মানুষরূপী পশুর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কখন হবে!

ড. আনোয়ারা আলম | সোমবার , ৭ নভেম্বর, ২০২২ at ১০:২১ পূর্বাহ্ণ

কোভিড -১৯ বা করোনা নামক মহামারী যখন চীনের উহানে তার ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যে পা রেখেছে, তখন আমরা কিন্তু জীবনের উৎসবে। অবশেষে আট মার্চ, ২০২০ তিনি ঢুকে গেলেন বিশ্বায়নের হাত ধরে আর আঠারো মার্চ, প্রথম মৃত্যু! এরপরে লকডাউনে ঘরে বসে আমরা অনুভব করছি তার তাণ্ডব। মৃত্যুর মিছিলে আমাদের কতো কতো প্রিয়জন! চিকিৎসা শুরুর আগে ছোট ভাই বলেছিল, বেশি ভয় লাগলে আমার বাসায় চলে এসো। হায়! কে জানতো! কে জানতো! ওর ওপর নজর পড়েছে করোনার। চিরতরে বিদায়!

এরপর থেকে অনেক অনেক প্রিয়জন। তবে মানুষের নিষ্ঠুরতাও দেখলাম। আপনজনের মৃতদেহ ফেলে চলে যাওয়া বা জঙ্গলে ফেলে দেওয়া। যদিও ঐ সময়ে অনেক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলো। নিজেদের দায়িত্বে শুধু সৎকার নয়, নানাভাবে সাহায্যে এগিয়ে এলো। প্রমাণ করেছে ‘মানুষ মানুষের জন্য’।
কেমন ছিলেন নারীরা এই মহামারীতে। আমরা জানি যে কোনো দুর্যোগ বা যুদ্ধ বা মহামারীর প্রথম ধাক্কা নারীকে বহন করতে হয়। এসময়ে চাকরি গেছে অনেকের। এক গবেষণা বলছে প্রাতিষ্ঠানিক খাতে ৮১ শতাংশ এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে ২৪ শতাংশ নারীদের কাজের সুযোগ কমে যায়। নারী ও কিশোরী স্বাস্থ্য সেবায় জনবল কমেছে, সেবা সামগ্রী সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। সেবা ব্যবহারের সুযোগ কমেছে। আর বেড়েছে পারিবারিক সহিংসতা।

করোনায় সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সাথে বেড়েছে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা। বিশেষত নারী ও পুরুষের। কেমন এক যান্ত্রিক সম্পর্কে বিচ্ছিন্নতা বেড়ে গিয়ে একটা ধস নামলো পারিবারিক বন্ধনে। নারী নিজের অভ্যাসে ঘর বাহির সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে হয়ে গেলো শুধু কন্যা জায়া জননী। এরপরেও কি তাদের জীবন নিরাপদ ছিল! বরং বেড়ে গেলো পারিবারিক সহিংসতা বা নির্যাতন, তার জীবনে কেবলই এক অনিশ্চয়তার শঙ্কা।

আমরা একই সাথে দেখেছি লকডাউনের মধ্যেই পোশাক শিল্পের নারী কর্মীদের প্রতি কী এক প্রহসনমূলক আচরণ। একবার প্রতিষ্ঠান খোলা, একবার বন্ধ যেন চোর পুলিশ খেলার মতো। আহা! তখনই বুঝতে পারলাম ‘দারিদ্র্য কাউকে মহান করোনা ভিক্ষুক বানিয়ে দেয়।

কতোজন নারী জীবন সঙ্গী বা প্রিয়জনকে হারিয়েছে! গবেষণা বা পরিসংখ্যান আছে কি! আমার চারপাশে বা কাছে দূরে কেবল নেই –নেই! নারী নিঃসঙ্গ, নারীর জীবনের একাকীত্বের আহাজারি।

মূখ্যত পরিবারে করোনা আক্রান্তের সেবাদান কারীও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী! নিজের দিকে তাকানোর অবকাশ নেই। অতঃপর চিরবিদায়ের পথে। তার চিকিৎসা তেমনভাবে হয়নি। আমার আপন ছোট খালাও হার্ট এ্যাটাকে হঠাৎ চলে গেলেও এর কারণ ছিল করোনা।

গত কয়েকদিন আগে শুনি মাত্র পঁয়ত্রিশ বছরের নারী নিজের শাশুড়িকে নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলেন! নিজের অসুস্থতাকে আমল দেননি। পরে দেখা গেল ফুসফুসের ৬০% আক্রান্ত এবং চলে গেলেন! কী অপার বেদনা!

করোনাকালে ও নারীরা নানাভাবে ধর্ষণের শিকারে যেমন তেমনি আত্মহত্যাও করেছেন। একই সাথে সাইবার বুলিংসহ আরও কতোভাবে। কারণ নারী যুগে যুগে কেবলই পণ্য হিসেবে পরিগণিত হয়েছে যদিও সভ্যতার ধারক ও বাহক সূচনা লগ্নে নারীই। নারীদের শুধু এই করোনার কারণে শিক্ষা থেকে নিয়ে এনে বসিয়ে দিয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। অর্থাৎ বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে।

তবে–‘হাল ছেড়ো না নারী’। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য নারী লড়েছেন। নিজের সৃজনশীল ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ‘অন লাইন’। ব্যবসা যা এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। নারী চিকিৎসক বা সেবিকাদের কথা কীভাবে ভুলি। তাঁদের কীভাবে হেনস্তা করেছে তা কীভাবে ভুলে যাবো!

তবে করোনা এখনো আমাদের শুদ্ধ করেনি। মানবিক শিক্ষা দেয়নি। নারীকে মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষাও দেয়নি। নয়তো কেন নারী পুরুষের একটা সাম্যবাদী পরিবার সমাজ বা রাষ্ট্র পাবো না। কেন এখনো নারীর হাহাকার বা দুঃখ বা কষ্ট! তাই বলতে ইচ্ছে করে –আর তো সইতে পারি না শিশু কন্যার যন্ত্রণা। কেবলই মনে হয় মানুষরূপী পশুর কখন হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি!

লেখক : সাহিত্যিক; সাবেক অধ্যক্ষ, আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধউদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত সড়ক ও জনপথ নির্মিত একশত সেতু
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল