আল-কোরআন মানুষের কাছে গচ্ছিত আল্লাহর মহা আমানত

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | শনিবার , ৫ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা আহযাবের ৭২ নং আয়াতে বলেছেন, ‘অবশ্যই আমি (কুরআনের এ) আমানত আসমানসমূহ, পৃথিবী ও পর্বতমালার সামনে পেশ করেছিলাম। তারা এটা বহন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করল, সবাই এতে ভীত হয়ে পড়ল। অবশেষে মানুষই তা বহন করে নিল, নিঃসন্দেহে সে (মানুষ ছিল) একান্ত জালেম ও (এ আমানত বহন করার গুরুত্ব সম্পর্কে একান্তই অজ্ঞ)। এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট তাফসীরগ্রন্থ ইবনে কাসীরে এসেছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, এখানে আমানত এর অর্থ আনুগত্যকে বুঝানো হয়েছে। এটি হযরত আদম (আঃ) এর উপরে পেশ করার পূর্বে জমিন, আসমান ও পাহাড়ের উপরে পেশ করা হয়। তারা সবাই এই বিরাট দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে। তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহতায়ালা হযরত আদম (আঃ) এর সামনে পেশ করেন এবং বলেন, ওরা সবাই অস্বীকার করেছে-এখন তুমি কি বলবে বলো। হযরত আদম (আঃ) জিজ্ঞাস করলেন, ইয়া আল্লাহ ব্যাপার কী? আল্লাহতায়ালা উত্তরে বললেন- এতে যা রয়েছে তা যদি তুমি মেনে চল তাহলে তুমি সওয়াব লাভ করবে ও ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে। আর যদি অমান্য কর তাহলে শাস্তি পাবে। তখন হযরত আদম (আঃ) বললেন, আমি এই দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত আছি। তাই এখানে বলা হয়েছে, ‘কিন্তু মানুষ ঐটা বহন করল: সে তো অতিশয় জালিম, অতিশয় অজ্ঞ’। হযরত আলী ইবনে আবি তালহা (রহঃ) বলেন, ইবনে আব্বাস (রাঃ) আল আমানাহ বলতে ফারায়াযের জ্ঞান বুঝিয়েছেন। আকাশ, পৃথিবী এবং পাহাড়কে আমানতের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন যে, তারা যদি ওর হক আদায় করতে পারে তাহলে তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেওয়া হবে এবং হক আদায় করার ত্রুটি করলে শাস্তি পেতে হবে। তাদের কেহ এই দায়িত্ব পালন করতে রাজি হয়নি। এর অর্থ এই নয় যে, আমানতের হক আদায় না করার ব্যাপারে আগে থেকে তাদের মনে অপরাধ করার ইচ্ছা বাসা বেঁধেছিল। বরং তাদের মনে এই ভয় ছিল যে, তাদেরকে যে দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে তা যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী হক আদায় করে চলতে না পারে তাহলে যে শাস্তি পেতে হবে তা তাদের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হবে না। অতঃপর আল্লাহতায়ালা হযরত আদম (আঃ) প্রস্তাব করলে তিনি সব শর্ত মেনে নেন। হযরত হুজায়ফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত-তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) আমাদের কাছে দুটি হাদিস বর্ণণা করেছেন। একটির বাস্তবতা আমি স্ব-চক্ষে দেখেছি এবং দ্বিতীয়টির জন্য অপেক্ষা করছি। প্রথমটি হল এই যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন-আমানত মানুষের অন্তরের মধ্যে অবতীর্ণ করা হয়েছে। কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, তারা এখন কুরআন এবং হাদীস থেকে জানতে পারছে।
অতঃপর তিনি আমানত উঠে যাওয়া সম্পর্কে বলেন, মানুষ ঘুমিয়ে যাবে, এমতাবস্থায় তার অন্তর থেকে আমানত উঠে যাবে। কিন্তু এমন একটি দাগ পায়ে থেকে যাবে যা দেখে মনে হবে যেন কোন জলন্ত কাঠ তার পায়ে লেগে আছে এবং এর ফলে ফুসকা পড়ে গেছে। অতপর তিনি একটি কংকর নিয়ে নিজ পায়ে চেপে ধরে লোকদেরকে তা দেখিয়ে বলেন- তুমি দেখতে পাবে যে ঐটা বেশ উঁচু হয়ে আছে কিন্তু তার ভেতরে কিছু্‌ই থাকবে না। জনগণ লেনদেন ও ক্রয়-বিক্রয় করতে থাকবে কিন্তু তাদের মধ্যে একজনও ঈমানদার থাকবে না। এমনকি বলা হবে যে, অমুক গোত্রের মধ্যে একজন আমানতদার লোক রয়েছে এবং এতদূর পর্যন্ত বলা হবে যে, এই লোকটি কতই না জ্ঞাণী, বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ। অথচ তার মধ্যে সরিষার দানা পর্যন্ত ঈমান থাকবে না। অতঃপর হযরত হুজায়ফা (রাঃ) বলেন, দেখ-ইতিপূর্বে আমি অনেককেই ধার কর্য দিতাম এবং অনেকের নিকট থেকে ধার নিতাম। কেননা সে মুসলিম হলে তো আমার প্রাপ্য আমাকে দিয়ে দিবে। আর সে ইহুদি বা খ্রিস্টান হলে ইসলামী শাসন তার নিকট হতে আমাকে আমার প্রাপ্য আদায় করিয়ে দিবে। কিন্তু বর্তমানে আমি অমুক অমুককে ধার কর্য দিয়ে থাকি এবং বাকি সবাইকে ধার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছি।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন : যখন ৪টি জিনিস তোমার মাঝে থাকবে তখন সারা দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলেও তোমার কোনো ক্ষতি নেই। জিনিসগুলো হল: আমানাত রক্ষা করা, সত্য কথা বলা, চরিত্র ভালো হওয়া এবং পরিমিত খাদ্যাভ্যাস। গাফিল মানুষ ব্যতীত মহাবিশ্বের গোটা সৃষ্টি এই কুরআনের মাহাত্ন্য সম্পর্কে কতটা সচেতন ও জাগ্রত, তা মহান আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা প্রমাণিত হয়: ‘যদি আমি এই কুরআনকে পর্বতের উপর অবতীর্ণ করতাম তবে তুমি তাকে আল্লাহর ভয়ে বিনীত এবং বিদীর্ণ দেখতে। আমি এই সমস্ত দৃষ্টান্ত বর্ণনা করি মানুষের জন্য, যাতে তারা কোরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে’- সূরা হাশর-২১। অতএব বুঝা যায়, আল্লাহতায়ালার কোরআনই মানবজাতির জন্য একমাত্র গচ্ছিত মহা আমানত ও হেদায়েত গ্রন্থ-যার অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমেই সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় এই যে, আমরা মানুষেরা আল্লাহর এই কোরআনকে উপলব্ধি ও চর্চার অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও পথভ্রষ্ট হচ্ছি। এই কোরআন পরকালের জন্য একমাত্র মুক্তির সিলসিলা হবে।
আসুন, এই কোরআনকে নিজের জীবনের প্রতিটি পদে পদে লালন করি। অর্থসহ বুঝে পড়ি। ব্যক্তি, সমাজ, পারিবারিক জীবনে মেনে চলার চেষ্টা করি এবং এই বিধানকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আপাদমস্তক মেহনত করি।

লেখক : সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি)
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রিমিয়ার ভার্সিটির সমাবর্তন : স্মৃতির ডায়েরিতে লেখা একটি দিন
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে