এক ট্যাংক লরিতেই ৩২ হাজার টাকার বেশি দামের জেট ফুয়েল গায়েব করে দেয়ার একটি ঘটনা ধরা পড়েছে। প্রতিদিন এই পথে ১২ থেকে ১৫ গাড়ি তেল পরিবহন করা হয়। বিপুল পরিমাণ তেল পরিবহনকালে বছরে ১০ কোটি টাকার বেশি অর্থের তেল গায়েব করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
পদ্মা অয়েল কোম্পানির গুপ্তখাল ডিপো থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। দুটি ট্যাংক লরি থেকে তেল গায়েবের ঘটনা ধরা পড়ার পর তা ধামাচাপা দেয়ার নানা কৌশল শুরু হয়েছে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অটো রিফুয়েলিং স্টিস্টেম রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত তেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি সরকারি-বেসরকারি এবং দেশি-বিদেশি ফ্লাইট অপারেটরদের কাছে তেল বিক্রির ব্যাপারটি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। পতেঙ্গার গুপ্তখাল প্রধান ডিপো থেকে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ ট্যাংক লরি জেট ফুয়েল বিমানবন্দরের ট্যাংকে নিয়ে যাওয়া হয়। বিক্রি বেশি হলে ট্যাংক লরির পরিমাণ ১৮টি পর্যন্ত হয়। একটি ট্যাংক লরিতে ২০ হাজার লিটার জেট ফুয়েল পরিবাহিত হয়। প্রতিদিন গড়ে ২ লাখ ৪০ হাজার লিটার থেকে ৩ লাখ লিটার পর্যন্ত জ্বালানি তেল বিক্রি হয়। গুপ্তাখাল ডিপো থেকে বিমানবন্দরের ট্যাংকে পরিবহনের জন্য পদ্মা অয়েল কোম্পানির ৩টি ট্যাংক লরির পাশাপাশি ভাড়ায় ২টি ট্যাংক লরি ব্যবহার করা হয়। চট্টগ্রামের জনৈক বাদশা কোম্পানির মালিকানাধীন বেসরকারি ট্যাংক লরি দীর্ঘদিন ধরে এই তেল পরিবহন করে।
গত ১১ অক্টোবর দুপুরে ওই কোম্পানির ট্যাংক লরি (নং চট্টমেট্রো-ড-৪১-০০৮৫) গুপ্তাখাল ডিপো থেকে ২০ হাজার লিটার জেট ফুয়েল নিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে। তারা বিমানবন্দরের ট্যাংকে তেল সরবরাহ দেয়ার আগে তাদের তেল তল্লাশি করা হয়। বিমানবন্দরে গোপন এক ফোন কলের সূত্র ধরেই তেল পরিমাপ করা হলে ওই গাড়িতে ২৫০ লিটার জেট ফুয়েল কম পাওয়া যায়। গুপ্তাখাল ডিপো থেকে ২০ হাজার লিটার তেল নেয়া হলেও দুই কিলোমিটারের মধ্যে এই তেল কীভাবে গায়েব করা হলো তা নিয়ে কর্মকর্তারা ওই ট্যাংক লরির ড্রাইভার মোহাম্মদ ইসকান্দর ও হেলপার মোহাম্মদ আফসারকে অফিসে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তারা অপকর্ম স্বীকার করেন এবং বিমানবন্দর ডিপোর পদ্মা অয়েল কোম্পানির এজিএম সিরাজউদ্দিন আহমেদ এবং ডেপুটি ম্যানেজার সাইদুল হকের কাছে ক্ষমা চান। তারা বেশ কিছুদিন ধরে এভাবে তেল লোপাট করার কথা স্বীকার করে এর সাথে বিমানবন্দর ডিপোর কর্মচারী লক্ষণ ও নাছিরের যোগসূত্র থাকার কথা উল্লেখ করেন।
এই ঘটনা চলাকালে ওই বেসরকারি ঠিকাদারি কোম্পানির অপর ট্যাংক লরিটিও বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়। ওই ট্যাংক লরির চালক ও সহকারীকে অফিসে এনে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারাও তেল গায়েব করার কথা স্বীকার করে চা-পানির টাকা পান বলে স্বীকার করেন। তারাও লিখিতভাবে দোষ স্বীকার এবং ডিপো ম্যানেজারের কাছে ক্ষমা চেয়ে আর কখনো এমন করবেন না বলে অঙ্গীকার করেন।
সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলেছে, দুটি ট্যাংক লরির চালক এবং সহকারী তেল গায়েবের কথা স্বীকার করলেও মূলত সব ট্যাংক লরিই এই পথে তেল গায়েব করে। তবে বেসরকারি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ট্যাংক লরিগুলো বেপরোয়া। তারা ২০ হাজার লিটারের একটি গাড়ি থেকে অনায়াসে ২৫০ থেকে ৩০০ লিটার তেল গায়েব করে দেয়। এভাবে প্রতিদিন গড়ে ১৫ ট্রিপের মধ্যে যদি ৮ ট্রিপে গাড়িপ্রতি ২৫০ লিটার করে তেল গায়েব করে তাহলে পরিমাণ দাঁড়ায় ২ হাজার লিটার। প্রতি লিটার জেট ফুয়েলের দাম ১৩০ টাকা করে হলে প্রতিদিনের লোপাটকৃত তেলের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বছর শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৯ কোটি টাকা। বছরের পর বছর লোপাট চলছে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বিমানবন্দর ডিপোর প্রভাবশালী কর্মকর্তা- কর্মচারীদের পাশাপাশি গুপ্তাখাল ডিপোর অসাধু একটি চক্রের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট এই তেল লোপাট করে।
পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য একটি মহল মরিয়া উল্লেখ করে সূত্র জানায়, বছরে অন্তত ১০ কোটি টাকার তেল লোপাটের ঘটনাটিকে সাদামাটাভাবে দেখা হচ্ছে। যারা ধরা পড়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুরো চক্রটিকে শনাক্ত এবং আইনের আওতায় আনার সুযোগ থাকলেও রহস্যজনক কারণে তা করা হচ্ছে না।
ডিপো ইনচার্জ পদ্মা অয়েল কোম্পানির এজিএম সিরাজউদ্দিন আহমেদ ঘটনার কথা স্বীকার করে বলেন, এটি তেমন বড় ঘটনা নয়। ঘটনার জন্য দায়ী চালক ও হেলপারকে ওই ঠিকাদার গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছেন। গাড়িতে নতুন ড্রাইভার ও হেলপার দেয়া হয়েছে। আর সমস্যা হবে না। তাছাড়া যে ১০০ লিটারের মতো তেল আমরা কম রিসিভ করেছি তা বিলের সাথে অ্যাডজাস্ট করার জন্য গুপ্তাখাল ডিপোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়েছি। এই ব্যাপারে আর কোনো সমস্যা নেই।