রায়ে স্তম্ভিত হিমুর মা-বাবা

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৫:৪১ পূর্বাহ্ণ

হিমাদ্রী হত্যা মামলায় উচ্চ আদালতের রায়ে স্তম্ভিত তার মা-বাবা।
গতকাল রায়ের প্রতিক্রিয়ায় হিমাদ্রীর মা গোপা মজুমদার এবং বাবা প্রবীর মজুমদার জানান, নিম্ন আদালতের রায়ে পাঁচ আসামির ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম উচ্চ আদালত তিন জনকে ফাঁসির পাশাপাশি বাকি দুইজনকে অন্তত জেল জরিমানা করবেন। তা না করে খালাস দিয়ে দিয়েছে। কীভাবে কী হয়েছে আমরা জানি না। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম বরাবরই।
শিকড় নামে একটি মাদকবিরোধী সংগঠনের মাধ্যমে সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল হিমাদ্রী। এ রকম একটি সংগঠনের
সঙ্গে জড়িত থেকে হিমাদ্রী কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড চালাতো। সে একজন কোমলমতি শিক্ষার্থী ছিল। তার এই সামাজিক কল্যাণমূলক কাজকে ভালোভাবে নেয়নি প্রভাবশালী মহল। যে কারণে হিমাদ্রীসহ সংগঠনের অপরাপর অনেকেই হুমকি পেয়েছে। হুমকি পাওয়া অনেকেই থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছে। তারপরও প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের থাবা থেকে রেহাই পায়নি হিমাদ্রী। হিমাদ্রীর মৃত্যুর পর আসামিপক্ষ বারবার সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, কিন্তু তারা ‘হাত মেলাননি’ বলেও জানিয়েছেন আজাদীকে।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন জানিয়ে হিমাদ্রীর মা গোপা মজুমদার আজাদীকে বলেন, একটা বাঘ যখন খাঁচা থেকে বের হয়, সে বাঘ আরও বেপরোয়া ও হিংস্র হয়ে ওঠে। আমরা খুবই উৎকণ্ঠায় আছি। এক ছেলেকে হারিয়ে তার বাবা আর আমি পাগলপ্রায়। আমার অন্য ছেলেকেও স্নেহ বঞ্চিত করে নিরাপত্তার কারণে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। ভয়ের মধ্যে দিন পার করছি। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, আমাদের পরিবারের নিরাপত্তা কে দেবে? তিনি বলেন, ‘মা না হতে পারাটা সহনীয়। কিন্তু মা হয়ে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা সইতে পারে না কেউ।’
গোপা মজুমদার বলেন, নিম্ন আদালতে যে রায় দিয়েছিল আমরা মনে করেছিলাম হাইকোর্ট সেই রায় বহাল রাখবে। আমার ছেলের হত্যাকারীরা ফাঁসিতে ঝুলবে। কিন্তু মামলার প্রধান আসামিকেই বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। এ রায়ে আমরা খুবই হতাশ এবং ভীতসন্ত্রস্ত। তারপরও তিনজন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। তার মধ্যে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছি। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ড্যানি ছাড়া বাকি দু’জনও পলাতক।
তিনি বলেন, গত ১০ বছরেও তাদের আইনের আওতায় আনা গেল না। মামলা যতদিন চট্টগ্রামে নিম্ন আদালতে ছিল, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। উচ্চ আদালতে যাবার পর আর তেমন কিছু করতে পারিনি। আমাদের মত সাধারণ মানুষ আর কী-ই বা করতে পারব। এখন অভিশপ্তের মতোই বেঁচে আছি। আর্থিক শারীরিক মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। হিমুর মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, মামলার প্রধান আসামি ছিল শাহ সেলিম টিপু। জজ আদালতে ফাঁসির দণ্ডিত আসামির তো কিছু হলেও শাস্তি হওয়ার কথা। সেই আসামি বেকসুর খালাস কিভাবে পায়! আমার ছেলেকে টিপুর নির্দেশেই তার ভবনের ছাদে নিয়ে আটকে রাখা হয়। মধ্যযুগীয় কায়দায় সীমাহীন বর্বরতা চালিয়ে কুকুর লেলিয়ে দিয়ে হত্যা করা হয়। মাদকের প্রতিবাদ করা যদি অপরাধ হতো, আমার ছেলেকে তারা পুলিশে দিতে পারত। খুনের হুকুমদাতা টিপু।
বৃহস্পতিবার আপিলের রায় ঘোষণার বিষয়টি সকালে প্রথম গণমাধ্যম কর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারেন বলে জানান গোপা মজুমদার। তিনি বলেন, আমরা লেগে থাকতে পারলে হয়ত নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকত। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়া করে তা আর সম্ভব হয়নি। আজ রায় হবে- সেটাও আমাদের আগে জানানো হয়নি। তিনি মিডিয়া কর্মীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘একমাত্র আপনারাই গত দশ বছর ধরে আমাদের পাশে ছিলেন। আমাদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়, সুবিধাভোগী মানুষ, বন্ধুবান্ধব সবাই একে একে সরে গেছেন আমাদের একা করে। আপনারা যদি পাশে না থাকতেন, তাহলে আরও আগেই আসামিরা মুক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াত চোখের সামনে। মিডিয়া না থাকলে ১০ বছর আগেই হিমু হত্যা মামলা তলিয়ে যেত।’
জানা গেছে, মাদক কারবারে বাধা দেওয়ার কারণে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ এলাকার সামার ফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে ২০১২ সালের ২৭ এপ্রিল হিমাদ্রীকে ধরে নিয়ে যান আসামি শাওন, রিয়াদ, সাজু ও ড্যানি। হিমাদ্রী ওই স্কুল থেকে ‘এ’ লেভেল পাস করেন। আসামিরা তাকে ধরে পাঁচলাইশ এলাকায় রিয়াদের বাবা ব্যবসায়ী টিপুর বাড়ির ছাদে নিয়ে যান। সেখানে আটকে রেখে মারধরের পর হিংস্র কুকুর লেলিয়ে ও ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেওয়া হয়। হাসপাতালে ২৬ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর একই বছরের ২৩ মে হিমাদ্রী মারা যান।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসালিশি বৈঠকে মারধর, যুবকের মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধতিন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল