প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টের ধ্বংসলীলার মাত্রা বোঝাতে এক ফরাসি সৈনিকের লেখা উপন্যাসের এই উক্তি প্রায় ব্যবহৃত হয়: ‘দুই পক্ষের সৈন্যরা একে অপরের বিপক্ষে যুদ্ধ করার ঘটনাটা অনেকটা এক সৈন্যদল একত্রে আত্মহত্যা করার মত।’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জার্মান ঔপন্যাসিক এরিক মারিয়া রেমার্কের কালজয়ী উপন্যাস ‘All quite on the western front’ অবলম্বনে প্রথমবারের মতো জার্মানদের নির্মিত এই সিনেমা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল ঐ ফরাসি সৈনিকের বলে যাওয়া বচনেরই যেন প্রতিচ্ছিবি দেখছিলাম। ১৯৩০ ও ১৯৭৯ সালে হলিউড থেকে এই উপন্যাস অবলম্বনে সিনেমা হলেও খোদ জার্মানি থেকে এটাই প্রথম।
ধ্বংসলীলার বাইরে এই সিনেমা মন কেড়ে নিল মানবিক বন্ধুত্বের মুহুর্তগুলোতে। যুদ্ধকালীন সময়ে সৈন্যদের মধ্যে গড়ে উঠা উষ্ণ মায়ার সম্পর্ক, বড় ভাইয়ের মতো ছোট বয়সী সৈনিকদের যুদ্ধের ময়দানে বেঁচে থাকার কৌশল শেখানো, কৃষকের বাড়ি থেকে হাঁস চুরি করে একত্রে রান্না করার তৃপ্তির ভাগ-বাটোয়ারা, দীর্ঘদিন পরে নারীসঙ্গ পাওয়া এক সৈনিক যখন তার বান্ধবীর স্কার্ফ নিয়ে আসে সেটা ঘ্রাণ নেবার মূহুর্তে একেকজনের কল্পিত-বঞ্চিত কৈশোর মেশানো মন্তব্য-খুনসুটি!
অন্যান্য মহৎ যুদ্ধবিরোধী সিনেমার মতো এই সিনেমাও দলিল হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। তবে প্রথম কয়েক মিনিটের দৃশ্য মনে হয় চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্বের তালিকায় ঠাঁই নিয়ে নিতে পারে। প্রথমে দেখি ‘হেনরিখ’ নামের এক কিশোর সৈনিক যুদ্ধে মারা গেল। তার নামাঙ্কিত সেই পোশাক শরীর থেকে সরিয়ে ফেলা হল। ধোয়া হল ধোলাইখানায়। সেই পোশাকটা সেলাইখানায় সেলাই করে নতুনের মতো করা হল। এরপরে সিনেমার মূল প্রোটাগনিস্ট ‘পল’ যেদিন যুদ্ধে যোগদান করছে তাকে দেয়া হল হেনরিখ এর সেই পোশাক। সেই পোশাকে ভুলবশত হেনরিখ-এর নামের ট্যাগ সরানো হয়নি। পল যখন সেটি দেখতে পেল এবং পোশাক বিতরণকারীকে ব্যাপারটা জানাল, তখন সে উত্তর দিল ‘মনে হয় এই কাপড় হেনরিখের ছোট হত। এমনটা প্রায়ই হয় এই বলে সে নামের ট্যাগটি ছিঁড়ে পোশাকটা পলকে আবার দিয়ে দিল। এই যে হেনরিখের উর্দি কীভাবে পলের উর্দি হল, তার চিত্রায়ন থেকে সম্পাদনা, সবই চিরস্থায়ীভাবে যেন মনে ঠাঁই নিয়ে নিল! যুদ্ধ যে নিরন্তর মৃত্যুর মনুষ্য-সৃষ্ট আয়োজন, তার দুর্দান্ত নিদর্শন হয়ে থাকবে এই সিনেমার প্রথম কয়েক মিনিট, যার রেশ পুরো সিনেমা জুড়েই ছিল।
আরেকটা ব্যাপার খুব মনে ধরেছে। যুদ্ধে যে-দুটো ভিন্ন জগত হাজির থাকে, তার চিত্রায়ন। একটি জগত যেটা সৈনিক পল কিংবা হেনরিখদের আসল যুদ্ধক্ষেত্রে। এই জগতে প্রতিনিয়ত ধ্বংসলীলা, মুহুর্মুহ চ্যালেঞ্জ, সহযোদ্ধার লাশ কাঁধে নেয়ার জন্য যে-কোন মুহুর্তে নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখা, যুদ্ধকালীন সময়ে জগতের সকল আনন্দ-প্রশান্তি বিসর্জন দিয়ে নিজেকে আপাত ভ্রান্ত আদর্শের জন্য আত্মাহুতি দেয়া, এসব যেন প্রতি সেকেন্ডের রুটিন। আরেকটা জগত, যুদ্ধের নীতি-নির্ধারকদের জগত যেখানে যুদ্ধের মূল ক্রীড়ানকেরা, রাজনীতিবিদেরা, সমরের নেতারা বসে সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধ কীভাবে হবে, কখন হবে ইত্যাদি। চলচ্চিত্রে এই দুই জগতের মধ্যকার পার্থক্যগুলো যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে স্পষ্ট করে দেখানো হয়। এক জগতের বাসিন্দারা যখন লাশের স্তূপে নিজের শেষ নিঃশ্বাসের প্রহর গুনছে, অন্য জগতের বাসিন্দারা প্রকান্ড সাজসজ্জাময় মজলিশে খাবার খেতে খেতে আয়েশি ভঙ্গিতে আলাপ করছেন যুদ্ধের পরবর্তী ধাপ কি হতে পারে। সৈনিকদের পোকামাকড়-সম জীবনযাপনের বিপরীতে এ যেন বুর্জোয়া ভোগ বিলাসের জগত। চলচ্চিত্রের দৃশ্যের শক্তির যেন দুর্দান্ত ব্যবহার দেখতে পাই এই দুই জগতের নিদারুণ পার্থক্য দেখতে গিয়ে।
পুরো চলচ্চিত্রে এটাই স্পষ্টভাবে দেখি যে, যুদ্ধের ময়দানে আমজনতা হল চক্রাকারে ঘুরতে থাকা একই পোশাক পরিহিত ভিন্ন অবয়বের আপাত নিষ্পাপ অংশগ্রহণকারী। সে অংশগ্রহণ করে জেনে কিংবা না-জেনে, বাঁচার তাগিদে কিংবা দেশপ্রেমের বুদবুদে। কে জানে কোনটা সত্য!
এই সিনেমা যেহেতু একটা বিখ্যাত উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ, এটা নিয়ে অনেক আলোচনা ভবিষ্যতে হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা দেখি অনেকেই সাহিত্যের সাথে চলচ্চিত্রের অসম একটা তুলনা কিংবা যাচাই করে বসেন। মনে রাখতে হবে, দুটি একেবারেই ভিন্ন মাধ্যম। বইয়ে আমরা যেটা কল্পনা করি, সেই কল্পনা একেকজনের নিজস্ব জীবনবীক্ষা, জীবনযাপনের ধরণ থেকে প্রতিফলিত হয়ে নানান ভাবনায় ধরা দেয় আমাদের মনে। এক্ষেত্রে চলচ্চিত্র পরিচালকের কাজটা একটু চ্যালেঞ্জিং এজন্য যে, সে অনেক সম্ভাবনার দৃশ্যায়নের মধ্যে অনেক ভেবেচিন্তে একটা দৃশ্যরূপ হাজির করছেন। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্রের রূপায়নে এমন অনেক চ্যালেঞ্জের প্রসঙ্গ অবশ্যই বিবেচনায় আনা উচিত বলে মনে করি। এই লেখায় আমি শুধুমাত্র চলচ্চিত্রটি ভাল লাগার কিছু বিচ্ছিন্ন অনুভূতি ব্যক্ত করলাম। এর বেশি কিছু নয়।