজনা ‘মেয়েটি’ দেখতে গিয়ে। কিছু ‘হোমওয়ার্ক’ করে নিয়েছিলাম। যেমন- জেনে নিয়েছিলাম এরিয়েল ডর্ফম্যানের ‘ডেথ এন্ড দ্য মেইডেন’-এর কাহিনি নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত পোলিশ পরিচালক নির্মাণ করেছিলেন একই নামের অসহ উদ্বেগভরা চিত্রনাট্যের এক চলচ্চিত্র যাতে অপরাধীকে নিজের ঘৃণ্য অপরাধের অভিঘাত বিষয়ে সচেতন করিয়ে মুক্তি দেয়া হয়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, অপরাধী চরিত্রে বেন কিংসলে সপরিবারের ধ্রুপদী বাদন উপভোগ করছেন বিশেষ আসনে বসে আর পলিনা তার নিশ্চিতি দেখে নিরবে স্বামীর পাশে বসে, মেয়েটির অস্তিত্ব জুড়ে ফুটে ওঠে ঘৃণা। এখানেই পোলানস্কি নির্দেশিত চলচ্চিত্রের সমাপ্তি ঘটে।
কাবেরী বসু এরিয়েল ডর্ফম্যানের রচনা অনুবাদের শিরোনাম দিয়েছেন- ‘মেয়েটি’, নাট্যপ্রযোজনা একমাত্র নারী চরিত্রটিকে কেন্দ্র করেই ঘটে। পরপর দুটো দিন দ’ুজন অভিনেত্রী চট্টগ্রামের মঞ্চে পাওলিনা লোরকা হয়ে ওঠেন। গল্পটা সংক্ষেপে বলে নিলে পাঠকদের সুবিধে হবে। ফ্যাসিবাদী স্বৈরতান্ত্রিক সময় গেছে দক্ষিণ আমেরিকার কোনো এক দেশে। সে অন্ধকার সময়ে অসংখ্য নারী নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন, অগণিত মানুষ গুম হয়ে গিয়েছিলেন। এইরকম অসময়ে যা ঘটে থাকে। এক ঝড়ের রাতে এমন এক নির্যাতিত নারী হাতের নাগালে নির্যাতনকারীকে পেয়েছেন। মানুষটির ঘ্রাণে, কথার মধ্যকার দু’একটি বাক্যবন্ধের ক্রমাগত ব্যবহারে, নিৎসের উদ্ধৃতিপ্রেমের নিদর্শন এবং বিশ্ববিশ্রুত সুরস্রষ্টা ফ্রাঞ্জ শ্যুবার্ট রচিত সুর ‘ডেথ এন্ড দ্য মেইডেন’ -এর অডিও ক্যাসেট যখন লোকটির গাড়ির মধ্যে পাওয়া গেল- এইসব জিনিস দেখেই বোঝা গেল, লোকটিকে চিহ্নিত করা গেল এবং চিহ্নিত করবার পরে যে ব্যাপারটা দাঁড়ালো সেটা হল পলিনা কেবলমাত্র স্বীকারোক্তি চায় লোকটির অপরাধের। কিন্তু এত সহজে সে ভেঙ্গে পড়ার নয় এবং যেহেতু সহজে ভেঙে পড়ার নয় সেই জন্যেই পলিনা হিংসার আশ্রয় নেয়। পলিনা লোকটির উপর নানারকম মানসিক এবং শারীরিক আঘাত করে।
আমরা এক দিক থেকে ভেবে দেখতে পারি, একজন অপরাধীকে আমরা এমনভাবে নির্যাতন করতে পারি কিনা- আইন হাতে তুলে নিতে পারি কিনা এবং সবচেয়ে বড় কথা আইন হাতে তুলে নিলে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয় কিনা। আরেকদিক থেকে যদি আপনি ভাবেন তাহলে দেখতে পাবেন যে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল তারা কিন্তু এত কিছু ভাবেনি তারা বয়স বা লিঙ্গগত কারণে কাউকে ছাড় দেয়নি এবং কাউকে ছাড় না দিয়ে তারা নির্যাতনের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়েছে। একমাত্র এই কারণেই আইন হাতে তুলে নেয়া কিংবা অপরাধীকে বাগে পেলে শাস্তি দেয়াটা সমর্থনযোগ্য। ‘ডেথ এন্ড দ্যা মেইডেন’ নাটকে পলিনা ঠিক এ কাজটি করেছেন।
সিনেমার সাথে মঞ্চ নাটকের একটি প্রধান পার্থক্য হল, মঞ্চনাটক আমাদের কল্পনা শক্তির বিকাশ ঘটায় আর চলচ্চিত্র পরিচালক পুরো নাটকটি, পুরো চিত্রনাট্যটি চোখের সামনে দেখিয়ে দেন আমাদের কল্পনাশক্তির উপর হস্তক্ষেপ করে। একটি চিত্রনাট্য পাঠ করলে আমাদের মনের মধ্যে যে ছবি ফুটে ওঠে সেই ছবিটি মঞ্চনাটক নানাভাবে সম্প্রসারিত করতে পারে কিন্তু চলচ্চিত্রে সেটা সম্ভব হয় না, মাধ্যমগত ফারাকের কারণেই।
পৃথিবীর দেশে দেশে নানা সময়ে নারী নির্যাতন ঘটেছে, এরিয়েল ডর্ফম্যানের কাহিনি অবলম্বনে, নাট্যহিত শীর্ষক নবনাট্যদলের এই প্রযোজনা ‘মেয়েটি’, যা কিনা শনিবারের আড্ডা থেকে সমমনাদের তৎপরতায় প্রযোজিত হয়েছে, চিরপ্রাসঙ্গিক থাকবে, অন্তত যতদিন পৃথিবীতে নারী নির্যাতন, নারীর অবরুদ্ধকরণ জারি থাকবে ততদিন তো বটেই। প্রথমদিন পনেরোই অক্টোবর সুঅভিনেত্রী রিনি রায়ের পাওলিনা এস্কোবার আমি দেখার সুযোগ পাইনি। আমি দেখলাম, কবি অনুবাদক ফারহানা আনন্দময়ীর পাওলিনা এস্কোবারকে, পরদিন। মনে হচ্ছিলো, পাওলিনার নামের আড়ালে পৃথিবীর আদি থেকে ঘটা সকল নির্যাতন একটি শরীরে এসে মিলেছে। তীব্র ব্যথা, প্রবল রাগের যে সংগত প্রকাশ নাট্যাভিনয়ে তা স্মরণের অন্তর্গত করে রাখবার মতোই ঘটনা। জেরার্ডো এস্কোবার চরিত্রে দীপংকর দস্তিদার আমাদের আশাহত করেননি। বেশ কিছুদিন পর মঞ্চে উঠেই তিনি প্রমাণ করেছেন, অভিনয় তাঁর রক্তে।
বাংলাদেশে সমকালে যারা মঞ্চে অভিনয় করেন তাঁদের মধ্যে সুমন টিংকু এক অগ্রগামী নাম। নামের প্রতি সুবিচার করেছেন বিশেষ করে ধরা পড়ে যাওয়ার পর আত্মস্বীকারোক্তির অংশটিতে, তখন চোখ ফেরানো যাচ্ছিলো না। দেবাশীষ রায়ের আবহ, সুকান্ত চৌধুরীর মঞ্চভাবনা বিশেষ মনোযোগী করে তুলেছিলো দর্শকদের। শুরুতে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কয়েকটি প্রশ্ন উদ্ধৃত করেছিলাম। এবার যুক্ত করি, ঠিকঠাক নাট্যরচনা ও সমমনাদের সমবায় ঘটলে থিয়েটার কেবলমাত্র অভিনেতাদের ‘প্রদর্শভূমি’ নয় বরং নবতর শিল্পভাষা তৈরির প্রয়াস, তার চেয়ে বড় কথা, সময়ের দলিল, চিরকালীন এক পরিস্থিতিকে সমকালের ফ্রেমে স্মরণীয় করে রাখা।
অসীম দাশ আমাদের ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ নাট্যচিন্তক, নির্দেশক। আমরা তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম। শেষ করার আগে বলি, ডেথ এন্ড দ্য মেইডেন শ্যুবার্ট নির্মাণ এক গহন বিমর্ষতার কালে, যখন সর্বত্র ব্যর্থতা আঁকড়ে ধরছিলো তাঁকে। মঞ্চ প্রযোজনায় এই সুর ফিরে ফিরে এসে নাটকের সমকালীনতার সাথে চিরকালীন এক সংযোগ তৈরি করেছে বলে আমার মনে হয়েছে।